কাগজপত্রের সত্যায়ন: এই ঔপনিবেশিক রীতির ভোগান্তি শেষ হবে কবে?
ছোট একটি ফটোকপি দোকানের কাগজের স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ এম হান্নান শাহ। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদের জন্য আবেদন করবেন তিনি। এজন্য এখন পর্যন্ত দোকান থেকে দশ সেট কাগজপত্র ফটোকপি (অনুলিপি) করেছেন।
তবে এখানেই শেষ নয়; প্রতিটি কাগজে আবার প্রয়োজন একজন প্রথম শ্রেণির গেজেটেড সরকারি কর্মকর্তার স্বাক্ষরসহ 'অ্যাটেস্টেড বা সত্যায়িত' লেখা মূল্যবান সিলমোহর।
"আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া কাগজাদি, একই বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিতেই আবার সত্যায়িত করা লাগছে। আর একজন কর্মকর্তা খুঁজতে গিয়ে দিনের পর দিন সময় চলে যাচ্ছে। এটা সত্যিই হাস্যকর", হতাশ কণ্ঠে বলেন হান্নান।
একই ধরনের সমস্যায় পড়েছেন আইন বিভাগ থেকে পাশ করা আবির মাহমুদও। বার কাউন্সিলের নিবন্ধন ফরম সত্যায়নের জন্য একজন সরকারি কর্মকর্তা খুঁজে বের করতে এ-দরজা থেকে ও-দরজায় কড়া নাড়ছেন। সত্যায়ন কেন গুরুত্বপূর্ণ, এ প্রশ্নে হতাশার সুরে বললেন, "আসলে, এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ আমি জানি না। এটা নিছক আরেকটা হয়রানি।"
এই অপ্রয়োজনীয় প্রক্রিয়ার খরচ শুধু সময় আর শ্রমে সীমাবদ্ধ নয়—অনেকে এতে আর্থিক ক্ষতিরও শিকার হন।
মানবাধিকার কর্মী জাহিদুল ইসলাম তার জাতীয় পরিচয়পত্রে একটি ত্রুটি সংশোধনের অভিজ্ঞতার কথা জানান আমাকে। তিনি বলেন, "আমি অনেক ঝামেলার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। কিছু কাগজপত্র সত্যায়িত করতে হয়েছিল। কিন্তু কাউকে না পেয়ে এক দালালের সাহায্য নিই। শেষমেশ দালাল আমার সব টাকা মেরে দেয়।"
অবশ্য আমার নিজের অভিজ্ঞতাও খুব একটা ভালো নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় আমাকে আমার সব ছবি এবং অন্যান্য কাগজপত্র সত্যায়িত করতে বলা হয়েছিল। কোথায় যাবো তা বুঝতে পারছিলাম না। আমার এক বন্ধুরও একই সমস্যা। সৌভাগ্যক্রমে চারুকলা অনুষদের একজন শিক্ষকের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল তার। তাই আমরা উনার কাছে গিয়ে সকল কাগজপত্র এবং ছবি সত্যায়ন করিয়ে নিই।
যদি ওই শিক্ষক আমাকে না চিনেও আমার কাগজপত্র সত্যায়ন করতে পারেন, তাহলে আমার বিভাগের শিক্ষকরা কেন এটা পারলেন না? এমন অর্থহীন নিয়মে ওইসময় আমি বেশ হতাশ ও বিভ্রান্ত হয়েছিলাম বলা চলে।
আমার, হান্নান কিংবা জাহিদুলের মতো দেশজুড়ে অসংখ্য শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা প্রতিনিয়ত এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন। আপনার কাগজে কী লেখা আছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, আগে তা সত্যায়িত করে আনতে হবে।
ডিজিটালাইজেশনের যুগে এসেও ঔপনিবেশিক আমলের এই প্রথা এখনও প্রশাসনিক কাজ সহজ করার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হিসেবে রয়ে গেছে। এটি শুধু সময় এবং অর্থের অপচয়ই নয়, অপ্রয়োজনীয় হয়রানিরও কারণ। কাগজপত্র সত্যায়নের এই প্রক্রিয়া বর্তমান সময়ে এসে দরকারি মনে না হলেও, এটি এখনও বাংলাদেশের সকল অফিস, আদালতের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ
সত্যায়নের ক্ষেত্রে, আপনার কাগজপত্রে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার সিল ও স্বাক্ষরের প্রয়োজন পড়ে। সরকারি কর্মকর্তার এই সিল-স্বাক্ষরই আপনার এবং আপনার কাগজপত্রের সত্যতার দলিল।
হান্নানকে শুধু নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রভাষকের পদের জন্য আবেদন করতে ১৮০টির বেশি নথি সত্যায়িত করতে হয়েছে—এ যেন এক বিশাল ধকল।
তার মতে, সত্যায়নের প্রক্রিয়া হয়রানি ছাড়া আর কিছুই না, বরং এটি সমস্যা সমাধানের বদলে তা আরও জটিল করে তোলে। অনেকের কাছেই কাগজপত্রের সত্যায়ন এখন প্রশাসনিক ভোগান্তির আরেক নাম।
বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক সরকারি অফিস এবং বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ডাটাবেসের মাধ্যমে সরাসরি কারও তথ্য যাচাই করতে পারে। তবে, সত্যায়নের এই চিরাচরিত প্রথা এখনও সিল, স্ট্যাম্প এবং স্বাক্ষরের ওপর নির্ভরশীল।
যারা গেজেটেড অফিসারের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ পান না, তাদের বিকল্প পদ্ধতি খুঁজে নিতে হয়। পরিচিতি কোনো কর্মকর্তা না থাকলে, অনেকই টাকা দিয়ে নকল সিল জোগাড় করেন অথবা দালালের সাহায্য নেন।
সদ্য স্নাতক পাশ করা ইয়াসির আরাফাত জানিয়েছেন, তার অনেক বন্ধুই ঢাকার নীলক্ষেত থেকে নকল সিল কিনে সত্যায়নের কাজ চালিয়ে নিয়েছেন। ভুয়া সত্যায়ন এতটাই সাধারণ হয়ে উঠেছে যে অনেকে এটাকে মজার ছলেই দেখেন । কেউ কেউ বলেন, এরকম না করে উপায়ও নেই।
নকল সিল ব্যবহারের কাহিনি শুনালেন চাকরিপ্রার্থী বুলবুল (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, "আমার চাচাতো ভাই আমার কাছে কিছু কাগজপত্র নিয়ে এসেছিল, যেগুলো তাকে সত্যায়িত করতে হবে। আমি সই করতে অস্বীকার করায় সে খুব রেগে গিয়েছিল। শেষমেশ, সে নীলক্ষেত থেকে ৫০ টাকায় একটি নকল সিল কিনে নিজেই সব কিছু 'সত্যায়িত' করে"।
এই পরিস্থিতি যে তাদেরকে একটি নৈতিক দোটানার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল তাও স্বীকার করেন তিনি।
অনেক শিক্ষার্থী সত্যায়ন করতে গিয়ে আবার হেনস্তারও শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ জানিয়েছেন, কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সত্যায়ন চাইতে গিয়ে তারা এমন আচরণের শিকার হয়েছেন যেন, তিনি কোনো অনুগ্রহ চাইতে অথবা ব্যক্তিগত কাজের জন্য তদবির করতে তার (কর্মকর্তা) কাছে এসেছেন।
সত্যায়ন করতে গিয়ে নিয়মের বেড়াজালে পড়ে সময়ও নষ্ট হয় অনেকের। এমনই অভিজ্ঞতার কথা জানা গেল, এক শিক্ষার্থী সাকাব নাহিয়ানের মুখ থেকে। তিনি জানান, ঢাকা শিক্ষাবোর্ড থেকে সনদ সত্যায়িত করতে তাকে প্রথমে অনলাইনে আবেদন করতে হয়েছে। এরপর লাইনে দাঁড়িয়ে ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার পর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বোর্ড অফিসে জমা দিতে হয়েছে। সব প্রক্রিয়া শেষ করে সেই সনদ সত্যায়িত হয়ে তার হাতে আসতে লেগেছে আরও তিন থেকে চার দিন।
সত্যায়ন করতে গিয়ে শুধু আবেদনকারীরাই হয়রানির শিকার হন এমন না, অনেকের জন্য তা দুর্নীতি ও প্রতারণার সুযোগও তৈরি করে দেয়। এসব কাজ সহজ করে দিতে বিভিন্ন সরকারি অফিসের আশেপাশে দালালদেরও ঘুরঘুর করতে দেখা যাবে। টাকার বিনিময়ে তারা কোনো ভোগান্তি ছাড়াই আপনার কাজ করিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেবে। ঝামেলা এড়াতে ও সময় বাঁচাতে অনেকেই তখন দালালের আশ্রয় নেন।
দালাল নিয়ে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে নাহিয়ান বলেন, 'আমি আমার বিদেশে পড়ুয়া এক আত্মীয়ের কয়েকটি সনদ সত্যায়িত করতে একবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলাম। শুরুতেই ভেবে নিয়েছিলাম, নিজে নিজেই এই কাজ করিয়ে নেব, কোনো দালালের সাহায্য নেব না; যেহেতু এর আগেও আমি একই জায়গা থেকে তার (আত্মীয়) হয়ে কাগজ সত্যায়ন করিয়েছি, কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু এবার কোনো কারণে দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তা বেঁকে বসেন। বলেন, আবেদনকারীকে নিজে অথবা তার পিতামাতাকে আসতে হবে সত্যায়ন করানোর জন্য। সময় স্বল্পতায় শেষমেশ বাধ্য হয়ে দালালের সাহায্য নিই। ১৫০০ টাকার বিনিময়ে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঠিক একই কর্মকর্তার সিল-স্বাক্ষরসহ সত্যায়িত সনদ আমার হাতে চলে আসে।'
ব্যর্থ প্রচেষ্টা
সত্যায়ন প্রক্রিয়া বাতিলের দাবি নতুন কিছু নয়। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের নাগরিকরা এই পুরোনো ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের মতে, এই ব্যবস্থার মূল ফলাফল হচ্ছে ভোগান্তি আর অনিয়মের প্রসার।
