গালিতে রাগের প্রকাশ, গালিতে প্রেম ছড়ায়!
১.
শুরুটা হতে পারে ছড়াতেই:
'কচু' বরণ 'ভুতপেত' নানা বরণ কেশ
হাজার রকম কেশের ঢাকায় লুকিয়ে থাকে দেশ
ফাঁকা মাথায় নকল কেশের অনেক 'কেশব রাজ'
শাদা কেশে কালি দিয়া 'যইবন' ধরাই কাজ
কেশের কথাই সেরা কথা সবচেয়ে নিরাপদ
কেশে কেশে গিটঠু দিলে বাড়বে বিপদ
কেশ নিয়ে কইছে কথা হেসে কিংবা কেশে
কেশকে উর্দু-হিন্দি করলে কাণ্ড সর্বনেশে। ('ভুত' যায়, 'ভুত' আসে )
অর্থাৎ সবচেয়ে নিরীহ এবং নির্জীব কেশকে ভাষান্তর করলে তা গালি হয়ে যায়। এ গালি বা স্ল্যাং বাংলাভাষী সমাজের প্রায় সবস্তরেই বহুল ব্যবহৃত। বাংলাদেশে লোকমুখে প্রচলিত বচনকে একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, এক ভাষার বুলি অন্য ভাষার গালি হওয়ার বিষয়ই এতে প্রমাণিত হচ্ছে। একই ভাবে, বাংলাভাষায় 'সুস্বাদু' শব্দ ক্ষীর ফার্সিতে 'শিশ্ন' অর্থ ধারণ করে ভদ্র সমাজে অনুচ্চারিত 'স্ল্যাং'এ রূপ নিয়েছে। অতএব এখানে স্মরণ করি লালন ফকিরকে—"এক দেশে যা পাপ গণ্য অন্য দেশে পূণ্য তাই , পাপ পূণ্যের কথা আমি কারে বা সুধাই।"
নিজের শালাকে শালা সম্বোধন করে মানহানির মামলায় পড়েছেন। এমন ঘটনা আমাদের সরস উপস্থাপন করেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। লেখকের পিতা ছিলেন অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট। বিবাদীর বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বাদী আদালতে বলেন, হুজুর স্বাভাবিক স্বরে শালা বলেনি। চোখ গরম করে চড়া গলায় বলেছে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এ কথা শুনে রুদ্র মূর্তি ধারণ করলে বাদী-বিবাদী উভয়ই এজলাস ছেড়ে পালিয়ে বাঁচেন।
গালি অভিধান নামের নিজ বইয়ের ভূমিকায় আবদুল মান্নান স্বপন বলেন, মানুষ প্রাত্যহিক কথনে যেমন স্বাভাবিকভাবে শব্দ, শব্দগুচ্ছ ও বাক্য ব্যবহার করে তেমনি ক্রোধ-ক্ষোভে প্রতিপক্ষের উপর রাগ প্রকাশের জন্য শব্দকে বিকৃত করে ভিন্ন ধরণের শব্দ-বাক্য ব্যবহার করে। সে শব্দকে অশ্লীল শব্দ, ইতর শব্দ, গালি, বদকথা, বদবুলি, অকথ্যভাষা, জনবুলি, অপভাষা ইত্যাদি নানা অভিধায় ভাষাবিদগণ অভিহিত করেছেন। তবে শব্দগুলো বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। অর্থাৎ যে শব্দটি ংষধহম হিসাবে পরিচিত তার একটি যথার্থ প্রতিশব্দের আজও সন্ধান মেলেনি। এখানে লক্ষ করলে গালি শব্দটির সাথে অন্যান্য শব্দের পার্থক্য সহজেই অনুমেয়। গালি মূলত ংবহংব কেন্দ্রিক। গালিতে সব সময় অশ্লীল শব্দ নাও থাকতে পারে। একজন ক্ষুব্ধ মানুষ যখন ভাষার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে এবং বিপক্ষও ক্ষুব্ধ হয়ে তখনই সে ভাষা বা শব্দ গালি রূপে গণ্য হয়।
