দুর্দান্ত বোলিংয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে স্মরণীয় সিরিজ জয় বাংলাদেশের
ব্যাটিংয়ের পর হয়তো হতাশাতেই ছিল বাংলাদেশ। সংগ্রহটা যে প্রথম টি-টোয়েন্টির চেয়েও আজ কম! তবু খেই হারায়নি বাংলাদেশ, বল হাতে দারুণ কিছু করার প্রত্যয় নিয়ে মাঠে নেমে দুর্বার বোলিং করে তারা। এক ওভারে ২ উইকেট নিয়ে শুরুটা করে দেন তাসকিন আহমেদ। এরপর বল হাতে দাপট চলে শেখ মেহেদি হাসান, তানজিম হাসান সাকিব, হাসান মাহমুদ, রিশাদ হোসেনদেরও। যে দাপটের সামনে যথেষ্ট হলো না রস্টন চেস ও আকিল হোসেনের লড়াই। দুর্দান্ত বোলিং প্রদর্শনীতে অসাধারণ জয় তুলে নিলো বাংলাদেশ।
বুধবার সেন্ট ভিনসেন্টের আর্সে ভেলে তিন ম্যাচ সিরিজের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৭ রানে হারিয়েছে লিটন কুমার দাসের দল। এই জয়ে এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ। আগের ম্যাচেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে তাদেরকে প্রথমবারের মতো হারানোর স্বাদ নেওয়া দলটি আজ মাতলো সিরিজ জেতার আনন্দে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে এটাই বাংলাদেশের প্রথম টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়, সব মিলিয়ে এই ফরম্যাটে দ্বিতীয় সিরিজ জয়। এর আগে ২০১৮ সালে ২-১ ব্যবধানে ক্যারিবীয়দের হারিয়েছিল বাংলাদেশ।
টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নামা বাংলাদেশ আজও টি-টোয়েন্টি মেজাজে ব্যাটিং করতে পারেনি। শুরুর ধাক্কা সামলে জুটি গড়ে কিছুটা পথ এগিয়ে দেন মেহেদী হাসান মিরাজ ও সৌম্য সরকার। আর শেষের দিকে ঝড় তোলেন ম্যাচসেরা শামীম হোসেন পাটোয়ারী। মূলত তার ব্যাটেই ৭ উইকেটে ১২৯ রানে পৌঁছায় বাংলাদেশ। জবাবে বাংলাদেশের দুর্বার বোলিংয়ের সামনে দিক হারিয়ে ফেলা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জয়ের পথে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন চেস ও আকিল। স্বাগতিকরা ১৮.৩ ওভারে ১০২ রানে অলআউট হয়।
ছোট লক্ষ্য তাড়ায় দাপুটে শুরু করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই ওপেনার ব্র্যান্ড কিং ও জনসন চার্লস, ২ ওভারে স্বাগতিকদের স্কোরকার্ডে যোগ হয় ১৯ রান। তবে ক্যারিবীয়দের এই ধারায় থাকতে দেননি নিজের প্রথম ওভারে দুর্দান্ত বোলিং করা তাসকিন আহমেদ। এই ওভারে কিং ও আন্দ্রে ফ্লেচারকে ফিরিয়ে দেন ডানহাতি এই পেসার। মেডেনসহ ২ উইকেট নিতে পারতেন তিনি, কিন্তু হাসান মাহমুদের মিসে একটি চার হজম করতে হয় তাসকিনকে।
কিং ৫ বলে একটি চারে ৮ রান করেন, ফ্লেচার রানের খাতা খুলতে পারেননি। পরের ওভারে তোপ দাগেন আগের ম্যাচের নায়ক শেখ মেহেদি। ডানহাতি এই অফ স্পিনার লেগ স্পিনে বোকা বানান ১২ বলে ২টি চার ও একটি ছক্কায় ১৪ রান করা জনসন চার্লসকে। এলবিডব্লিউ থেকে বাঁচতে রিভিউ নেন চার্লস, কিন্তু বাঁচতে পারেননি তিনি। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তই বহাল থাকে।
পরের ওভারে তাসকিন দেন ৩ রান, এরপর বোলিংয়ে এসে দারুণ এক ডেলিভারিতে নিকোলাস পুরানকে ফিরিয়ে দেন শেখ মেহেদি। পাওয়ার প্লেতে ৪ উইকেটে ৩২ রান তোলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সপ্তম ওভারে আরও এগিয়ে যেতে পারতো বাংলাদেশ। কিন্তু তানজিম সাকিবের করা ওভারের তৃতীয় বলে রভম্যান পাওয়েল ক্যাচ দিলেও নিতে পারেননি স্লিপে দাঁড়ানো সৌম্য সরকার।
এই ভুল পরের ওভারেই যৌথ প্রযোজনায় শুধরে নেন হাসান ও মিরাজ। হাসানের করা পা বরাবর ডেলিভারি ফ্লিকের চেষ্টা করলেও ব্যাটে বলে করতে পারেননি রভম্যান। বল উল্টো দিকে মোড় নিয়ে চলে যায় ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে। ঝাঁপিয়ে পড়ে দারুণ ক্যাচে ক্যারিবীয় অধিনায়ককে ফেরান মিরাজ। অষ্টম ওভারেও উইকেট মেলে। তানজিম সাকিবের বলে রোমারিও শেফার্ডকে এলবিডব্লিউতে আউট দেন আম্পায়ার। রিভিউ নিয়ে এ যাত্রায় বাঁচেন শেফার্ড।
যদিও তাকে টিকতে দেননি সাকিব, এক বল পরই বাউন্সারে শেফার্ডকে পরাস্থ করেন বাংলাদেশের এই পেসার। ৯ ওভার শেষে ৬ উইকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৪২ রান। এমন অবস্থায় উইকেটে থিতু হতে বেশ সময় নেন রস্টন চেস ও আকিল হোসেন, তাতে বাড়তে থাকে রান-বলের ব্যবধান। মিরাজের করা ১২তম ওভার থেকে ৮ রান তুলে কিছুটা গতি বাড়ান তারা। যদিও পরের দুই ওভারে একই ধারায় থাকতে পারেননি তারা। ৩৬ বলে ক্যারিবীয়দের প্রয়োজন দাঁড়ায় ৬৯ রান।
চেস ও আকিলই লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন, যদিও প্রয়োজন অনুযায়ী রান তুলতে পারছিলেন না তারা। তবে ১৬তম ওভারে চিত্র পাল্টায়, হাসানের করা প্রথম দুই বলে ছক্কা মারেন চেস। এ ওভার থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পায় ১৬ রান। পরের ওভারের দ্বিতীয় বলে রিশাদ হোসেনকে ছক্কা মারেন আকিল। কিন্তু ঘুরে দাঁড়াতে সময় নেননি এই লেগ স্পিনার। টানা দুই বলে তিনি ফিরিয়ে দেন চেস ও গুডাকেশ মোটিকে। অনেকক্ষণ লড়া চেস ৩৪ বলে একটি চার ও ২টি ছক্কায় ৩২ রান করেন।
এরপর গুডাকেশ মোটি ও আলজারি জোসেফ দ্রুতই সাজঘরে ফেরেন। ১৯তম ওভার পর্যন্ত লড়াই চালান আকিল। তাসকিনের তৃতীয় শিকারে পরিণত হওয়ার আগে বাঁহাতি এই স্পিনার ৩১ বলে ২টি ছক্কায় ৩১ রান করেন। অসাধারণ বোলিংয়ে দলকে নেতৃত্ব দেওয়া তাসকিন ৩.৩ ওভারে ১৬ রানে ৩টি উইকেট নেন। শেখ মেহেদি ৪ ওভারে একটি মেডেনসহ ২০ রানে পান ২ উইকেট। তানজিম সাকিবের শিকারও ২ উইকেট, ৪ ওভারে একটি মেডেনসহ তার খরচা ২২ রান। রিশাদ ৩ ওভারে ২ রানে পান ২ উইকেট। হাসান ৩ ওভারে একটি মেডেনসহ ২৩ রানে নেন একটি উইকেট। এক ওভার বোলিং করা মিরাজ ৮ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকেন।
এর আগে উদ্বোধনী জুটিতে পরিবর্তন এনে ব্যাটিংয়ে নামে বাংলাদেশ। তানজিদ হাসান তামিমের বদলে সৌম্য সরকারের সঙ্গে উইকেটে যান লিটন কুমার দাস। কিন্তু জায়গা বদলেও সফল হতে পারেননি লম্বা সময় ধরে রানখরায় থাকা ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। শুরু থেকেই উইন্ডিজ স্পিনার আকিলের বিপক্ষে ধুঁকতে থাকা লিটন তৃতীয় ওভারেই বিদায় নেন। আকিলের বলে এগিয়ে গিয়ে খেলার চেষ্টা করা বাংলাদেশ অধিনায়ক স্টাম্পিং হন।
কোনো ফরম্যাটেই ব্যাট কথা বলাতে না পারা লিটন ১০ বলে ৩ রান করে সাজঘরে ফেরেন। ৮ রানে প্রথম উইকেট হারানো বাংলাদেশের বিপদ বাড়ে তিন রান পরই। দলীয় ১১ রানে তাসজিদের স্টাম্প উপড়ে নেন আরেক স্পিনার চেস। শুরু থেকেই ক্যারিবীয় স্পিনারদের বিপক্ষে রান তুলতে ভুগছিল বাংলাদেশ, এর সঙ্গে দুই উইকেটের পতনে রান তোলার গতি একেবারেই কমে আসে।
কিছু সময়ের জন্য চাপ সামলে নিলেও সৌম্য ও মিরাজ সেভাবে রান তুলতে পারছিলেন না। পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে ২ উইকেটে ২৯ রান তোলে বাংলাদেশ। এই রানও সম্ভব ছিল না, যদি কিনা মিরাজ রান না করতেন। আফিফ হোসেন ধ্রুবর জায়গায় সুযোগ পাওয়া ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান ধাক্কা সামলানোর পাশাপাশি রান তোলাতেও মনোযোগী ছিলেন।
আগের ম্যাচে বাংলাদেশকে ভোগানো আকিল আজও দুর্দান্ত বোলিং করেন, ৭ ওভারের মধ্যে নিজের কোটা পূর্ণ করা বাঁহাতি এই স্পিনার ৪ ওভারে মাত্র ১৬ রানে একটি উইকেট নেন। এর মাঝেও তার এক ওভারে একটি করে ছক্কা ও চার মারেন মিরাজ, এই ওভার থেকে আসে ১১ রান। তবে এমন ওভার বেশি আসেনি সৌম্য-মিরাজের জুটির পথচলায়। নবম ওভারে রান আউটে কাটা পড়েন ১৮ বলে একটি চারে ১১ রান করা সৌম্য।
পরের ওভারে আরও চাপে পড়ে বাংলাদেশ, আলজারি জোসেফকে পুল করে সীমানার কাছে ব্র্যান্ডন কিংয়ের হাতে ধরা পড়েন মিরাজ। এর আগে ২৫ বলে ৩টি চার ও একটি ছক্কায় ২৬ রান করেন তিনি। তৃতীয় উইকেটে সৌম্য-মিরাজের জুটি থেকে ৩১ বলে আসে ২৮ রান। ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশ ১০ ওভারে ৪৫ রান তোলে। ১১তম ওভারে আরেকটি উইকেটের পতন, ৪ বলে ৫ রান করে ফিরে যান রিশাদ হোসেন।
আবারও চাপে পড়ে যাওয়া বাংলাদেশকে পথ দেখানোর দায়িত্ব পড়ে জাকের আলী অনিক ও শেখ মেহেদির ওপর। এই দুজনের লড়াইয়ের মাঝে দ্বিতীয় দফায় হানা দেয় বৃষ্টি। ১১.৫ ওভারের সময় খেলা বন্ধ হয়, বন্ধ থাকে ২৫ মিনিট। খেলা শুরুর পর টি-টোয়েন্টি মেজাজে রান তুলতে পারছিলেন না জাকের-শেখ মেহেদি। উল্টো ১৫তম ওভারে ভাঙে তাদের ২০ রানের জুটি।
গুডাকেশ মোটির বলে বোল্ড হওয়ার আগে ১১ বলে একটি চারে ১১ রান করেন শেখ মেহেদি। এরপর জাকেরও টিকতে পারেননি। ওবেদ ম্যাকয়ের করা ১৭তম ওভারের প্রথম বলে উড়িয়ে মারতে গিয়ে রভম্যানের হাতে ধরা পড়েন ২০ একটি করে চার ও ছক্কায় ২১ রান করা ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। এরপর শামীম হোসেন পাটোয়ারী ও তানজিম সাকিবের ব্যাটে এগোয় বাংলাদেশ।
দলের সবাই রান তুলতে সংগ্রাম করলেও শেষ দিকে উইকেট গিয়ে ঝড়ো ব্যাটিং করেন শামীম। ১৭ বলে ২টি করে চার ও ছক্কায় হার না মানা ৩৫ রান করেন তিনি, যা বাংলাদেশের ইনিংসের সর্বোচ্চ। তানজিম সাকিব ১১ বরে একটি চারে অপরাজিত ৯ রান করেন। এ দুজনের জুটি থেকে ২৩ বলে মূল্যবান ৪১ রান পায় বাংলাদেশ, এটাই সফরকারীদের ইনিংসের সেরা জুটি। ৪ ওভারে ২৫ রানে ২ উইকেট নেন মোটি। একটি করে উইকেট পান চেস, আলজারি ও ম্যাকয়।