সমালোচকরা একে ঔপনিবেশিক আমলের একটি পরম্পরা হিসেবে দেখেন, যা এখন কার্যকারিতার চেয়ে বোঝা বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের জন্য এটি সহযোগিতা করার বদলে সৃষ্টি করছে ঝামেলা ও প্রতিবন্ধকতা।
প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১৪ সালে নথি সত্যায়নের প্রয়োজনীয়তা বাতিল করে স্ব-সত্যায়নের একটি পদ্ধতি চালু করে। এর ফলে আবেদনকারীদের ওপর প্রশাসনিক চাপ কমে এবং তাদের জবাবদিহিতার সুযোগ বাড়ে। বাংলাদেশেও এই ধরনের উদ্যোগ কার্যকর হতে পারে, বিশেষ করে গত কয়েক বছরে গড়ে ওঠা ডিজিটাল ব্যবস্থার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার সরকারি চাকরির কিছু আবেদনে সত্যায়নের বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এর পরিবর্তে আবেদনকারীরা সাক্ষাৎকারে মূল নথিপত্র প্রদর্শন করবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তবে এই পরিবর্তন পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। অনেক আবেদনেই এখনও সত্যায়নের প্রয়োজন থাকে। এই অসংগতি অনেককেই ভাবতে বাধ্য করেছে, সত্যায়ন প্রক্রিয়া পুরোপুরি বাতিল করার প্রতিশ্রুতি আসলেই কতটা বাস্তবসম্মত।
প্রযুক্তি বনাম রীতি
বাংলাদেশে ধীরে ধীরে ডিজিটাল পদ্ধতির প্রসার সত্যায়ন প্রক্রিয়ার ঝামেলা কমানোর বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। এখন শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ব্যক্তিগত তথ্য অনেক ক্ষেত্রেই অনলাইনে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কাগজের সনদ হারিয়ে যাওয়ার, নষ্ট হওয়ার বা চুরি হওয়ার ভয় থাকে, ডিজিটালে সেই ভয় নেই, যা সত্যায়নের পুরোনো নিয়মকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই ডিজিটাল ভর্তি ব্যবস্থা চালু করেছে। মোবাইল নোটিফিকেশন আর অনলাইন যাচাই ব্যবস্থার মাধ্যমে বাস্তব সময়েই তথ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে।
অনলাইন কলেজ ভর্তি পদ্ধতি অনেক সফলতা পেয়েছে, যা অন্য ক্ষেত্রেও অনুসরণ করা যেতে পারে। সত্যায়নের বদলে অনলাইন যাচাই চালু করা গেলে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের জন্য এই অযথা প্রক্রিয়া অনেক সহজ হয়ে যাবে।
পরিবর্তনের দাবিতে নতুন প্রজন্ম
বাংলাদেশের তরুণরা এমন একটি ব্যবস্থায় হতাশ, যা তাদের অপরাধী বা অবিশ্বস্ত মনে করে যতক্ষণ না তারা তা একটি সিল দিয়ে প্রমাণ করতে পারে। তারা এর বদলে এখন সহজ এবং ন্যায্য একটি প্রক্রিয়ার দাবি জানাচ্ছে।
অনেকেই সত্যায়নের পরিবর্তে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট চালুর দাবি করছেন, যা একটি নিরপেক্ষ ও বিস্তারিত যাচাই প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করতে পারে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিষয়টির গুরুত্ব স্বীকার করেছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, শিক্ষা খাতের মতো কম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সত্যায়নের নিয়ম শিথিল করা হতে পারে। তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংশয় থেকেই যাচ্ছে, কারণ এর আগেও তারা এমন প্রতিশ্রুতি শুনেছে, যার বাস্তবায়ন এখনও হয়নি।
ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করতে থাকা বাংলাদেশের নাগরিকরা এখন পুরোনো প্রথাগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। সত্যায়ন ব্যবস্থা শুধু একটি প্রশাসনিক ঝামেলা নয়, এটি একটি প্রশাসনিক সংস্কৃতির প্রতিফলন, যা অপ্রয়োজনীয় নিয়মকানুন আঁকড়ে ধরে আছে। তথ্য যাচাইয়ের আধুনিক পদ্ধতি এবং সফল ডিজিটাল উদ্ভাবনগুলো ইতোমধ্যে কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও শারীরিক সত্যায়নের এই দাবি এখন আরো অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে।
মূল লেখা থেকে অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন