দ্বীপ কিনে নিজস্ব জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন তারা
২০১৮ সালে পরিচিত কয়েকজনকে নিয়ে মার্শাল মেয়ার 'লেটস বাই অ্যান আইল্যান্ড' (চলো একটি দ্বীপ কিনি) নামের একটি ক্রাউডফান্ড বা গণ-অর্থায়ন প্রকল্প শুরু করেন। এক বছরের মধ্যে আড়াই লাখ ডলারের মতো সংগ্রহ করে এই গ্রুপ। সেই অর্থে খুঁজে পায় একটি ছোট দ্বীপও।
ক্যারিবীয় সাগরবর্তী দেশ বেলিজের উপকূলে ১ দশমিক ২ একরের একটি জনবসতিহীন দ্বীপ খুঁজে পান তারা। দ্বীপের নাম 'কফি কায়ে'।
বিনিয়োগকারীরা বেলিজ সরকারের কাছ থেকে শুধু দ্বীপটি কিনেই থামেনি, পরিকল্পনা অনুযায়ী এই দ্বীপকে একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবেও ঘোষণা করে তারা। এই ক্ষুদ্র জাতিরাষ্ট্র বা মাইক্রোন্যাশনের নাম দেওয়া হয়, 'প্রিন্সিপালিটি অব আইল্যান্ডিয়া'।
"মাইক্রোন্যাশন" হচ্ছে একটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, যারা নিজেদের স্বাধীন বলে দাবি করে, কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি পায় না। আইল্যান্ডিয়ারও নিজস্ব জাতীয় পতাকা, সