সত্যি কি সাপের ছোবলে মরেছেন ক্লিওপেট্রা
ক্লিওপেট্রা। ছিলেন প্রাচীন মিসরের দাপুটে শাসক। একদিকে রূপ, অন্যদিকে ক্রোধের কারণে একইসঙ্গে খ্যাতি ও কুখ্যাতি ছিল তার। মৃত্যুর দুই হাজার বছর পরও তাকে নিয়ে কৌতুহলের কমতি নেই। তার মৃত্যু নিয়ে রহস্যের নেই কূল-কিনারা। হিস্টোরি ডটকমের সূত্র ধরে চলুন নেওয়া যাক সেই রহস্যের পাঠ।
সময় ৩১ খ্রিস্টপূর্ব। আকতিয়ামের যুদ্ধে মিসরের রানী ক্লিওপেট্রা ও তার দীর্ঘকালের প্রেমিক, রোমান জেনারেল মার্ক আন্তোনির যৌথবাহিনির হলো পতন। আলেক্সান্দ্রিয়ায় পালিয়ে গেলেন তারা। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কয়েক মাস পর শহরটির সদর দরজায় প্রতিপক্ষ ও যুদ্ধে জয়ী অক্তাভিয়ানের রোমান সেনাদলের দেখা পেলেন আন্তোনি। কাল বিলম্ব না করে নিজের তরবারিতে নিজেরই প্রাণ নিলেন তিনি।
অন্যদিকে নিজ সাম্রাজ্য হারানো ক্লিওপেট্রাও বেছে নিলেন আত্মহননের পথ। সেদিন ছিল আগস্টের ১০ তারিখ; খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সাল। বলা হয়ে থাকে, আত্মহননের অস্ত্র হিসেবে বিষাক্ত সাপের ছোবলকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। আসলেই কি তা করেছিলেন?
প্রতিমা বনাম বাস্তবতা
ক্লিওপেট্রার মৃত্যু ঘিরে নিরেট ঐতিহাসিক প্রমাণাদি যা আছে, এমনকি তার জীবনীগুলোতেও যা পাওয়া যায়, তা যথেষ্ট নয়। তার জীবনীর রসদ যে মানুষটি সবচেয়ে বিশ্বস্তভাবে জুগিয়েছেন, তিনি প্রখ্যাত রোমান সাহিত্যিক প্লুতার্চ। ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর পর কয়েক প্রজন্ম বেঁচে ছিলেন তিনি।
পরবর্তীকালে কবি, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকাররা নানা সূত্র থেকে রসদ নিয়ে ক্লিওপেট্রাকে একদম পৌরাণিক চরিত্রে পরিণত করেছেন। তার আবেদন-ক্ষমতা এবং দুই রোমান নেতা জুলিয়াস সিজার ও মার্ক আন্তোনির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ব্যাপক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য কবিতা, নাটক ও চলচ্চিত্রে।
জীবনের এমনতর কাল্পনিক বৈশিষ্ট্য এবং অকালপ্রয়াণের মসলায় ক্লিওপেট্রার যে প্রতিমা গড়ে তোলা হয়েছে, সেটি ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত নাটকগুলোতে প্রধান চরিত্র তাকে করে তোলার জন্য যথেষ্ট। হয়েছেও তা-ই।
কিন্তু সেই প্রতিমার বাইরে, বাস্তব জীবনে এই রানী দেখতে যেমনই ছিলেন না কেন, নিঃসন্দেহে ছিলেন একজন প্রতাপশালী শাসক; ছিলেন তিন শতকেরও বেশিকাল মিসর শাসন করা গ্রিক রাজবংশটির সবচেয়ে দাপুটে সদস্যদের একজন।
মৃত্যু নিয়ে মিথ
আকতিয়াম যুদ্ধে রোমানদের কাছে মিসরীয় সেনাবাহিনি পর্যুদস্ত হওয়ার পর পিছু হটে আলেক্সান্দ্রিয়ায় আশ্রয় নেন আন্তোনি ও ক্লিওপেট্রা। সেখানে নিজেদের পুরনো মিত্রবাহিনির সদস্য ও অক্তাভিয়ানের পক্ষত্যাগকারীদের সঙ্গে মিলিত হন তারা।
২০১০ সালে প্রকাশিত ক্লিওপেট্রার জীবনীগ্রন্থের লেখিকা স্টেসি শিফ জানিয়েছেন, এই সময়ে এই দম্পতি আবারও লড়াই করার বদলে বরং মৃত্যুকে আলিঙ্গনের পথই তৈরি করতে থাকেন। নিজের প্রাসাদের মাটির নিচে একটি দোতলা সমাধিস্তম্ভ তৈরি করে নেন ক্লিওপেট্রা।
৩০ খ্রিস্টপূর্বের জুলাইয়ে আলেক্সান্দ্রিয়ায় পৌঁছে যায় অক্তাভিয়ান বাহিনি। এ খবর জেনে নিজের সেই সমাধিস্তম্ভে ঢুকে পড়েন ক্লিওপেট্রা। তার মারা যাওয়ার গুজব শুনে নিজের তরবারিতে নিজেকেই জখম করেন আন্তোনি। তার লোকেরা গুরুতর আহত তাকে বয়ে আনে ক্লিওপেট্রার কাছে। প্রেমিকার কোলেই প্রাণপাখি উড়ে যায় আন্তোনির।
প্লুতার্চের তথ্যমতে, অক্তাভিয়ানের স্টাফদের একজন গোপনে ৯ আগস্ট ক্লিওপেট্রাকে সতর্ক করে দেন, রোমান জেনারেল অক্তাভিয়ান কয়েক দিনের মধ্যেই রোমে ফেরার পরিকল্পনা করেছেন। ফেরার সময় ক্লিওপেট্রা ও তার সন্তানদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবেন তিনি।
এ তথ্য জানার পরদিনই সমাধিস্তম্ভের ভেতর নিজেকে বন্দি করে ফেলেন ক্লিওপেট্রা। দুই বিশ্বস্ত সেবিকা ইরাস ও চারমিয়নকে রাখেন সঙ্গে। আর, সে সময়ে আলেক্সান্দ্রিয়ায় ক্লিওপেট্রারই প্রাসাদে থাকা অক্তাভিয়ানের উদ্দেশ্যে পাঠান চিরকুট।
সেই চিরকুটে লেখা ছিল, তাকে যেন প্রেমিক আন্তোনির পাশেই সমাহিত করা হয়। চিরকুট পেয়েই ক্লিওপেট্রার খোঁজে লোক পাঠান অক্তাভিয়ান। সমাধিস্তম্ভের দরজা ভেঙ্গে তারা মিসরের রানীকে পাননি, পেয়েছিলেন তার লাশ। পাশে মরে পড়ে ছিলেন তার সেই দুই বিশ্বস্ত সেবিকাও।
মৃত্যুকালে ক্লিওপেট্রার বয়স হয়েছিল ৩৯। এর আগে, ২০ বছরেরও বেশিকাল মিসর শাসন করে গেছেন তিনি।
সাপের ছোবল তত্ত্ব
সাপের ছোবলেই ক্লিওপেট্রা মরেছেন- এমন তথ্যই বারবার শোনা যায়। কোন সাপ? কেউ বলেন ভেনোমাস স্ন্যাক। কেউ বলেন অ্যাস্প স্ন্যাক। কেউ বলেন ইজিপ্সিয়ান কোবরা।
এমন দাবির কিছু কাব্যিক যুক্তিও আছে: অ্যাস্প ছিল মিসরীয় রাজবংশের প্রতীক; অন্যদিকে কোবরা ছিল ক্লিওপেট্রার প্রিয় দেবি আইসিসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
তবে এই তত্ত্বের ব্যাপারে কিছু আপত্তি আছে আধুনিক মিসর-বিশেষজ্ঞদের। কোবরা আকারে সাধারণত ৫ ফুট দীর্ঘ; বড় কোবরার পক্ষে ৮ ফুট পর্যন্ত দীর্ঘ হওয়া সম্ভব। কিন্তু ক্লিওপেট্রার সমাধিস্তম্ভে ছোবল দেওয়া সাপটি এক ঝুঁড়িতে রাখা ছিল বলে কথিত আছে। তাই অত ছোট ঝুঁড়িতে এত বড় সাপ রাখা সম্ভব নয় বলেই মত ইতিহাসবিদদের।
তাছাড়া সব সাপের ছোবলেই প্রাণহানি ঘটে না। আর যেগুলোর ছোবলে ঘটে, সেই মৃত্যু খুব ধীরে ধীরে ও নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে হয়। তাই অক্তাভিয়ানকে চিরকুট পাঠানোর পর সাপের ছোবলে এত দ্রুতই ক্লিওপেট্রা ও তার দুই সেবিকা মারা গেছেন- এটা বিশ্বাস করা ইতিহাসবিদদের পক্ষে কষ্টকরই।
শিফ অবশ্য অন্য তর্ক তুলেছেন। তার মতে, ক্লিওপেট্রা যদি সাপের ছোবলে প্রাণ হারিয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে ছোবল খাওয়ার আগে নিশ্চয় কোনো নেশাদ্রব্য পান করে নিয়েছিলেন তিনি। অথবা কোনো সাপ নয়, বরং তার সেবিকারাই তাকে খুন করেছেন। এজন্যই এত দ্রুত মৃত্যু হয়েছে তার।
অন্যদিকে, একজন টক্সিকলোজিস্টকে সঙ্গে নিয়ে কিছু প্রাচীন তথ্য-উপাত্তের ওপর গবেষণার ভিত্তিতে ২০১০ সালে জার্মান ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফ শেফার মত দিয়েছেন, ক্লিওপেট্রা সম্ভবত হেমলক, ওলফসবেন ও আফিমের কোনো ভয়ঙ্কর মিশ্রণ পান করেছিলেন।
আসলেই আত্মহনন?
সত্য এখনো অধরাই রয়ে গেছে। ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান কিংবা এ সংক্রান্ত লিখিত প্রাথমিক দলিল না থাকায় কেউ কেউ মনে করেন, অক্তাভিয়ানের হাতেই প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। মিসরে নিজ আধিপত্য জাহির করার জন্য, সেদেশের এই ক্যারিশম্যাটিক রানীকে বাঁচিয়ে রাখা নিশ্চয়ই অক্তাভিয়ানের নিরাপদ মনে করার কথাও নয়।
ক্লিওপেট্রাকে খুনের নির্দেশ অক্তাভিয়ান দিয়েছিলেন কি দেননি, নাকি নিজের সেবিকাদের হাতেই তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, নাকি আত্মহননের সুযোগটি নিজেই নিয়েছেন- এ নিয়ে রহস্য থাকলেও এরপরের ঘটনা স্পষ্ট: মায়ের রাজত্বে ভবিষ্যতে যেন ছেলে বসতে না পারে, সেজন্য ক্লিওপেট্রা-সিজারের পুত্র সিজারিয়নকে খুঁজে বের করে মেরে ফেলার নির্দেশটা অক্তাভিয়ানই দিয়েছিলেন।
এরপর মিসরকে রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন অক্তাভিয়ান। আর নিজেকে অধিষ্ঠিত করেন রোমান সম্রাট পদে। নিজের নামও বদলে নেন তিনি: অক্তাভিয়ান থেকে আগুস্তুস। ইতিহাসে এ নামেই অধিক খ্যাতি তার। পরবর্তীকালে তার লেখা স্মৃতিকথা 'অক্তাভিয়ান/আগুস্তুস' থেকেই এতগুলো বছর ধরে ক্লিওপেট্রার বৈশিষ্ট্য ও সাপের ছোবলে আত্মহনের এই পৌরাণিক বাস্তবতা বা বাস্তবিক পুরাণ প্রচলিত রয়েছে।