পদ্মা সেতু বানাতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ড্রেজিং মেশিন ব্যবহার করা হয়েছে: আইনুন নিশাত
পদ্মা নদীর প্রবল স্রোত, গতি-প্রকৃতি, গভীরতাসহ বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যের কারণে এর ওপর সেতু নির্মাণ খুবই জটিল চ্যালেঞ্জ ছিল বলে মন্তব্য করেছেন পানি সম্পদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত।
তিনি বলেন, উজানের দিকের প্রায় ২০ কিলোমিটার প্রস্থ্যের দুইটি নদীর পানি পদ্মায় প্রবাহিত হয় মাত্র তিন কিলোমিটার গতি পথে। এক সেকেন্ড সময়ে এ নদীর স্রোত চলে যায় ১৫ মিটার।
এই নদীতে কাড়িগড়িভাবে জটিল সেতু নির্মাণ করতে কোয়ালিটির বিষয়ে কোনো ধরনের কমপ্রোমাইজ করা হয়নি বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
শনিবার (১৮ জুন) আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক উপ-কমিটি আয়োজিত 'শেখ হাসিনার পদ্মা সেতু নির্মাণ: বিশ্ব ব্যবস্থায় বাংলাদেশ তথা উন্নয়নশীল দেশসমূহের এক যুগান্তকারী বিজয়' শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, "যত ধরনের দুর্যোগ হতে পারে, আমরা সব মাথায় রেখেই সেতু নির্মাণ করেছি। পদ্মার মতো নদীতে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে। কত জোরে আঘাত হানতে পারে, সেগুলো মোকাবিলা করবার মতো সক্ষমতা তৈরি করেই আমরা সেতু নির্মাণ করেছি।"
ড. আইনুন নিশাত বলেন, পদ্মা অত্যন্ত শক্তিশালী একটি নদী। যখন এর প্রশস্ততা কমে, তখন গভীরতা বাড়ে। মাওয়া এলাকায় এসে নদীর প্রশস্ততা যেমন কমেছে, তেমনই গভীরতাও বেড়েছে। নদীর ধর্ম বুঝে, তারপর ব্যবস্থা নিতে হবে।
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ড. গোলাম রহমান প্রমুখ।
এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতু নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে যে অবমাননাকর অবস্থান নিয়েছিল তার উপযুক্ত জবাব আজকের পদ্মাসেতু।
ড. শামসুল আলম বলেন, "পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের জিডিপি ১.২৩ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা দেওয়া হলেও পায়রা বন্দর, রাসপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মোংলা বন্দরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে প্রকৃত সুফল আরো বেশি আসবে।"
অর্থনীতিবিদ কাজী খলিকুজ্জামান বলেন, "পদ্মা সেতু দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অগ্রগতিসহ যোগাযোগ খাতের অর্থের সাশ্রয় করবে, অর্থনীতিকে আরো চাঙ্গা করবে। এই পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার দূরদর্শিতার বাস্তব রূপ।"
সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ডক্টর গোলাম রহমান জানান, "পদ্মার মতো ভয়াবহ নদীতে যে কারিগরি ব্যবস্থায় পদ্মাসেতু নির্মাণ হয়েছে তা দারুণ এক চ্যালেঞ্জ। নানা জটিলতা অতিক্রম করে বাস্তবায়ন হওয়া এই সেতু দেশের নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। দুর্নীতির বদনামকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে এই সেতু।"
জাতীয় সংসদের স্পিকার ডক্টর শিরীন শারমিন চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বাংলাদেশের এগিয়ে চলার সক্ষমতার প্রমাণ এই পদ্মা সেতু। বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের দ্বার খুলে দিয়েছে এটি। শুধু দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের নয়, সারা দেশের সব ধরনের উন্নয়ন করবে এই সেতু।
তিনি বলেন, "পদ্মাসেতু শুধু অবকাঠামো নয় দেশের মানুষের আবেগ ও ভালোবাসা।"
ডক্টর মসিউর রহমান পদ্মাসেতু নির্মাণের পটভূমি তুলে ধরে বলেন, সেতু নিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রথম জাপানের কাছে প্রস্তাব করেছিলেন। তারা রাজি হলেও অন্য একটি প্রকল্প আগে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছিল।"
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাংক অযৌক্তিকভাবে অর্থায়ন থেকে সরে গিয়েছিল বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের এক্পার্ট প্যানেলে শুরু থেকেই যুক্ত থাকা আইনুন নিশাত অনুষ্ঠানে বলেন, "পদ্মা নদী কখনও এক যায়গায় স্থির থাকে না। তিন কিলোমিটার প্রস্থ্যের নদী কখনও পূর্ব দিকে কখনও পশ্চিম দিকে সরে যায়। এ কারণে ছয় কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণ করতে হয়েছে।
তিনি বলেন, "মাটি সরে যাওয়ায় পদ্মা নদীর তলদেশে ৭০ ফুট পর্যন্ত ড্রেজিং করা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ড্রেজিং মেশিন এনে ড্রেজিং করেছি। এটি এতটা সহজ নয়।"
তিনি বলেন, প্রত্যেকেটা প্রকল্প বাস্তবায়নের পেছনে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি থাকে। কারণ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় না।
বিশ্বব্যাংক যে বিরোধিতা করেছে, তার পেছনে রাজনৈতিক কারণ ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সেমিনারে ঢাকা থেকে বরিশালের রাস্তাকে আরও প্রশস্ত করার প্রতি জোর দিয়ে আইনুন নিশাত বলেন, "এটা যদি আমরা সেতু নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে করাতাম, তবে আরো ভালো হতো। আমাদের বড় প্রকল্প লাগবে। কিন্তু আমরা অনর্থক বড় প্রকল্প যেন না করি, অর্থের কথা যেন চিন্তা করা হয়।"