স্বাস্থ্য বাজেট ব্যয় করতে না পারার প্রবণতা অব্যাহত
স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাজেট ব্যয় করার অক্ষমতার প্রবণতা অব্যাহত আছে এবারও, চলতি অর্থবছর ২০২১-২২ এর ১০ মাসে বরাদ্দ বাজেটের মাত্র ৪১.৮৬% ব্যয় হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার পরও এ ধারা অব্যাহত আছে।
বরাদ্দের আরো ৫৯% অর্থ ব্যয় করতে হবে মাত্র এক মাসে। প্রতিবারের মত এ বছরও স্বাস্থ্য বাজেটের অর্থ ফেরত যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
যদিও বিদ্যুৎ, নির্বাচন কমিশনসহ অধিকাংশ মন্ত্রণালয় বাজেটের প্রায় ৭০% অর্থ ব্যয় করেছে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অধীনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনের দুটি বিভাগ স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ও স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগকে চলতি অর্থবছরে ৯,৯৮৯ কোটি ও ২,০৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে গত জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ব্যয় করেছে ৩,৯৭০ কোটি টাকা বা মোট বরাদ্দের ৩৯.৭৫%। অন্যদিকে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ খরচ করতে পেরেছে ১,০৮২কোটি টাকা বা বরাদ্দের ৫২.০৩%।
আগামী ৩০ জুনের মধ্যে বিভাগ দুটি সর্বোচ্চ তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকার ব্যয় করতে পারবে। বাকি টাকা ফেরত যাবে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে খরচ করতে না পারায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ৫ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা সরকারি তহবিলে ফেরত গেছে।
অর্থ ব্যয় না হওয়ার পেছনে পরিকল্পনার অভাবকে দায়ী করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মতো স্বাস্থ্য খাতের টাকা ব্যয় করা সম্ভব নয়।
এটি একটি টেকনিক্যাল মন্ত্রণালয়। আগে থেকে জনবল প্রস্তুতসহ চাহিদাপত্র তৈরি করতে হবে। এজন্য পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। অথচ তা না করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু সেই অর্থ ব্যয় করার সক্ষমতা স্বাস্থ্য বিভাগের নেই। সুতরাং আগে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ দিতে হবে। তাহলে অর্থ ফেরত যাবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপারেটিং বাজেট ব্যয় হলেও প্রতি বছরই ডেভলপমেন্ট বাজেটের প্রায় ২৫% অব্যবহৃত থেকে যায়। ডেভলভমেন্ট বাজেটের একটা বড় অংশ ব্যয় হয় প্রকিউরমেন্ট খাতে। এ খাতে অর্থ ব্যয়ের সাথে যারা জড়িত সে সব কর্মকর্তাদের প্রকিউরমেন্ট রিলেটেড দক্ষতার ঘাটতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দেরিতে অর্থ ছাড়সহ বিভিন্ন কারণে ডেভলভমেন্ট বাজেটের অর্থ অব্যবহৃত থাকে।
জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহাবুব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, যাদের বাজেট তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয় তাদের দক্ষতার অভাব আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যারা বাজেট তৈরির সাথে জড়িত তারা মূলত চিকিৎসক, অ্যাকাউন্টিং, ফিন্যান্স বিষয়ে তাদের দক্ষতা নেই। বাজেট মানে শুধু অর্থ বরাদ্দ নয়, দক্ষতার সাথে সে অর্থ ব্যয় করতে হবে। বাজেট তৈরির সাথে যারা জড়িত তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মুজাহেরুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো বছর বাজেটের বরাদ্দকৃত অর্থ পুরোপুরি ব্যয় করতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
"স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বাজেট প্রজেকশন, বাজেট পাশের ও অর্থ ব্যয়ের দক্ষতা নেই। বাজেট দেওয়ার আগে কৌশলগত পরিকল্পনা ঠিক করতে হবে, কখন কী কী কাজ করা হবে, কোনটি আগে ও কোনটি পরে করা হবে তা ঠিক করতে হবে। বাজেট অনুযায়ী কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে ও নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।"
অর্থ বরাদ্দ ও ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে
বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু স্বাস্থ্য খরচ ৪৫ ডলার। অথচ নেপালে ৫৮ ডলার, ভারতে ৭৩ ডলার, ভুটানে ১০৩ ডলার এবং শ্রীলঙ্কায় ১৫৭ ডলার। স্বাস্থ্য খাতে গতানুগতিকভাবে মোট বাজেটের ৫ থেকে ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার প্রথা থেকে বেরিয়ে এসে বাজেটে বরাদ্দ ৮-১০% বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহ্বায়ক ড. আহমেদ মোশতাক রাজা চৌধুরী টিবিএস-কে বলেন, "আমরা আসলে কী চাই তা ঠিক করতে হবে। তা না হলে বাজেটের অর্থ ব্যয় করতে না পারার এ সমস্যার সমাধান হবে না।"
"বিশ্ব মানের স্বাস্থ্য সেবা অর্জন করতে হলে কোথায় কোথায় বিনিয়োগ করতে হবে তা ঠিক করতে হবে এবং সে অনুযায়ী অর্থ ব্যয় করতে হবে। স্বাস্থ্য গবেষণা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা ও উপজেলা হাসপাতালের উন্নয়নে বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে", যোগ করেন তিনি।
মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৮ শতাংশ আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার বা নাগরিকদের পকেট থেকে আসে। আর সরকারের কাছ থেকে আসছে ২৩ শতাংশ।
বাজেটে ওষুধে ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বাবদ ব্যয় বাড়ানো গেলে নাগরিকদের ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ কমানো সম্ভব বলে মনে করেন ড. আহমেদ মোশতাক রাজা চৌধুরী।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এনামুল হক টিবিএস-কে বলেন, চলতি অর্থবছরে গতবারের তুলনায় খরচ বেশি হবে বলে মনে হচ্ছে।
"কারণ গত বছর লকডাউনের কারণে অনেক যন্ত্রপাতির শিপমেন্ট বন্ধ ছিলো। এ বছর সে সমস্যা নেই। ক্রয়বিধি অনুসারে প্রয়োজন অনুযায়ী কেনাকাটা করতে সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।"