সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারছে না লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাত
১৭ বছর আগে সাজ্জাদ হোসেন ছিলেন যশোর লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একজন ভাঙ্গারি শ্রমিক। নিজের জমানো ১০ হাজার টাকা নিয়ে নিজেই গড়েন লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা। বর্তমানে সাজ্জাদ হোসেনের কারখানায় ৪০ জনের মতো শ্রমিক কাজ করেন, তার বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৪ কোটি টাকা।
সাজ্জাদ হোসেন বলেন, 'আমার কারখানায় মোটর সাইকেলের ডেকোরেশন তৈরি করা হয়, চীন থেকে যে মোটর সাইকেলের সামনের হাতল যন্ত্রটি ৪০০-৫০০ টাকায় কিনতে হয়, আমরা সেটা ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি করতে পারি। সব মিলিয়ে আমরা নতুন যন্ত্র উদ্ভাবন ও মেরামত করে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার আমদানি ব্যয় রক্ষা করি।'
কয়েক হাজার টাকা নিয়ে ১৯৮০ সালে ভাঙ্গারি ব্যবসা শুরু করেন বগুড়ার মিল্টন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. আজিজুর রহমান মিল্টন। আশির দশকে আজিজুর রহমান মিল্টনের উদ্যোগে বগুড়াতেই প্রথম ফাউন্ড্রি শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে। বর্তমানে আজিজুর রহমানের কারখানায় ২০০ জন মানুষ নিয়োজিত, এবং বার্ষিক টার্নওভার ১০ কোটি টাকা।
আজিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'দেশের ৮০ শতাংশ কৃষি যন্ত্রপাতি যোগান দিচ্ছে এই বগুড়া লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাস্টার, যা একসময় সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর ছিল। বিদেশি পণ্যের তুলায় গুণে-মানে-দামে এই ক্লাস্টারের পণ্য ভালো হওয়ায় এ শিল্পটি এই এলাকায় বিখ্যাত হয়ে উঠে।'
তিনি আরও জানান, দেশে-বিদেশে বগুড়ায় উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রাংশের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এখানকার উৎপাদিত টিউবওয়েল সরবরাহ করা হয় দেশের নামীদামি প্রতিষ্ঠানে, যাচ্ছে বিদেশেও। ১৯৯৫ সালে ভারতে ভূগর্ভের পানি ওপরে তোলার সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প রপ্তানির মধ্য দিয়ে বিদেশের বাজারে প্রবেশ করে বগুড়ার কৃষিশিল্প। কয়েক বছর ধরে ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটানে টিউবওয়েল রপ্তানি হচ্ছে।
পুরান ঢাকার বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি তৈরির ক্লাস্টারের সফল উদ্যোক্তা আলমগীর কবির। ২০১৭ সালে তিনি যাত্রাবাড়ীতে ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে কেবল উৎপাদন শুরু করেন। বর্তমানে তার কারখানায় প্রতিদিন ৭০০ থেকে ১ হাজার কয়েল ক্যাবল উৎপাদন হয়; প্রতিটি কয়েলে ১০০ মিটার তার থাকে। কারখানাটির বার্ষিক টার্নওভার ৪ কোটি টাকা।
আলমগীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা যতটুকু এসেছি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়, সরকারি-বেসরকারি কোন সহযোগিতা পাইনি। সরকারের কাছ থেকে কিছুটা সহযোগিতা পেলে আগামী ৫-১০ বছর পর আমার কারখানার বার্ষিক টার্নওভার হবে অন্তত ১৫-২০ কোটি টাকা। সেইসঙ্গে কর্মসংস্থান হবে বহু লোকের।'
শুধু সাজ্জাদ হোসেন, আজিজুর রহমান মিল্টন ও আলমগীর কবিরই নয়, দেশের আনাচে-কানাচে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এসব লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প-কারখানা গড়ে তুলে অনেকেই আজ স্বাবলম্বী।
স্বাধীনতার পূর্বে বর্তমান পুরান ঢাকার ধোলাইখাল এলাকায় কিছু অবাঙ্গালি-পাঞ্জাবি উদ্যোক্তা কয়েকটি গাড়ি মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন যেমন- মডার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং, ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং, বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি। চট্টগ্রামেও কিছু বড় বড় মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। আদমজী ও বাওয়ানী জুটমিলের মত একাধিক প্রতিষ্ঠান নিজেরা কিছু যন্ত্রপাতি তৈরি করত এবং উদ্বৃত্ত কিছু কিছু তারা পশ্চিম পাকিস্তানে রপ্তানি করত। এ সকল প্রতিষ্ঠান জুটমিলের স্পেয়ার পার্টসের যোগান দিত।
দেশ স্বাধীনের পর পাকিস্তানি উদ্যোক্তারা চলে গেলে এ সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। একপর্যায়ে এ সকল কারখানায় কর্মরত দেশীয় কারিগররা কিছু ওয়েল্ডিং মেশিন এবং লেদ মেশিন নিয়ে নিজেদের উদ্যোগেই ছোট ছোট কারখানা গড়ে তোলে। ঐ সময় মাত্র ২০টি কারখানা গড়ে উঠেছিল, পরবর্তীতে আস্তে আস্তে এই শিল্প সম্প্রসারণ হতে থাকে এবং সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারণ হয় আশির দশকে তৎকালীন এরশাদ সরকারের আমলে।
এরশাদ সরকারের সময়ে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প উন্নয়নের জন্য পাঁচ কোটি টাকার 'ধোলাইখাল জিঞ্জিরা প্রকল্প' নামে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
তারপর এক দশকের মধ্যেই কারখানাগুলো রাজধানীর ধোলাইখাল, টিপু সুলতান রোড, নারিন্দা, তাহেরবাগ, বনগ্রাম, জিঞ্জিরা, কেরানীগঞ্জ ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃতি লাভ করে।
পুরান ঢাকার দেখাদেখি পরবর্তীতে বগুড়া, সৈয়দপুর, যশোর, চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পাবনা, নাটোর, রাজশাহী, নওগাঁ, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলায় এসব কারখানা গড়ে ওঠে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, বর্তমানে শুধু পুরান ঢাকায়ই গড়ে উঠেছে ৫০০০-৬০০০ কারখানা এবং ঢাকার যাত্রাবাড়ির কুদরত আলী বাজার, পাটের বাজার, দক্ষিণ দনিয়া, কাজলা, মাতুয়াইল এসমস্ত এলাকায় গড়ে উঠেছে আরও দুই হাজারের অধিক কারখানা। বগুড়ায় ২০০০, যশোরে ৪০০, ঝিনাইদহে ৩০০, কিশোরগঞ্জে ২৭০, রাজশাহীতে ২০০, কুমিল্লায় ১৫০ এবং চট্টগ্রামে প্রায় ২০০ কারখানা গড়ে উঠেছে।
হালকা প্রকৌশল শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের আনাচেকানাচে গড়ে ওঠা ছোট-বড় মিলিয়ে সারা দেশে প্রায় ৫০ হাজার কারখানা রয়েছে।
তার মধ্যে ১০ শতাংশ উৎপাদনশীল আর ৯০ শতাংশই মেশিন মেরামতের কারখানা। এ খাতে প্রত্যক্ষভাবে ৬ লাখ দক্ষ ও প্রায় ১০ লাখ আধা দক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান রয়েছে। এছাড়াও পরোক্ষভাবে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের জীবিকার সংস্থান হয়েছে এ খাতে।
পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ ৪০ বছর থেকে এ শিল্পের সাথে জড়িত। তিনি বলেন, আশির দশকের পর থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দ্রুত বিকশিত হয় এ খাত, তারপর ২০১৩ সাল পর্যন্ত শ্লথগতিতে এগোয়।
এ ব্যাপারে উদ্যোক্তা এবং বগুড়া ফোরাম ফর এগ্রো মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের সভাপতি গোলাম আজম টিকুল বলেন, 'বর্তমানে হালকা প্রকৌশল শিল্প খাতে ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিশ্ববাজার রয়েছে, যদিও বাংলাদেশে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এখন পযন্ত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারছে না। সরকারি সহায়তা আর আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার অভাব, সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের অভাব তাদের প্রধান বাধা।'
এ শিল্পের সাথে জড়িত উদ্যোক্তারা মনে করেন, শ্রমিকদের অনিরাপদ এবং অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, কাচামালের উচ্চমূল্য, পণ্যের মান উন্নয়নে গবেষণাগার এবং সার্টিফিকেশন না থাকার মতো নানাবিধ কারণেও এ শিল্পের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।
এছাড়াও কিছু অসাধু কারখানায় নকল পণ্য উৎপাদন এবং ভারত ও চীন থেকে নিম্নমানের পণ্য আমদানির কারণে দেশের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথাও উল্লেখ করেন উদ্যোক্তারা।
বর্তমান সরকার ২০২০ সালে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যকে জাতীয়ভাবে 'বর্ষপণ্য' ঘোষণা করে এ খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানান।
২০১৬ সাল থেকে বিসিকের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের বেতকায় ৩১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০ একর জমিতে এ ধরনের একটি শিল্পনগরী স্থাপনের কাজ চলছে, যা এ বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
এছাড়া ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, যশোর, বগুড়া, গাজীপুর ও নরসিংদী-এ পাঁচটি সম্ভাবনাময় এলাকাকে ক্লাস্টার আকারে পার্ক গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
পুরান ঢাকার কদমতলীর উদ্যোক্তা মুমিনুর রহমান মিঠু বলেন, 'মুন্সীগঞ্জসহ সরকারি বরাদ্দকৃত শিল্প পার্কগুলোর প্লটের দাম বাইরের জমির তুলনায় অনেক বেশি, যার কারণে উদ্যোক্তাদের তেমন টানতে পারেনি এই প্রকল্প। এছাড়াও সারাদেশের হালকা প্রকৌশল কারখানার তুলনায় এসব পার্কের জমির পরিমাণ অপ্রতুল। যার ফলে ৮০ শতাংশ উদ্যোক্তাই এই ফল ভোগ করতে পারবেন না।'
এত প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ৫২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়, যা করোনা কবলিত বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ২৯২.৯২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এ খাতের প্রধান প্রধান বাজার হচ্ছে- থাইল্যান্ড, জাপান, নেদারল্যান্ডস, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, তাইওয়ান ও পাকিস্তান।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির (বিইআইওএ) সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'হালকা প্রকৌশল শিল্পে আমাদের বিনিয়োগ প্রায় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্ববাজারের ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের মধ্যে আমাদের দখলে ১ শতাংশও নেই। এই শিল্পখাত বাংলাদেশের মোট চাহিদার প্রায় ২০% পূরণ করে থাকে এবং প্রায় ৬০% আমদানি বিকল্প পণ্য তৈরী করে থাকে। সরকারি সহযোগিতায় পর্যাপ্ত পুঁজি, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, বাস্তবভিত্তিক পলিসি এবং শিল্প স্থাপনের জন্য কম মূ্ল্যে সরকারি জমি পেলে এ খাতকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'এ খাতে উৎপাদিত পণ্যের কাচাঁমাল আমদানি করলে ভ্যাট ও শুল্ক করসহ ৩০-৪০ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়, অথচ একই ধরণের ফিনিশড পণ্য বিদেশ থেকে আনতে চাইলে মাত্র ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক দিলেই হয়। এ বৈষম্য দূর করে এই শিল্পখাতকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হলে আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পুরোপুরিই মেটানো সম্ভব এবং দেশের বাইরেও ব্যাপকভাবে রপ্তানি করা সম্ভব।'