লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে বিপুল সম্ভাবনা, প্রয়োজন নীতিগত সহায়তা
ছোট্ট আলপিন থেকে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির আধুনিক সব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ বানিয়ে ৭ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে বৈশ্বিক লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প। কম্প্রেহেন্সিভ পলিসি সাপোর্ট বা নীতি সহায়তা পেলে বাংলাদেশেও এ শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন এ খাতের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড আয়োজিত ''প্রপোজড বাজেট: হোয়াট আর দ্য ইনসেনটিভস' শীর্ষক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন তারা। এতে অংশ নিয়ে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের সম্ভাবনা, বর্তমান সমস্যা, বাজেটে সরকারের দেয়া প্রণোদনা এবং খাতটির চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ, বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এবং জিয়া মেই ইন্ডাস্ট্রিজ (বিডি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউ লিয়াংহুই।
সূচনা বক্তব্যে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার খান বলেন, "লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পকে আমরা ছোট শিল্প মনে করি। আসলে এর পরিধি অনেক বড়। শিল্পকারখানার চালিকাশক্তি মৌলিক যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আসে এ খাত থেকে। খাতটি বর্তমানে কৃষি যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, মেরিন, মোল্ড অ্যান্ড ডাই, টেক্সটাইল, জুটমিল, চা বাগান ও মিল, নির্মাণ শিল্প, বেকারি শিল্প, মেটাল ফার্নিচার, কাগজ মিল, পশুপালন শিল্প ও অটোমোবাইল শিল্পসহ প্রাত্যহিক কাজের অধিকাংশ যন্ত্রাংশ উৎপাদন করছে। ৫০ হাজারের অধিক কারখানায় ৮-১০ লাখের মতো মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশের চাহিদা অনুযায়ী এ ইন্ডাস্ট্রি আরো কয়েকগুণ বড় হতে পারে।"
"সরকারও বিষয়টি অনুধাবন করেছে। গত বছরের বাজেটে কর অবকাশ সুবিধাসহ কিছু ঘোষণা দিয়েছে এ ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে। তবে খাতটির বিকাশে আরো প্রণোদনা দরকার," যোগ করেন তিনি।
শামস মাহমুদ বলেন, "গত অর্থবছরের বাজেটে সরকার ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা দিয়েছে। তবে নানা শর্তের কারণে ইন্ডাস্ট্রির কেউ তা পায়নি। অর্থমন্ত্রীর এবারের প্রস্তাবিত বাজেটেও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের জন্য তেমন পলিসিগত পরিবর্তন আমরা দেখিনি।"
"সাধারণ ওয়েল্ডিং থেকে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের ধারণায় পরিবর্তন হয়েছে। এখন ক্যাট ডিজাইন, সিইসি প্রোগ্রামিং, অটোমোবাইলের বড় বড় কাজ যুক্ত হচ্ছে এ শিল্পে। ফলে কারিগরি শিক্ষার বিস্তৃতি ছাড়া এ খাতের বিস্তার হবে না। বাজেটে আমরা এসব বিষয়ে জোর দেয়ার কোনো উদ্যোগ দেখি নি," যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, "স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার পর আমরা রপ্তানি ও কাঁচামাল আমদানিতে সমস্যায় পড়বো। হুমকিতে পড়বে দেশের হালকা প্রকৌশল শিল্পও। তখনকার প্রতিযোগিতায় টিকতে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন জরুরী। এসব কারণেই ট্যাক্সের পাশাপাশি একটি কম্প্রেহেন্সিভ পলিসি দরকার বলে আমরা মনে করছি।"
এটি হলে আগামী পাঁচ বছরে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প একটি ভালো অবস্থানে পৌঁছাবে বলে মন্তব্য করেন শামস মাহমুদ।
দেশে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাবনা তুলে ধরেন মোঃ আব্দুর রাজ্জাক।
তিনি বলেন, "হালকা প্রকৌশল শিল্পে আমাদের বিনিয়োগ প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। বিশ্ববাজারের ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের মধ্যে আমাদের দখলে ১ শতাংশও নেই। একসময় বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশের বেশি ছিল। এখন সেভাবে বাড়ছে না। জিডিপিতে এর অবদান ৩ শতাংশ থেকে কমে এখন আড়াই শতাংশে নেমে এসেছে। যদিও এ খাতটির তিন-চার গুণ বড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রপ্তানিতে সবচেয়ে বড় খাত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ৫০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে।"
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতিরর সভাপতি মোঃ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, "বিভিন্ন শিল্পকারখানার জন্য আমরা প্রতি বছর প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মোল্ড আমদানি করি। এর সবই স্থানীয়ভাবে তৈরি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে কিছু আমরা তৈরি করছি বটে, কিন্তু সবটা এখনো পারছি না। হালকা প্রকৌশলের জন্য আমরা একটি নিবেদিত শিল্প পার্ক দাবি করে আসছি অনেক দিন ধরে। একটি পার্ক নির্মাণের কাজ প্রায় এক যুগ ধরে বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে অগ্রগতি সেভাবে নেই।"
"কাঁচামালে শুল্ক ও করের চাপে পিষ্ট এ খাত। অথচ সম্পূর্ণ তৈরি পণ্য আমদানির শুল্ক ১ শতাংশ। এমন শুল্কবৈষম্যে এ খাতের এগোনো কঠিন। তবে রপ্তানি নীতিতে সরকার এ খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। শিল্প নীতিতেও এ খাতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ২০২০ সালে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংকে 'প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার' ঘোষণা করা হয়েছে। এসএমই নীতিতেও প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আমাদের জন্য একটি সহায়ক আইনও হয়েছে। তবে অবাস্তব শুল্ক করকাঠামো ও ট্যারিফ বিন্যাসের কারণে সবকিছু ম্লান হয়ে যাচ্ছে।"
"শুধু ট্যাক্স অবকাশ সুবিধা নয়, এ খাতের জন্য দরকার কম্প্রেহেন্সিভ পলিসি সাপোর্ট", যোগ করেন আব্দুর রাজ্জাক।
বিকাশে প্রতিবন্ধকতা
বাংলাদেশে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের সম্ভাবনা দেখে এখানে বিনিয়োগ করে বিপদে পড়েছেন বলে জানান ইউ লিয়াংহুই।
তিনি বলেন, "আমি ইলেকট্রিক মোটর উৎপাদনের একটি কারখানা করেছি। একটি মোটর উৎপাদন করতে আমার ২০-৩০ ধরনের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এসব কাঁচামাল আমদানিতে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত কাস্টমস ডিউটি দিতে হয়। কিন্তু ওই একই মোটর ফিনিশড প্রোডাক্ট হিসাবে ১ শতাংশ শুল্ক দিয়ে আমদানি করছে শিল্পকারখানা। ফলে আমি প্রতিযোগিতা করতে পারছি না।"
শামস মাহমুদ বলেন, "লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের একটা বড় প্রতিবন্ধকতা হলো আমরা এটাকে ছোট খাত হিসাবে বিবেচনা করি। কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক ছাড়াও ভ্যাটের সমস্যা রয়েছে। উদ্যোক্তারা যে উপকরণই সংগ্রহ করুক, তার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এইচ কোডের জটিলতার কারণে অনেক কাঁচামালেই উচ্চ শুল্ক পরিশোধ করতে হয়।
নীতির ধারাবাহিকতাও ও একটি বড় সমস্যা বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "সরকার হুটহাট পলিসিতে বদল আনে। হুট করে থ্রি-হুইলার বন্ধ করে দেয়। তাতে দুই-তিন লাখ মেশিনারিজ অকেজো হয়ে যায়। আবার দেখা যায় হুটহাট চালু হয়ে যায়।"
তিনি আরো বলেন, "আমাদের আরেকটা বড় সমস্যা দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছি না। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা মেধাবীরা উচ্চ বেতন নিয়ে বিদেশ চলে যান। এটিকে রোধ করতে হবে।"
দেশের ভোকেশনাল কলেজগুলোকে প্রাইমারি স্কুলের সঙ্গে তুলনা করেন আব্দুর রাজ্জাক।
তিনি বলেন, "পুঁজি, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, পরিকল্পিত শিল্পপার্ক ও পলিসি সাপোর্ট না থাকাটা আমাদের জন্য বাধা।"