ট্রাম্প: এক দানবের উত্থান ও পতন
বিস্তর পাগলামির সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ আর দাম্ভিকতা ট্রাম্পকে পরিণত করেছিল এক দানবে। তা সত্ত্বেও বারবার পার পেতে থাকায় সপ্তাহখানেক আগ অবধি তাকে ভাগ্যবান বলেই মনে হতো। কিন্তু রাষ্ট্রপতির মেয়াদকালের শেষ পর্যায়ে এক লজ্জাজনক সমাপ্তির মধ্য দিয়ে পতনই লেখা ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের শেষ পরিণতিতে।
যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন বার্তা জানানোর যে রীতি ধারণ করে, ট্রাম্প সেটিও ক্ষুণ্ণ করতে পিছপা হননি। তবে তিনি ভাগ্যবান যে এর জন্য তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হয়নি।
নির্বাচনের ফলাফল বদলে দিতে ট্রাম্পের আইনি লড়াই যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বিশ্লেষকরা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের তুলনা করে বসেছেন উন্নয়নশীল দেশের দুর্বল শাসন কাঠামোর সাথে।
ট্রাম্পের লাগামহীন পাগলামির পরিণামই ক্যাপিটল হিলের সহিংসতা। নভেম্বরের নির্বাচনী ফলাফল উলটে দিতেই ট্রাম্প বিদ্রোহের প্ররোচনা দিয়েছেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।
রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের প্রধান হয়ে ট্রাম্প খোদ আইনসভার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহে উসকানি জুগিয়েছে। ট্রাম্পের অনুসারীদের আক্রমণের শিকার স্বয়ং কংগ্রেস। কেননা কংগ্রেসই ইলেকটোরাল ভোট গণনা থেকে শুরু করে বাইডেনের বিজয় ঘোষণা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে গেছে।
হামলাটি শুধু সংসদের ক্ষমতা ও কার্যক্রমের হস্তান্তরেই ব্যাঘাত ঘটায়নি, বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পরিচালনার ক্ষেত্রে এক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সুতরাং ট্রাম্পের সামনে এখন ভাল বিপত্তি অপেক্ষা করছে।
ক্যাপিটল হিল দখল ও সহিংসতার সাথে জড়িত থাকায় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কোনো ক্রিমিনাল চার্জ আনা হবে কিনা সে প্রশ্ন এখনো বিতর্কিত। কিন্তু তারপরেও দেশটির মত প্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপ্তির জন্য ট্রাম্প হয়তো ছাড় পাবেন। তবে আগামী নির্বাচনে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন কি না তা এখন প্রশ্নের মুখে।
সংবিধানের ২৫ তম সংশোধনী অনুসারে ক্ষমতা ও দায়িত্ব হস্তান্তরে অপারগতার অভিযোগে ট্রাম্পকে স্থলাভিষিক্ত করতে পারতেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। কিন্তু পেন্সের অসম্মতির পর যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ পরিষদ ট্রাম্পকে অভিশংসন করে যাতে ভোট দিয়ে নিজেদের সমর্থন জানান ট্রাম্পেরই দল রিপাবলিকান পার্টির ১০ জন প্রতিনিধি।
ট্রাম্প এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি যিনি দ্বিতীয়বারের মতো অভিশংসিত হয়েছেন।
সিনেট ট্রায়ালে দোষী সাব্যস্ত হলে ট্রাম্প ভবিষ্যতে সকল ধরণের সরকারি দফতরে অধিষ্ঠানের অধিকার খোয়াবে। ফলস্বরূপ ট্রাম্পকে রাজনীতির ইতি এখানেই টানতে হতে পারে।
এমনকি ট্রাম্প যদি ২০১৯ সালের মতো এবারও সিনেট ট্রায়াল থেকে পার পেয়ে যান, তবু সংবিধানের অন্য একটি বিধান তাকে মুশকিলে ফেলতে পারে। বিধান অনুসারে কোনো ব্যক্তি যদি সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের শপথ আনে এবং এরপর সরকারবিরোধী কোনো "বিদ্রোহ কিংবা বিপ্লবের সাথে জড়িয়ে পড়ে কিংবা 'আমেরিকার শত্রুকে সাহায্য করে' তবে সেই ব্যক্তি 'যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে' কোনো অফিসে বা কার্যালয়ে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না।
আরেকটি বড় প্রশ্ন হল যে, এমন লজ্জাজনক ইতি এবং বিধ্বংসী পরিণতির পর ট্রাম্পের নিজের দল তাকে গ্রহণ করবে কিনা।
গতবার সিনেটে রিপাবলিকানরা অভিশংসনের তীব্র বিরোধিতা করায় ট্রাম্প বেঁচে যায়।
কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন।
সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মিচ ম্যাককনেল গতবার ট্রাম্পের অভিশংসনের পথে দেয়াল সৃষ্টি করে তাকে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু এবার ট্রাম্পকে সরাতে ডেমোক্র্যাটদের উদ্যোগে ম্যাককনেল সন্তুষ্ট। ট্রাম্পকে দল থেকে হঠানো এখন সহজ হবে বলে তিনি মনে করছেন।
রিপাবলিকান নারী সাংসদদের অনেকেও ক্যাপিটলের সহিংসতার জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করে তীব্র আক্রমণ করেছেন।
"যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এই আন্দোলনে আগুন জ্বেলেছেন। উত্তেজিত জনতাকে তিনিই আহ্বান করেছেন, তাদের জড়োও করেন তিনি," এক বিবৃতিতে বলেন রিপাবলিকান রিপ্রেজেন্টেটিভ লিজ শিনে।
"এই বিক্ষোভ আমাদের রিপাবলিকের সবথেকে পবিত্র স্থানে ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, মৃত্যু ও হতাহতের কারণ সৃষ্টি করেছে।"
"যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোনো প্রেসিডেন্ট নিজের অফিস আর সংবিধানের প্রতি করা শপথের সাথে এত বড় বেঈমানি করেনি।"
"আমি ট্রাম্পকে অভিশংসিত করার পক্ষে ভোট দিব," বলেন শিনে।
শিনের মতো অনেক রিপাবলিকান সিনেটর এবং কংগ্রেস সদস্য ট্রাম্পকে অভিশংসিত করতে ডেমোক্র্যাটদের সাথে হাত মিলিয়েছেন। সুতরাং, ট্রাম্পের পতন এখন নিশ্চিত।
ট্রাম্পের শেষ পরিণতিও এখন তার উত্থানের মতো বিতর্কিত আর কোলাহলে পরিপূর্ণ।
এক দানবের উত্থান
"ডোনাল্ড ট্রাম্প মেকি, সে একজন প্রতারক…ডোনাল্ড ট্রাম্প হল হল শঠতার প্রতীক।"
প্রায় বছর পাঁচেক আগে রিপাবলিকান সিনেটর মিট রমনি যখন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে রিপাবলিকান টিকেট পেতে ট্রাম্পের সাথে প্রতিযোগিতায় নামেন, তখন ট্রাম্পকে চিত্রায়িত করতে তিনি এসব 'বিশেষণ' প্রয়োগ করেছিলেন।
২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণাও ছোট-বড় নানা কেলেংকারীতে সয়লাব ছিল। যৌন নিপীড়নের অভিযোগ থেকে শুরু করে অসদাচরণ এবং প্রশ্নবিদ্ধ ব্যবসায়িক চুক্তি ইত্যাদি নানা অভিযোগের তীর ছিল ট্রাম্পের দিকে।
রিপাবলিকান দলের ১৬০ জনেরও বেশি গণ্যমান্য সদস্য ট্রাম্পের সমর্থন ছেড়ে দিয়েছিলেন। অধিকাংশ পত্রিকা, এমনকি রিপাবলিকান ঘেষা পত্রিকাগুলোও ট্রাম্পের সমালোচনায় মুখর থাকত। হিলারি ক্লিনটনই জয়ী হবে, সবগুলো পূর্বানুমানে এমন ধারণাই উঠে এসেছিল। এমনকি ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পরেও হিলারির জেতার সম্ভাবনা ৮৫ শতাংশ বলে প্রচারিত হয়েছিল।
কিন্তু কোনো কিছুই তাকে হতাশ করতে পারেনি। ট্রাম্প ঠিকই বিশ্বকে বোকা বানিয়ে পপুলার ভোটে বিজয়ী হিলারিকে হারিয়ে জয় লাভ করেছিলেন।
যে মানুষ খোলাখুলি নারীদের অযাচিতভাবে স্পর্শ করার ব্যাপারে বড়াই করেন, তিনিই বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন। এক বিজনেস মোঘল; যে আগে কখনো আনুষ্ঠানিক কোনো পদে নির্বাচিত হননি, তিনিই হলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার উত্থান ছিল এক দানবের মতো। হোয়াইট হাউজের চার বছরে যে দানব আরও বেপরোয়াভাবে বেড়ে উঠেছিল।
কিছুদিনের মধ্যেই তিনি একজন জননেতা বনে যান। ট্রাম্পের বিজয় বিশ্বব্যাপী পপুলিজমের বিজয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। আমেরিকা থেকে ইউরোপের পপুলিস্ট নেতারা হোয়াইট হাউজে তাদের জাতীয় নেতাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। এমন নেতা যিনি কিনা রীতিমতো বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনাই পালটে দিবেন।
কিন্তু তার চার বছরের শাসনের দিকে তাকালে আজ কেবল বাণিজ্যিক দুর্দশা, জলবায়ু বিতর্ক, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর আক্রমণ, সহযোগীদের আঘাত আর ক্ষমতার অপব্যবহারই নজরে আসবে।
বাংলাদেশেও ট্রাম্পের সদৃশ এক ভদ্রলোক ছিলেন! তিনি হলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। এই ব্যক্তিটিও তার অমার্জিত ভাষা, মানুষকে হীন করার প্রবৃত্তির জন্য কুখ্যাত ছিলেন।
সালাউদ্দিন কাদেরের পরিণতিও ছিল এমন ঘৃণ্য। কয়েক বছর আগেই যুদ্ধাপরাধের দায়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
২০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউজ থেকে বের হয়ে আসার পর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বেশ কিছু আইনি অভিযোগ আনা হতে পারে। নিউইয়র্কে ব্যবসায়িক চুক্তিকালে প্রতারণার অভিযোগে তদন্ত থেকে শুরু করে আইনি ব্যবস্থার সম্মুখীন হতে পারেন ট্রাম্প।
কথায় আছে, "উপর দিকে থুতু ছুড়লে তা নিজের গায়েই পড়ে।" সালাউদ্দিন আর ট্রাম্পের মতো মানুষদের পরিণতি আমাদের সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।
- মূল লেখা: Trump: The rise and fall of a monster
- অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা