উদীয়মান ৮ খাতের জন্য সুফল বয়ে আনবে করপোরেট কর ছাড়: উদ্যোক্তা
দেশের উদীয়মান রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য সমান কর সুবিধা নির্ধারণ অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনবে বলে মন্তব্য করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
গার্মেন্টস শিল্পের মতো, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে গৃহস্থালির বস্ত্র, চামড়াজাত পণ্য, পাট এবং কৃষি শিল্প থেকে রপ্তানি আয় ১ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে।
এছাড়া, ২০-২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ভালো করছে দেশের আইটি ও ফার্মাসিউটিক্যালস শিল্পও। সম্ভাবনাময় খাত হিসাবে বৈশ্বিক বাজারে চাহিদা তৈরি হয়েছে প্লাস্টিক, খেলনা, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো খাতেও।
করপোরেট কর ছাড়ের ফলে এ শিল্পগুলো ভালো করবে বলে মনে করছেন তারা ।
ঢাকা চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. রিজওয়ান রহমান বলেন, "সব খাতকে সমান সুবিধা দেওয়ার দাবি আমাদের অনেক দিনের। শুধু করপোরেট কর নয়, বন্ডসহ সবক্ষেত্রে সমান সুবিধা দিলে গার্মেন্টসের মতোই বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আনতে সক্ষম হবে ৭-৮টি খাত।"
প্রস্তাবিত বাজেটে সব ধরনের রপ্তানি খাতকে উৎসাহিত করে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশে তৈরি পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে তৈরি পোশাকের মত রপ্তানিমুখী অন্য কোম্পানির করহারও ১২ শতাংশ করা হয়েছে।
আর কারখানা পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা হলে করপোরেট করে আরও ছাড় মিলবে, দিতে হবে ১০ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য শামস উদ্দিন আহমেদ বলেন, "তৈরি পোশাকের বিদ্যমান প্রযোজ্য করহার এর ক্ষেত্রে সাধারণ ফ্যাক্টরির জন্য ১২ শতাংশ এবং গ্রিন ফ্যাক্টরির জন্য ১০ শতাংশ করহার এর বিধান প্রচলিত রয়েছে। নতুন বাজেট অনুযায়ী, কোম্পানিগুলো তাদের রপ্তানি আয়ের ওপর যে কর দেন তাতে ছাড় পাবেন। এ অর্থ তারা নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারবেন।"
তবে রপ্তানিতে উৎসে কর দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ করায় লোকসানের আশঙ্কা করছেন বেশ কয়েকটি খাতের উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলছেন, সরকার করপোরেট করে ছাড় দিয়েছে। তবে উৎসে কর বাড়ানোর কারণে বিপাকে পড়বেন রপ্তানিকারকরা।
তিনি বলেন, "উৎসে কর ১ শতাংশ হওয়ায় লোকসানে পড়বে অধিকাংশ খাত। লোকসানি কোম্পানির করপোরেট কর ছাড়ে কোনো সুবিধা হয় না। তবে বড় রপ্তানিকারকারা তৈরি পোশাকের মতো এ সুবিধায় করের টাকা বিনিয়োগে যেতে পারবেন।"
দেশের রপ্তানি খাতের আটটি উঠতি খাতের মধ্যে একটি লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং। দেশে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার শিল্প গড়ে উঠলেও প্রণোদনার অভাবে রপ্তানিতে ভালো করেনি। এক সময় ৬০০ মিলিয়নের বেশি রপ্তানি আয় করলেও এখন তা নেমে গেছে ৫০০ কোটির নিচে। উৎস কর বাড়ার কারণে এ শিল্প আরো বেশি বিপাকে পড়বে বলে মনে করছেন উদ্যেক্তারা।
কোনো শর্ত ছাড়া রপ্তানি আয়ের ওপর করপোরেট করহার কমালে তা ওষুধ শিল্পের বিকাশে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সেক্রেটারি এস এম শফিউজ্জামান।
তিনি বলেন, "প্রায় ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে গত বছরও ১৮০০ কোটি টাকার ওষুধ রপ্তানি করেছে দেশের ৫৩টি কোম্পানি। বিশ্বের প্রায় ১৪২টির মতো দেশে আমাদের ওষুধ রপ্তানি হয়। করপোরেট কর ছাড়ের এ সুযোগ বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের বিকাশ আরো বাড়াবে।"
বর্তমানে বেক্সিম, এসকেএফ, ইনসেপ্টা, এসিআই, স্কয়ার আমেরিকার বাজারেও বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি করছে। দেশ ছাড়িয়ে আফ্রিকা ও আমেরিকায় কারখানাও করছে স্কয়ার, এসিআই।
করপোরেট কর ছাড়ের কারণে বেঁচে যাওয়া অর্থ নতুন করে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হবে বলে উল্লেখ করছেন এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
বেশি সম্ভাবনা কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণে
করোনা মহামারির মধ্যে গত অর্থবছরে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের মাইলফলক অতিক্রম করেছে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাত। চলতি অর্থবছরেও প্রথম দশ মাসেই ১ বিলিয়ন ছাড়িয়ে রেকর্ডের অপেক্ষায় আছে এ খাত।
করপোরেট করে ছাড়ের ফলে এ খাতের উদ্যোক্তারা আরো বেশি উৎসাহিত হবেন বলে মনে করছেন দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক প্রাণ-আরএফল গ্রুপের পরিচালক (মার্কেটিং) কামরুজ্জামান কামাল।
৪০০ মিলিয়নের বেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানটির এই পরিচালক বলেন, "কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প দেশের অর্থনীতিতে এরই মধ্যে শক্ত একটি জায়গা তৈরি করে ফেলেছে। এছাড়া দেশের হয়ে রপ্তানির অন্যতম খাত হয়ে ওঠা এ শিল্প বিশ্ব দরবারেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। এ খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশের 'প্রাণ'। আমরা এখন বিশ্বের ১৪৫টি দেশে রপ্তানি করছি।"
করপোরেট করে ছাড়ের ফলে এসিআই, স্কয়ার, আকিজের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি ছোট ছোট উদ্যোক্তারাও বড় হতে পারবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জুতা ও পাটে ১ শতাংশ উৎসে করের শঙ্কা
বৈশ্বিক পাটের যোগানদাতা হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশের তৃতীয় বৃহৎ রপ্তানি খাতও এই পাট। ১.১৬ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করলেও নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরেই নিভু নিভু করছে এ খাতটি।
এ খাতের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান লোকসানে থাকায় করপোরেট কর ছাড়ের সুবিধা তাদের খুব বেশি কাজে আসবে না বলে মন্তব্য করছেন পাট ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ জুট এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, দেশের ৯৫ শতাংশ পাট রপ্তানিকারক লোকসানে। ৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান মুনাফায় থাকলেও খুব সামান্য আয় তাদের। ফলে করপোরেট করে ছাড় দেওয়ার চেয়ে পাটের জন্য একটা নীতিমালা করে শিল্প উদ্যোক্তাদের স্থায়ী প্রণোদনা দেওয়া দরকার।"
তিনি বলেন, ইলেকট্রিসিটি, গ্যাসসহ ইউটিলিটি খরচ যেহারে বেড়েছে সে তুলনায় পণ্যের দাম বাড়েনি। ফলে কারো জন্যই এখন ব্যবসা করা সম্ভব হচ্ছে না।
রপ্তানিতে ১ শতাংশ উৎসে করারোপের কারণে জুতা রপ্তানিকারকদের জন্য করপোরেট করছাড় কাজে আসবে না, বলছেন দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক এপেক্স ফুটওয়্যারের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর দিলীপ কাজুরি।
তিনি বলেন, "বর্তমানে দশমিক ৫ শতাংশ উৎসে কর দিতেই আমাদের মোট মুনাফার ৭০ শতাংশের সমান অর্থ চলে যায়। এই উৎসে কর ১ শতাংশ পরিশোধ করলে আমাদের মুনাফাই থাকবে না। ফলে করপোরেট করে ছাড় দেওয়া না দেওয়া আমাদের জন্য কোনো খবর নয়।"