মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীরাও কি স্বপ্ন দেখে?
যাদের পোষা প্রাণী আছে তারা হয়তো খেয়াল করেছেন ঘুমের সময় আপনার প্রিয় পোষ্যটি কিছুটা অদ্ভুত ব্যবহার করে। পা নাড়াচাড়া, চোখের পাতা নাড়ানো থেকে শুরু করে মাঝেমধ্যে শব্দও করতে শোনা যায়। অধিকাংশ মানুষই ভাবেন তারা হয়তো স্বপ্ন দেখছে।
কিন্তু কী স্বপ্ন দেখে তারা? এটা নিয়েও রয়েছে নানা জল্পনা কল্পনা। অনেকে ভাবেন, তারা হয়তো সবুজ মাঠে কাঠবিড়ালির পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে কিংবা হয়তো নিজেরাই শেয়ালের দলের তাড়া খেয়েছে।
তবে এত জল্পনা থাকা সত্ত্বেও মানুষের বাইরে অন্যান্য প্রাণীরা আসলেই স্বপ্ন দেখে কি না, তা নিয়ে খুব বেশি বৈজ্ঞানিক গবেষণা নেই।
প্রাণীরা যেহেতু তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে পারে না, তাই বিজ্ঞানীরা তাদের অচেতন অবস্থার প্রকৃতি নিয়ে সাবধানতার সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ও দার্শনিক ডেভিড পেনা-গুজম্যান।
'হোয়েন অ্যানিমেলস ড্রিম: দ্য হিডেন ওয়ার্ল্ড অব অ্যানিমেল কনশাসনেস' নামের নতুন এক বইতে পেনা গুজম্যান লিখেছেন মানুষের বাইরে অন্যান্য প্রাণীদের স্বপ্ন দেখার যথেষ্ট প্রমাণাদি আছে। কিন্তু প্রাণীদের স্বপ্ন কেমন? তারা কি মানুষের মতোই স্বপ্ন দেখে?
এই আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রাণীদের স্বপ্ন নিয়ে গবেষণাগুলোর প্রসঙ্গে জানা যাক। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয়টি হলো প্রাণীদের স্বপ্ন দেখা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের প্রথম গবেষণাটি জার্নাল অব কম্পারেটিভ নিউরোলজিতে মাত্র ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে। 'ডু অল ম্যামালস ড্রিম?' শীর্ষক গবেষণাটিতে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথমবারের মতো মানুষ ব্যতীত অন্যান্য প্রাণীর 'স্বপ্ন' বা 'স্বপ্ন দেখা'র মতো বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়।
পেনা গুজম্যান বলেন, "আমার বই প্রিন্টে থাকার সময়ই দ্বিতীয় একটি গবেষণা মাত্র কয়েকমাস আগেই প্রকাশিত হয়েছে। মানুষ সবে বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা শুরু করেছে।"
তবে মানুষ এর আগেও এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করেছে বলে জানান তিনি। চার্লস ডারউইন ১৮৭১ সালে প্রকাশিত 'দ্য ডিসেন্ট অব ম্যান' বইটিতে প্রাণীদের স্বপ্ন দেখার বিষয়টি উল্লেখ করেন। ডারউইন বিশ্বাস করতেন স্বপ্নের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়াটা মানুব জাতির একক কোন ক্ষমতা বা বৈশিষ্ট্য নয়।
১৯ শতকের শুরুতে ডারউইন ছাড়াও অন্যান্য অনেক বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরাই এ প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের স্লিপ সাইকেলের মিল থাকার কারণেই ধারণা করা হতো প্রাণীরাও ঘুমিয়ে পড়লে তাদের নিজস্ব কল্পনার জগতে হারিয়ে যায়। তারা কী দেখে তা জানা না গেলেও, তারা যে স্বপ্ন দেখে এটা ভাবাটা যথেষ্ট যুক্তিসংগত বলেই মনে করেন পেনা গুজম্যান।
তিনি জানান বিংশ শতাব্দীতে এসে হঠাৎ করেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এই 'সুপ্ত সময়ে' গবেষকরা সরাসরি 'স্বপ্ন' শব্দটি এড়িয়ে গেলেও মানুষ ব্যতীত অন্যান্য প্রাণীরা ঘুমিয়ে পড়লে কী ঘটে- সেই প্রশ্নের অনুসন্ধান শুরু করেন।
স্বপ্নের পরিবর্তে তারা ল্যাবরেটরিতে ঘুমন্ত প্রাণীদের বিভিন্ন শারীরিক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও লিপিবদ্ধ করেন। কিন্তু ওই মুহূর্তে প্রাণীদের মগজে কী চলে? ইইজি মনিটরিং-এর মাধ্যমে তাদের ব্রেইনের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করলে কী পাওয়া যায়?
গুজম্যান বলেন, "মানুষের ক্ষেত্রে স্বপ্নে সাবজেক্টিভিটি বা নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্লেষণ করা ছাড়াও আচরণগত ও নিউরোসায়েন্টিফিক গবেষণার মাধ্যমেও স্বপ্ন নিয়ে পর্যালোচনা হয়। এই ইন্ডিকেটরগুলো প্রাণীদের ওপরেও প্রয়োগ করা যায়।"
'হোয়েন অ্যানিমেলস ড্রিম' বইয়ে গুজম্যান প্রাণীদের ঘুমের ওপর বিভিন্ন গবেষণা বিশ্লেষণ করে প্রাণীদের স্বপ্ন দেখার বিষয়টি সমর্থন করেছেন।
প্রাণীরা যে স্বপ্নই দেখছে, তা কীভাবে নিশ্চিত হলেন, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, পেকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা প্রাণীদের দুঃস্বপ্ন দেখা নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশ করে। সেই গবেষণার ভিত্তিতেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছি।
গবেষকরা ইঁদুরের দুটি দলের ওপর ট্রমা বা মানসিক আঘাতের বিষয়টি পর্যালোচনা করেন। একটি দলের ইঁদুরগুলোর পায়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। তবে তাদের শারীরিকভাবে কোনো ক্ষতি করা হয়নি। অন্য একটি দলকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে প্রথম দলকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার দৃশ্যটি দেখানো হয়।
সবচেয়ে মজার বিষয়টি হলো দুটি দলকেই দুঃস্বপ্নের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মানুষ যেমন দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেলে ক্রমাগত দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকে, ইঁদুরগুলোও সেভাবেই দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু করে যার কারণে তাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে।
"ইঁদুরগুলো ঘুমের রেম (র্যাপিড আই মুভমেন্ট) পর্যায়ে যাওয়ার পর তাদের মধ্যে আতঙ্ক ও প্যানিক করার প্রবণতা দেখা যায়। মনিটরিংয়ে সবগুলো ইন্ডিকেটরই দেখায় যে ঘুমন্ত অবস্থায় ইঁদুরগুলো তীব্র মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে," বলেন তিনি।
"এই জিনিসটাই আমি বিভিন্ন গবেষণায় দেখেছি। স্লিপ সাইকেলের নির্দিষ্ট পর্যায়ে অসংখ্য প্রাণী মানসিক পরিবর্তনকালীন অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়। সাধারণত ঘুমিয়ে পড়লে হৃদস্পন্দন ও শ্বাসপ্রশ্বাস ধীর হয়ে আসে। কিন্তু ঘুমের মধ্যে মানসিক স্থিতির পরিবর্তন হলে হঠাৎ করেই হৃদস্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাস ও রক্তচাপ বেড়ে যায়।"
এমনকি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে তাদের মুখায়বের পরিবর্তন এমনকি কষ্টের অভিব্যক্তিও প্রকাশ পায়। এই পরিবর্তনগুলো কোনো আবেগীয় পরিবর্তন আসা ছাড়া সম্ভব নয় বলেই মনে করেন গুজম্যান।
কিন্তু প্রাণীরা কী স্বপ্ন দেখে সেটা কি কখনো জানা সম্ভব হবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে গুজম্যান বলেন, "প্রাণীরা কী দেখছে সেটা যে আমরা কখনোই জানতে পারব না, এমন নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বপ্নে তারা কী ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কেও আন্দাজ করা যায়।"
"যেমন পাখির ক্ষেত্রে ব্রেইনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে জানা যায় স্বপ্নের ঠিক কোন মুহূর্তে তারা কোন সুরে গান গাইছে। জেগে থাকার সময় বিভিন্ন সুরে গান গাওয়ার সময় তাদের ব্রেইনের কার্যক্রমের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ার পর ব্রেইন কার্যক্রম মেলানোর মাধ্যেম খুব সহজেই তা বের করা সম্ভব," বলেন তিনি।
সূত্র: ভাইস ডট কম