৩ বছরের মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ অর্ধেকে নামিয়ে আনবে সরকার
সুদ পরিশোধে লাগাম টানতে তিন বছরের মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ অর্ধেকে নামিয়ে আনবে সরকার। জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এজন্য বাড়তি বিধি-নিষেধ আরোপ করে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের আর্কষণ কমাতে পারে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া কমালে সরকারের সুদ ব্যয়ের উপর চাপ কমলেও দেশের বিপুল পরিমাণ সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ব্যাংকের আমানতের প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় মধ্যবিত্তরা ঝূঁকিমুক্ত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে। পেনশনারসহ অনেকে জীবনের পুরো সঞ্চয় এই খাতে বিনিয়োগ করে তা থেকে পাওয়া মুনাফা দিয়ে জীবন নির্বাহ করেন।
মূলত শেয়ার বাজারে লোকসানের ভয় ও ব্যাংকে আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী হন সঞ্চয়কারীরা। ফলে কোভিডকালীন সময়েও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেড়েছে।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ খাত থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছর এর পরিমাণ তিন হাজার কোটি টাকা বাড়তে পারে। পরের দুই অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের লাগাম টেনে ধরলে কম সুদের বিদেশি ঋণের উপর নির্ভরতা বাড়বে।
গত অর্থবছর সরকারের সুদ ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সুদ ব্যয় বাবদ বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৭১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আগামী অর্থবছর এটি বেড়ে ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এরমধ্যে সঞ্চয়পত্রসহ অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধেই ব্যয় হবে ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রাজস্ব আয় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না বাড়ায় এত বিপুল পরিমাণ সুদ ব্যয় বাজেটে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বাজেটের বড় অংশ উন্নয়নখাতে ব্যয় হওয়ার কথা থাকলেও সুদ ব্যয়ের কারণে পরিচালনখাতে ব্যয় বাড়ছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে পরিচালন মুনাফা বাজেটের আকারের তুলনায় কমিয়ে সরকারি ব্যয়ের বড় অংশ উন্নয়নখাতে ব্যয় করার পরিকল্পনা করছেন তারা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে মোট ঘাটতি অর্থায়নের ২৬ শতাংশ বৈদেশিক উৎস থেকে এসেছে, বাকি ৭৪ শতাংশ এসেছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। অভ্যন্তরীণ অর্থায়নের মধ্যে ২৭ শতাংশ এসেছে ব্যাংক থেকে এবং ৪৭ শতাংশ এসেছে ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে, যার মধ্যে সিংহভাগই এসেছে সঞ্চয়পত্র থেকে।
২০১১-১২ অর্থবছর হতে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ঘাটতি অর্থায়নের গড়ে ৩৩ শতাংশ এসেছে সঞ্চয়পত্র থেকে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঘাটতি অর্থায়নের ৪৫ শতাংশ বৈদেশিক উৎস থেকে মেটানো হবে। এতে অভ্যন্তরীণ বাজারে ক্রাউডিং আউট এর ঝূঁকি কমবে।
বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১.৫২ শতাংশ থেকে সর্বনিম্ন ৯.৩০ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের অন্তর্নিহিত গড় সুদহার ছিল ৯.৩ শতাংশ, যা আগামী অর্থবছর ৮ শতাংশে নেমে আসবে। লক্ষমাত্রা অনুযায়ী সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া কমাতে পারলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের সার্বিক সুদহার ৬ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে প্রক্ষেপণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের গড় অন্তর্নিহিত সুদহার ছিল ০.৯ শতাংশ, যা বেড়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১.৭ শতাংশ হবে বলে মনে করছে অর্থমন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকরতারা জানান, সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হলে সঞ্চয়পত্র হতে ঋণগ্রহণ কমিয়েও অভ্যন্তরীণ উৎস হতে সুষম ও কম ব্যয়বহুল ঋণ গ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে।
বাংলাদেশে এ যাবতকালে সবচেয়ে বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় ২০১৬-১৭ অর্থবছর, মোট ৫১,৮০৭ কোটি টাকা। এর পরের দুই অর্থবছরও প্রায় অর্ধ লক্ষ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এতে সরকারের সুদ ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে টিআইএন ব্যবহার বাধ্যতামুলক করা, ৫০ হাজার টাকার বেশি নগদ বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করাসহ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের ডাটাবেইজ প্রণয়ন করে সরকার।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে সরকারের কড়াকড়ি আরোপ ও দেশে করোনা সংক্রমণের কারণে পরের অর্থবছর এ খাতে বিনিয়োগে ধ্বস নামে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৫,১৩৯ কোটি টাকা।
তবে কোভিড সত্ত্বেও পরের অর্থবছর এখাতে বিনিয়োগ বাউন্সব্যাক করে। গত অর্থবছর সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ পৌঁছে ৪৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
মহামারির সময় সরকারের বাড়তি ঋণের চাহিদা কমার সময় এতো বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হওয়ায় সুদ ব্যয় বেড়ে যাওয়ার ঘটনা সরকারকে ভাবিয়ে তুলে। ফলে গত অর্থবছর সব ধরনের সঞ্চয় স্কিমসহ ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ সীমা কমানোসহ সুদহার কমিয়ে নির্ধারণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত এক দশকে সরকারের ঘাটতি অর্থায়নে কিছু পরিবর্তন এসেছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছর হতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক বহির্ভূত উৎস হতে সরকারের ঋণগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিক্রি কিছুটা বাড়লেও বড় বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে সুদহার ১-২ পারসেনটেজ পয়েন্ট কমানোসহ প্রশাসনিক বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে চলতি অর্থবছর বিনিয়োগ কমবে।
অন্যদিকে, মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নে অগ্রগতি হওয়ায় গত অর্থবছর ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক ঋণের অংশ বেড়ে ৩৬.৮ শতাংশ এ উন্নীত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, "সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা সহজ করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে সঞ্চয়ী হতে উৎসাহ দিতে সঞ্চয়পত্র চালু করেছিল সরকার। সঞ্চয়পত্রে সাম্প্রতিক সময়ে এমনিতেই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। নতুন করে এ বিষয়ে আরও কোন কঠোরতা আরোপ করলে মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা কমে আসবে।"
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, "হাতে সঞ্চয় থাকলে যেকোনো বড় ধরনের বিপর্যয়ে লোকজন তা থেকে ব্যয় করতে পারেন। আর সঞ্চয় না থাকলে সরকারকেই সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হয়। এসব দিক বিবেচনায় সঞ্চয়পত্রের বড় ভূমিকা রয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "ব্যাংকিং খাতে ঋণের হার অনেক কম। অব্যবস্থাপনার কারণে পূঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে অনেকেই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। আবার সরল মানুষদের অনেক টাকা প্রতারক কোম্পানির হাতে চলে যাচ্ছে। সঞ্চয়পত্র ব্যবস্থা আরও সঙ্কুচিত হলে এসব মানুষের টাকা রাখার যায়গাও কমে আসবে।"
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ কয়েক বছর আগে মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক অটোমেশানের আওতায় আনা ও সুদের হার কমানো ও সময়ে সঞ্চয়পত্র কেনায় সীমা বেধে দেওয়ায় এ খাতে সরকারের ঋণ বেড়েছে। এ অবস্থায় সঞ্চয়পত্রের ঋণ কমাতে আগামীতে সুদের হার আর কমানো যৌক্তিক হবে না।
তিনি আরও বলেন, "মধ্যবিত্ত শ্রেণির বড় একটা অংশ সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর নির্ভরশীল। কিছু টাকা থাকলেও ব্যবসা করার সামর্থ তাদের নেই। আমানতের সুদের হারের চাইতে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি বেশি থাকায় ব্যাংকে টাকা রাখলেও সুদসহ পাওয়া অর্থের প্রকৃত মূল্য কমে যায়। এ অবস্থায় মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রা ঠিক রাখতে সঞ্চয়পত্রে বড় ধরনের কড়াকড়ি আরোপ না করার সুপারিশ করেন তিনি।
সুদের হার কম থাকলেও বিদেশি উৎস থেকে ঋণ করে সরকারের প্রয়োজন সামাল দেওয়া আগামীতে কঠিন হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, "পাইপলাইনে ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি পড়ে থাকলেও প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতায় এ অর্থ ছাড় হচ্ছে না।"
আগামীতে বিশ্বব্যাংকের বাণিজ্যিক ঋণের উইন্ডো ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইবিআরডি) থেকে ঋণ নিতে হবে বাড়তি সুদে। তাছাড়া স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পর বিদেশি অনুদান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সুদের হার বাড়বে। আগামীতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় এসব বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার তাগিদ দেন তিনি।