বাংলা স্ল্যাং নিয়ে গবেষণাধর্মী উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ অভ্র বসুর 'বাংলা ভাষা স্ল্যাং: সমীক্ষা ও অভিধান।' এ বইতে অভ্র বসুও বলেন, ...স্ল্যাং শব্দভাণ্ডারে এমন অনেক শব্দ থাকতে পারে, যেগুলি (প্রতিমভাষার) মান্যভাষার (ংঃধহফধৎফ ষধহমঁধমব) অন্তর্গত। বাচনভঙ্গি বা স্বরভঙ্গির বিশিষ্টতা অথবা বিশেষ প্রসঙ্গে ব্যবহারের কারণে সেগুলি স্ল্যাং হয়ে উঠতে পারে। বস্তুত, বাচনভঙ্গি বা স্বরভঙ্গির বিশিষ্টতা, প্রসঙ্গ বা পড়হঃবীঃ ইত্যাদি বিষয়গুলি স্ল্যাং-এর ক্ষেত্রে এত গুরুত্বপূর্ণ যে স্ল্যাং-কে একটি শব্দভাণ্ডার বা াড়পধনঁষৎু বলা যায় কিনা সে বিষয়ে আমাদের মনে যথেষ্ট সংশয় আছে। আমরা স্ল্যাংকে একটি বিশিষ্ট বাক্রীতি বা বাগ্ভঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। কিংবা ক্ষেত্রটাকে আরেকটু বড়ো করে বলতে পারি, বাক্রীতি-নির্ভর শব্দভাণ্ডার।
এখানে এ বক্তব্যের উদাহরণ হতে পারে মুজতবা আলীর শালা কাহিনি।
অভ্র বসুর পুস্তকটি কোলকাতা কেন্দ্রিক। অন্য দিকে আবদুল মান্নান স্বপন সম্পাদিত গালি অভিধান বাংলাদেশের ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হলেও তাতে ভারতীয় বাংলাভাষী বা বাংলা প্রভাবিত রাজ্যগুলোর স্ল্যাং বা গালি স্থান করে নিয়েছে। অভ্র বসু নিজ পুস্তকের ভূমিকায় স্বীকার করেন, বাংলাভাষায় স্ল্যাং বিষয়ক গবেষণা বিশেষ হয়নি। স্ল্যাং সম্পর্কিত ধারণাও বাংলায় খুব স্পষ্ট নয়। সাধারণত স্ল্যাং বলতে অশ্লীল বা অশিষ্ট শব্দকেই বোঝানো হয়ে থাকে। অশ্লীল বা অশিষ্ট শব্দ স্ল্যাং নিশ্চয়ই, কিন্তু তা স্ল্যাং-এর একটা অংশমাত্র। অশ্লীল ছাড়াও স্ল্যাং-এর বিচিত্র ধরণ রয়েছে সে কথা তিনি ব্যক্ত করেন।
অভ্র বসু বলেন, বাংলা স্ল্যাং বলতে ঠিক কী বুঝেছি, সেটা এই সূত্রে স্পষ্ট করা প্রয়োজন। কোনও ভাষার স্ল্যাং-এর বিষয়টিকে দেখবার অনেক দৃষ্টিকোণ থাকতে পারে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে স্ল্যাং আলাদা হয়ে যায় এ কথা উল্লেখ করে অভ্র বসু আরও জানান যে শহুরে মানুষ এবং অশিক্ষিত গ্রাম্য মানুষের স্ল্যাং এক নয়। একই ভাবে এক নয় নারী ও পুরুষের স্ল্যাং। পাশাপাশি সময়ের পরিবর্তনের পাশাপাশি স্ল্যাং-এর চরিত্রও বদলে যায়। তিনি শিষ্টভাষীদের ব্যবহৃত স্ল্যাংকেই নিজ গবেষণার লক্ষ্য বলে উল্লেখ করেন। উপভাষিক বা আঞ্চলিক স্ল্যাং, গ্রাম্য স্ল্যাং, পেশাগত স্ল্যাং ইত্যাদিকে আলোচনার বাইরে রাখার কথাও স্বীকার করেছেন তিনি। এ ছাড়া, স্ল্যাং-এর শব্দভাণ্ডার পরিবর্তনশীল এবং বর্ধমান বলে জানান তিনি। স্ল্যাং ব্যবহারে কারণ ব্যাখ্যা করতে যেয়ে অভ্র বসু জানান, ভাষার নতুনত্ব সৃষ্টি করা স্ল্যাং ব্যবহারের অন্যতম একটি কারণ। স্ল্যাং-এর পরিভাষা কী হতে পারে তা নিয়েও আলোচনা করেন অভ্র বসু। তবে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। স্ল্যাং শব্দে গোটা বিষয় ধারণ করা সম্ভব হয়নি। এ কথা স্বীকার করেন।
একই ভাবে স্ল্যাং-এর পরিভাষা হিশেবে গালিকে গ্রহণ করা হলেও তাতেও পুরো বিষয় ধারণ করা সম্ভব হবে না। সে কথাও জোর দিয়েই বলা যায়।
গালি অভিধানের আইডিয়া কি ভাবে মাথায় এলো সে কথা বলতে যেয়ে আবদুল মান্নান স্বপন জানান, 'ধমনি' সাহিত্য পত্রিকার গালি সংখ্যা প্রকাশকালে গালি অভিধান করার আইডিয়া মাথায় আসে। ধমনির গালি সংখ্যায় বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার বাংলা ভাষাভাষীদের গালির শব্দ, কলকাতার বাংলা ভাষাভাষীদের গালির শব্দ, আসামের বাংলা ভাষাভাষীদের গালির শব্দ, ত্রিপুরার বাংলা ভাষাভাষীদের গালির শব্দ এবং বাংলাদেশের আদিবাসিদের ১১টি গোত্রের গালির শব্দ নিয়ে পৃথক পৃথক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় উল্লেখ করে তিনি আরও জানান, সে সব প্রবন্ধে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিত্বমূলক কিছু গালির শব্দ থাকে। প্রয়োগকৃত বাক্য দেখাতে না পারার কারণে আসাম ও ত্রিপুরার গালির শব্দ অভিধানটিতে পৃথক ভাবে দেখানো হয়নি বলেও জানান তিনি। তবে প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের যেসব গ্রন্থে গালি ব্যবহৃত তার প্রয়োগ সংশ্লিষ্ট গালির শীর্ষ শব্দের সাথে এ অভিধানে দেখান হয়েছে।
'ভাত দে হারামজাদা..', 'রক্ত দিয়ে পেলাম শালার মরার স্বাধীনতা' কিংবা 'সব শালা কবি হতে চায়'-এর মতো কবিতা বা ছড়ার চরণ থেকে যদি মনে করা হয় গালাগালি কেবল আধুনিক সাহিত্যের চল তা হলে ভুল হবে। কাজী নজরুল ইসলামের 'কিলের চোটে হাড় করিব জল'-এর কথা স্মরণ করুন। কিংবা প্রাচীন সাহিত্যেও গালির শব্দাবলী ব্যবহারের নজির রয়েছে। সপ্তদশ শতকে আলাউলও গালির প্রয়োগ করেছেন।
'গালি কখনই ভাষার সৌন্দর্য নষ্ট করে না বরং তা আরও চিত্রবহুল করে তোলে। ভাষাকে ক্ষেত্রবিশেষ করে তোলে প্রাণবন্ত-সজীব। গালি না থাকলে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হত তা হলো, মানুষে মানুষে দৈহিক হাঙ্গামা বেড়ে যেত বহুগুণে। মানুষ ভাষা বা অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে রাগ মেটাতে না পেরে একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। হারামখোর, হারামীর বাচ্চা বলে যে কাজটি অনায়াসে হয়ে যায়, সেই কাজটি হতে লাঠি চালাচালি হত। বিশৃঙ্খলা বেড়ে যেত কয়েকগুণে।'
২.
না। এরপরও না। গালাগালি মোটেও ভাল না। কিন্তু এ সব জেনেও আমরা দুঃখে-সুখে গালাগালি দেই। জিনিস কিনে বাসায় এসে যখন দেখলেন ঠকে গেছেন তখন অনুপস্থিত দোকানদারকে লক্ষ্য করে নিদেন পক্ষে 'শালা' বলেন—এমন মানুষ সত্যিই বিরল। অন্যদিকে ন্যাংটাকালের বন্ধুকে দীর্ঘদিন পরে হঠাৎ দেখে মুখ ফসকে যে শব্দ বের হয়ে আসে তাও ওই 'শালা'। তবে এটি তখন গালি নয় পরমানন্দের প্রতীক। সেও হয়ত একই শব্দ উচ্চারণ করে আপনার প্রতি। কিন্তু কেউ এতে মনঃক্ষুণ্ণ হয় না।
মা-নানীর মুখে শুনেছি। আমার মামাকে ছোট বেলায় পড়তে দেয়া হলো, চলো আমরা পাঠশালায় যাই। মামা শুনে চেতে উঠলেন। -এমন বাজে কথা লেখা আছে যে বইতে সে বইই পড়বো না। শেষমেশে ওই পাঠশালা কেটে স্কুল করে দেয়া হয়েছিল।
চাঁদপুর লেডি প্রতিমা গার্লস হাইস্কুলের ঘটনাও এখানে টেনে আনা যায়। ষাটের দশকে স্কুলটির ঝি'দের অন্যতম ছিলেন সুন্দরীদি। বয়সকালে তিনি যে সুন্দরী ছিলেন তা বুঝতে কারোই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তার স্বামী যতীন্দ্রদা। এই দম্পতির টিনের চাল ও বাঁশের বেড়ার ঘর ছিল স্কুলের প্রধান ফটকের কাছে, সীমানার ভেতরে। যতীন্দ্রদা চিনা বাদাম বিক্রি করতেন। আর তার মুখে বুলি ছিল, হারামজাদা, হারামজাদি। সবাইকেই তিনি এ বুলি প্রয়োগ করতেন। তাতে কেউ কিছু 'মাইন্ড' করত না। কিন্তু হঠাৎ এক ভিন্ন ঘটনা ঘটল। ফুটফুটে পুতুলের মতো নিচের ক্লাসের এক মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে গেল ডাক সাইটে হেডমিসট্রেস মণিকা মজুমদারের অফিসে। যতীন্দ্রদা তাকে অসভ্য কথা বলেছে। মেয়েটি ছুটে সেখানে গেছে অভিযোগ জানাতে। জানা গেল, হারামজাদি না বলে যতীন্দ্রদা তাকে বলেছে, লক্ষীসোনা একটু দেরি করো আগের মাইয়্যাগুলোরে বাদাম দেওয়া শেষ কইর্যা তোমারে বাদাম দিতাছি। আমাকে হারামজাদি ক্যান কয় নাই যতীন্দ্রদা। এবারে গলা ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে নালিশে ফেটে পড়ল মেয়েটি।
অর্থাৎ যতীন্দ্রদা হারামজাদির বদলে লক্ষীসোনা বলেছে সেটাই হয়েছে তার সর্বনাশ। প্রয়োগের কারণে প্রমিত শব্দও গালি হয়ে উঠতে পারে- মর্মবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
দু'বন্ধুতে কয়েক দশক বা বহুদিন পর দেখা হলে দেদার গালাগালি চলে। ঘটেছে এমন কাণ্ড এ জীবনে। ঢাকায় জিপিও'র কাছে দূর থেকে দেখতে পেলাম সেই স্কুল জীবনের এক বন্ধু। কোনও দিকে না থাকিয়ে হাঁটছে। চুল কমেছে। বা কপাল বড় হয়েছে। মধ্যপ্রদেশের বহর বেড়েছে। চেহারা-সুরতে রাশভারী হয়েছে। চলায় ব্যক্তিত্বের ভাবও অতিপ্রকট।
কিন্তু তারপরও স্কুলজীবনের চেহারাকে পুরোপুরি বদলাতে পারেনি 'ছাগলটা।' অতএব তাকে চিনতেও দেরি হল না। -ওই শালা ছাগল কই যাস! নিজে যে কখন রাসভ স্বরে চিৎকার জুড়েছি বুঝতেই পারলাম না। আর এ স্বর জীবনে যে একবার শুনেছে তার ভোলার কথা নয়। সেও ঘুরে দাঁড়াল। বহু বছর ধরে যে সব ভাব-সাব অর্জন করেছে তা দ্বিধাহীন চিত্তে তখনি বিদায় করে দিয়ে বলল- আরে হারামজাদা পাঠা তুই এখনও মরস নাই।
দু'জনেই পরস্পরের দিকে তির বেগে ছুটতে শুরু করলাম। একই সঙ্গে চলল গালাগালির বৃষ্টি। -ওই কুত্তার বাচ্চা আমি মরুম কেন তুই মর। পাল্টা জবাব এলো-শুয়ারের বাচ্চা তোর জিভ গোড়া থেকে ছিঁড়া আইন্যা জুতার তলা বানামু।
সোডার বোতল খুললে 'কেমন' ফসফসিয়ে রাগ করে' তেমনি করে দু'পক্ষের মুখে থেকে ঝরছিল গালিবৃষ্টি। আশেপাশের লোকজন সতর্ক হয়ে উঠল। এই বোধহয় লাগল জং! মারাত্মক মারপিট! হাতের নাগালের মধ্যে আসতেই দু'জন দু'জনকে জড়িয়ে ধরল।
-শালা ছিলি কই, স্কুল ছাড়ার পর তোর একটা লোমও দেখতে পাই নাই।
-তুই শালাও কোথায় ভাইগ্যা আছিলি এ্যাতদিন। কোন কান্দুপট্টি বা টানবাজার নাকি বাঞ্চারামপুরের কোন ঘাটে বাসা বানাইছস।
পাশের এক মহিলা ফোঁস করে স্বস্তির শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বললেন- ভাইরে আপনারা স্কুল জীবনে কি যে আকাম-কুকাম করে আইছেন কে জানে। কিন্তু পরম বন্ধু ছিলেন সে কথা জোর দিয়া কইতে পারি।
- স্কুল জীবনের সব বন্ধুর সঙ্গে আমাদের এমনই মাখামাখি। দু'জনেই প্রায় একত্রে বলে উঠলাম। গালাগালি যে এখানে একধরনের গলাগলিই হয়ে উঠেছে, সে কথা বোধহয় বলার দরকার নেই।
তবে সবসময় তা হয় না। হয় না বলেই এটা গালাগালি। গালাগালি সার্বজনীনও নয়। ধরুন, কোনও ইরানিকে শালা বললে সে বুঝতেই পারবে না কি বলা হলও। বুঝবে না ইংরেজও। কিংবা কোনও ইরানিকে বুড়া আঙ্গুল দেখিয়ে যদি বলি, দুস শালা কাঁচকলা খা! সে হয়ত খুশিই হবে। কারণ ইরানে দামি ফলের গোত্রে পড়েছে কলা। বুড়া আঙ্গুল দেখানো তো দুনিয়াজুড়ে এখন 'ওকে'র সমার্থক হয়ে গেছে।
রাজশাহীতে 'মামুর ব্যাটা' বলে একটা গাল দেয়া হয়। 'মামুর ব্যাটা'র মতো নিরীহ শব্দও যে গালাগালি হতে পারে এটা অন্য জেলার লোকজন হয়ত বুঝবে না। এদিকে বরিশালে কোনও মহিলাকে 'মাতারি' বা কোনও লোককে 'ব্যাটা' বলায় হয়ত দোষ নেই। কিন্তু অন্য অনেক জায়গায় শব্দদ্বয় ব্যবহার করলে খবর আছে।
ছোট বেলায় চাঁদপুরে 'বুড়ির নাতি' বলে গালাগালি করতে শুনেছি। তুলনামূলক ভাবে বুড়ি না হলে তো আর নাতি হয় না! এর মধ্যে অপমানিত বোধ করার রহস্য কি আজও উদ্ধার করতে পারিনি। এখনও এ গালির চল আছে কিনা তাও জানি না।
কোনও কোনও গালিকে বাংলায় অনুবাদ করে জাতে ওঠানোর বা একে সর্বত্র প্রয়োগ যোগ্য করার চেষ্টা অনেকের মধ্যে দেখা যায়। এ রকম একটি শব্দ হলো 'কেশ।' এ নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যার কোনও প্রয়োজন নেই। আমাদের পরিচিত একজনের মেজাজ গরম হলে 'পদ-সন্তানে' লাথি হাঁকানোর কথা অহরহ কহেন। বিচিত্র শব্দগুচ্ছ 'পদ-সন্তান'-এর অর্থ এখনও কোনও অভিধান খুঁজে পাবেন না। 'সন্তান'-এর সমার্থক শব্দ 'ছা' আর 'পদ' হলো 'পা'— এ বার আপনিই বুঝে নিন ওই ভদ্রপোলার লাথির লক্ষ্যস্থল।
চলতি বছর করোনায় প্রাণ হারিয়েছে আমাদের বিদ্যালয় বান্ধব নাজমুল ওরফে টুলটুল। সে বলত, কালা টাকার মতো অসভ্য বর্বর বস্তুকে সাদা করা গেলে গালির মতো লাগসই বস্তুকে কেনও সবখানে ব্যবহার উপযোগী করা যাবে না। এ বাবদ তার ব্যবস্থাপত্র ছিল, কুত্তার বাচ্চাকে সংক্ষেপে বললেই ঝামেলা ফতুর। মানে 'কুবা' কিংবা উল্টে 'বাকু' কও। যারা জানে তারা বুঝব। রাম ছাগল না বলে রাম বললেই হলো। 'চুমাপো' বা 'পোমাচু' যে ভয়াবহ গালি এবং অকথ্য তাও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। তবে টুলটুল আরেক ধাপ এগিয়েছিল, আচ্ছা 'অকথ্য' মানলাম, তা তোরা তো অ-লেখ্য কস নাই। মুখে উচ্চারণ না কইর্যা এবার লেইখ্যা গালি দে। তাইলেই 'সেভেন মার্ডার পার্ডন!'
লিবিয়া ফেরত এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু অনেক কাল আগে গালাগালি নিয়ে নিজের একটা অভিজ্ঞান আমাদের শুনিয়েছিলেন। সে সময় বাসে করে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করি। বাসেই তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ১৯৮০'এর দশকের কথা। সদা হাসিখুশি সে ভদ্রলোক বললেন, লিবিয়া যাওয়ার পরই কিছু আরবি শব্দ শিখিয়ে দিলেন পুরানো কয়েকজন। বললেন- লিবিয়াবাসীদের সঙ্গে কথা বলার আগে-পিছে এ সব শব্দ বলতে হবে। তাই করতাম। ক'দিন পর আরবি ভাষায় সামান্য জ্ঞান হওয়ার পর দেখলাম, ওগুলো সবই বিশুদ্ধ গালাগালি এবং 'ম' 'চ'কার বিষয়ক সব শব্দ। সাথে সাথেই ওসব প্রয়োগ বন্ধ করলাম। ওগুলোর বদলে সুশীল বাক্য ব্যবহার করতে শুরু করলাম আর বিপদে পড়লাম। বিপদ বলেন কি? আমরা সবাই অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।
—হ্যাঁ আমার নামে নালিশ করা হল, যখন এখানে এসেছিলাম তখন লোকজনের সঙ্গে আন্তরিক ভাবে কথা বলতাম কিন্তু এখন মাতব্বরি চালে কথা বলি! আসলে আমি যাকে গালাগালি বলে ভেবেছি ওগুলো আন্তরিকতা প্রকাশেও ব্যবহার হয়!
এককালে ছাদপেটা হতো। এখন হয়ত আর ওর চল বা প্রয়োজন নেই। ছাদপেটার সময় সুর করে যে গান গাওয়া হতো তাতেও প্রচুর 'গালাগালি' বা 'অশালীন' শব্দ থাকতো। যারা সে গান শুনেছেন মনে আছে নিশ্চয়ই।
আমাদের এক ভাগিনী কথা শেখার সময়ে গালিও শিখেছে। তার গালির ধরণ ছিল, 'তুত্তা'(কুত্তা) হয়ে গেছে, 'তুত্তা'র মতো করে, তারপর গলাখুলে বলত 'তুত্তা'র বাচ্চা।' কখনোই সরাসরি 'তুত্তার বাচ্চা' বলতে তাকে শুনিনি।
কাজী আনোয়ার হোসেনের আত্ম সম্মোহন বইতে নিজ সন্তানের গালির বর্ণনা দিয়েছেন। ক্ষেপে গেলে বড় সন্তানটি শিশুকালে বলত, কুত্তার বাচ্চার বাচ্চা বাচ্চার বাচ্চার বাচ্চা..। তাকে বোঝান হলে, প্রতিবার বাচ্চা বলার সাথে সাথে কুত্তা তো ছোট হয়ে যাচ্ছে। এ ভাবে কুত্তা খুবই ছোট হয়ে যাবে। এই বুঝ সে মানল। এরপর কুত্তা বলেই থামত সে। কাজী সাহেবের পরলোকগত পিতা বা পূর্বপুরুষদের ধরে আর টানাটানি করতো না।
শরৎচন্দ্র মহোদয়ের 'শ্রীকান্ত' কুলিদের সঙ্গে কাজ করার সময় দেদার গালাগালি দিয়েছেন। তবে খাতা খুলে সে কাজ করেছেন। কারণ তার নাকি গালাগালি মোটেও জানা ছিল না। এদিকে গালি না দিলে কাজে 'জোস' পায় না কুলিরা।
সে যুগে গালির একটি অভিধান থাকলে শ্রীকান্তদের সুবিধা হতো। হাতে লেখা গালির খাতার দরকারই পড়ত না। এ ছাড়া, গালির বিবর্তন এবং বৈচিত্র নিয়ে অনেক 'মজার' তথ্য জানা যেত। তবে গালি অভিধান সত্যিই কি এ যুগের শ্রীকান্তদের সহায়তা করবে! আজকের যুগে গালি জানেন না এমন 'শ্রীকান্তরা' আছেন কী!
(গালি অভিধান বের করার পর ঐতিহ্যের সঙ্গে আবদুল মান্নান স্বপনের সম্পর্ক গলাগলির হয়নি। বরং গালাগালির পর্যায়ে চলে গেছে। ঐতিহ্যকে ফোন করে স্বপনের সাথে যোগাযোগের পথ বের করা যায় কিনা জানার চেষ্টা করতে যেয়ে এ বিষয়টা আভাসে-ইঙ্গিতে টের পাই। ফলে পাঠক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ঐতিহ্য থেকে বইটির নতুন কোনও সংস্করণ আর বের হয়নি। বা হওয়ার কোনও সম্ভাবনাও নেই আপাতত।)
৩.
গালি কখনও গভীর ভালোবাসা, খাটি প্রেমের কথাও ব্যক্ত করে। রবীন্দ্রনাথের সংগৃহীত "ছেলে ভোলানো ছড়ায় 'ভাতার খাকী' শব্দটি পাওয়া যাবে। বোনের নির্ভেজাল ভালোবাসার নিদর্শন হিশেবে এ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে গ্রাম্য ছড়ায়।
আজ দুর্গা অধিবাস কাল দুর্গার বিয়ে।
দুর্গা যাবেন শ্বশুরবাড়ি সংসার কাঁদিয়ে।।
মা কাঁদেন মা কাঁদেন ধুলায় লুটায়ে।
সেই যে মা পলাকাঠি দিয়েছেন গলা সাজায়ে।।
বাবা কাঁদেন বাবা কাঁদেন দরবার বসিয়ে।
সেই যে বাপ টাকা দিয়েছেন সিন্দুক সাজায়ে।।
বোন কাঁদেন বোন কাঁদেন খাটের খুরো ধরে।
সেই যে বোন গাল দিয়েছিল ভাতার খাকি বলে।।
কিংবা লোকমুখে বর্ণিত ঢাকাইয়্যা কুট্টি অকাল পিতৃবিয়োগের শোকে দিশাহারা হয়ে যখন বলে, 'বাপ হালায় বেশিদিন লাস্টিং করল না', সে বাক্য তখন আমাদের হাসায় না। বরং বেদনাকে ঘন করে।
গভীর প্রেমের অনুচ্চারিত ভাবও অকপটে প্রকাশ করে গালি। মনীশ ঘটকের 'কুড়ানি' কবিতা এমনই এক কালজয়ী উদাহরণ। 'অষ্টবর্ষীয়া গৌরীর ঘাড় বাঁকাইয়া' উক্তি 'খট্টাইশ, বান্দর, তরে করুম না বিয়া'র চেয়ে হৃদয়স্পর্শী কবিতার চরণ হয়ত তেমন আর বেশি নেই।
৪.
নগর থেকে শুরু করে অজ পাড়াগাঁও বা গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত বাংলাদেশ সব অঞ্চল থেকে শব্দাহরণের অসাধারণ এক কৌশলের সুফল হিসেবেই আজ আমরা পেয়েছি বাংলা আঞ্চলিক শব্দের সমৃদ্ধ এক অভিধান। একই কৌশল নিয়ে যদি এগিয়ে আসে বাংলা একাডেমি তা হলে বাংলাভাষার পাঠকরা আবারও পেতে পারি গালি বা স্ল্যাং নিয়ে অসাধারণ এক অভিধান। বাংলা উন্নয়ন বোর্ড বিলীন হলো বাংলা একাডেমীতে। তারপর 'একাডেমী' বদলে 'একাডেমি' হলো। পরিবর্তনের পথে এতো হাঁটাহাঁটির পরও যথাযথ কর্তৃপক্ষের কেউ এমন অভিধানের দিকে এখনও নজর দেয়নি কেনও!
কতটা পথ পেরোলে পথিক বলা যায়— জনপ্রিয় গানের অনুকরণে বলা যায়, আর কতোটা অপেক্ষা করলে, একাডেমির ঘুম ভাঙ্গানো যায়!