টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ পয়েন্ট অর্জনের মিশন
ওয়ানডেতে হেসেখেলেই সিরিজ জয়, সেটাও আবার হোয়াইটওয়াশ। প্রতিপক্ষ সেই দলটিই কিছুটা মোড়ক পাল্টে মাঠে নামছে টেস্ট লড়াইয়ে। ভিন্ন ফরম্যাট বলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো বাংলাদেশ দলেও আছে ভিন্নতা। কিন্তু লক্ষ্যে নেই কোনো নতুনত্ব। চাওয়া একটাই, জয়। স্বাভাবিকতার এই চাওয়ার সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন লক্ষ্য, প্রথমবারের মতো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট অর্জন।
খাতা-কলমে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সঙ্গে বেশ আগেই পরিচয় হয়েছে বাংলাদেশের। খেলার অভিজ্ঞতাও হয়ে গেছে। কিন্তু টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের তিনটি ম্যাচ খেলে এখনও কোনো পয়েন্ট মেলেনি। তিনটি ম্যাচেই হেরেছে বাংলাদেশ। ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলা তিনটি ম্যাচে রীতিমতো আত্মসমর্পণ করে ইনিংস ব্যবধানে হার মানে মুমিনুল হকের দল।
সোনার হরিণ হয়ে থেকে যাওয়া টেস্ট চ্যম্পিয়নশিপ পয়েন্ট জেতার সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজটিকে লক্ষ্য বানাচ্ছে বাংলাদেশ। সেটাও শুধু পয়েন্ট হলেই চলবে না, সিরিজের পুরো ১২০ পয়েন্ট-ই চাই বাংলাদেশের। ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া চট্টগ্রাম টেস্টের পর মিরপুরে অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় টেস্টেও রাজত্ব কায়েম করার লক্ষ্য মুমিনুলবাহিনীর।
লক্ষ্য পৌঁছাতে পারলে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট টেবিলে প্রথমবারের মতো কোনো দলকে পেছনে ফেলতে পারবে বাংলাদেশ। দুই ম্যাচ জিতে সিরিজের পুরো ১২০ পয়েন্ট তুলে নিতে পারলে বাংলাদেশ অবশ্য দুটি দলকে ছাড়িয়ে যাবে। ৮ নম্বরে থাকা ওয়েস্ট (৪০ পয়েন্ট) ও ৭ (৮০ পয়েন্ট) নম্বরে থাকা শ্রীলঙ্কাকে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। দুই জয়ে পয়েন্ট টেবিলের ৭ নম্বরে উঠে যাবে বাংলাদেশ, জয়ের গড়েও এগিয়ে থাকবে মুমিনুলের দল।
১২০ পয়েন্টে দৃষ্টি দিয়ে রাখলেও বাংলাদেশকে অতি সতর্ক থাকতে হচ্ছে। নিয়মিত দলের ১৩জন ক্রিকেটার ছাড়া এলেও টেস্টের লড়াই যে সহজ হবে না, তা জানা আছে ঘরের মাঠের দলটির। সঙ্গে আছে দীর্ঘ বিরতির বিষয়টিও। করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। বাংলাদেশ সর্বশেষ টেস্ট ম্যাচটি খেলেছে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে।
করোনার বিরতি কাটিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট খেললেও টেস্টের প্রস্তুতি সেভাবে নেওয়া হয়নি বাংলাদেশের। এক বছর আগে খেলা টেস্টের পর কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাচও খেলেনি বাংলাদেশ। এতদিন পরে মাঠে নেমে ৫ দিন খেলার জন্য মানসিক যে প্রস্তুতির দরকার, সেটাতে ঘাটতি থেকে যেতে পারে। ফিটনেসেও থাকতে পারে 'ইস্যু'। যদিও ওয়ানডে সিরিজের পরদিনই টেস্টের প্রস্তুতি শুরু করা বাংলাদেশ সবদিক থেকেই প্রস্তুত আছে বলে জানাচ্ছেন কোচরা।
এক বছর পর টেস্ট খেলতে নেমে বাংলাদেশ অবশ্য অস্বস্তিতে নেই। প্রতিপক্ষ দ্বিতীয় সারির দল হওয়ায় বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে না। এ ছাড়া প্রথম টেস্ট খেলতে নামার আগে সুখস্মৃতিতেও চোখ বুলিয়ে নিতে পারছে বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সর্বশেষ দুটি টেস্টেই বাংলাদেশ জিতেছে। এর মধ্যে একটি জয় আবার ইনিংস ব্যবধানে।
প্রথম টেস্টের ভেন্যু চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামেও রেকর্ড বাংলাদেশের পক্ষে। ২০১১ সাল থেকে এই মাঠে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে দুটি টেস্ট খেলে অপরাজিত আছে বাংলাদেশ। ১০ বছর আগের সেই ম্যাচে উইন্ডিজের বিপক্ষে ড্র করেছিল মুশফিকুর রহিমের নেতৃত্বাধীন দলটি । সর্বশেষ ম্যাচে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে ৫৪ রানের রোমাঞ্চকর জয় পায় বাংলাদেশ।
অতীত রেকর্ড, প্রতিপক্ষের বর্তমান শক্তিমত্তা, সব মিলিয়ে লাল বলের ক্রিকেটে দারুণ কিছু করে দেখানোর অপেক্ষায় বাংলাদেশ। তারপরও অবশ্য ক্যারিবীয়দের কয়েকজন ক্রিকেটারকে নিয়ে সতর্ক থাকতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ক্যারিবীয়দের পেস আক্রমণে থাকা শ্যানন গ্যাব্রিয়েল, কেমার রোচ ও আলজারি জোসেফের গতির ঝড় সামলাতে হবে তামিম, মুশফিক, সাকিবদের।
সঙ্গে যোগ হয়েছে দীর্ঘদেহী স্পিনার রাকিম কর্নওয়াল ভীতি। তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচে ৫ উইকেট নেওয়ার পর থেকে ডানহাতি এই অফ স্পিনারকে নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে বাংলাদেশের। প্রস্তুতি ম্যাচে স্পিন ভেল্কি দেখানো জোমেল ওয়ারিক্যানকে নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। ব্যাটিংয়ে উইন্ডিজ অধিনায়ক ক্রেইগ ব্রাথওয়েট, জার্মেইন ব্ল্যাকউড, জশুয়া ডা সিলভা, জন ক্যাম্পবেল, কাইল মেয়ার্স, এনক্রুমাহ বোনার, রাকিম কর্নওয়ালরা হতে পারেন চিন্তার কারণ।
ঘরের মাঠে টেস্ট বলে স্বাভাবিকভাবেই স্পিন, পেস আক্রমণ নিয়ে আলোচনা আছে। এরআগে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বলেছিলেন, ঘরের মাঠে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ীই খেলবে বাংলাদেশ। দুদিন পর প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গোও একই কথা জানান। সেই হিসেবে স্পিন নির্ভর আক্রমণই হওয়ার কথা। তবে দুইজন পেসার খেলানোর সম্ভাবনাও আছে।
তেমন হলে স্পিন আক্রমণ সামলাবেন সাকিব আল হাসান, তাইজুল ইসলাম ও নাঈম হাসান। মেহেদী হাসান মিরাজকে বসে থাকতে হতে পারে। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর প্রথম টেস্ট খেলতে যাওয়া সাকিবের ম্যাচ ফিটনেস নিয়ে আলোচনা থাকলেও মুমিনুল জানিয়েছেন, তার আশা বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারকে নিয়েই মাঠে নামবে বাংলাদেশ। গত কয়েক বছরে টেস্টে বাংলাদেশের অটো চয়েজে পরিণত হওয়া আবু জায়েদ রাহির খেলা নিশ্চিত। দ্বিতীয় পেসার হিসেবে বিবেচনায় আছেন এবাদত হোসেন ও মুস্তাফিজুর রহমান।
টেস্টে সাধারণত রাহির সঙ্গী হিসেবে এবাদতকেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এবারও তেমনই ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু মুস্তাফিজকে নিয়ে ডমিঙ্গোর বলা কথায় মনে হয়েছে, একাদশে এবাদতের বদলে মুস্তাফিজকেও দেখা যেতে পারে। এসব নিয়ে ম্যাচের আগেরদিন কিছু বলেননি অধিনায়ক মুমিনুল। তিনি বলেন, 'উইকেটের কন্ডিশন বুঝে ওভাবেই দল সাজানো হবে।' ডমিঙ্গো জানিয়ে রেখেছেন, চট্টগ্রামের উইকেটে পেসাররা হুমকি হয়ে উঠতে পারবেন বলে মনে হয় না তার কাছে। তাই চার স্পিনার নিয়ে একাদশ সাজালেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
উদ্বোধনী জুটিতে তামিম ইকবালের সঙ্গী বাছাই নিয়েও আছে আলোচনা। সাদমান ইসলাম অনিক ও সাইফ হাসানকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। এই পরীক্ষা শেষে বেছে নেওয়া হতে পারে সাদমানকে। টেস্ট শুরুর আগের দিন এই দুই ব্যাটসম্যানকে নিয়ে মাঠে আলোচনা করতে দেখা গেছে ডমিঙ্গোকে। কোচের সঙ্গে আলোচনা শেষে সেন্টার উইকেট ও নেটে দীর্ঘক্ষণ ব্যাটিং করেন সাদমান। কিন্তু সাইফ কিছুক্ষণ ব্যাটিং করেই থেমে যান। যা ইঙ্গিত দেয় তামিমের সঙ্গী হচ্ছেন সাদমানই।
ম্যাচ শুরুর আগের দিন হাল্কা অনুশীলন করেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। একাদশের আলোচনায় থাকা তিন পেসার রাহি, এবাদত, মুস্তাফিজের কেউ-ই বোলিং অনুশীলন করেননি। সাকিবকে নেটে বোলিং করেছেন কেবল তাসকিন আহমেদ। এ ছাড়া তিন স্পিনার তাইজুল, মিরাজ ও নাঈম শেষবারের মতো নিজেদের ঝালিয়ে নিয়েছেন।
বাংলাদেশ একাদশ (সম্ভাব্য): তামিম ইকবাল, সাদমান ইসলাম, নাজমুল হোসেন শান্ত, মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, লিটন কুমার দাস, তাইজুল ইসলাম, নাঈম হাসান, আবু জায়েদ রাহি ও মুস্তাফিজুর রহমান/এবাদত হোসেন।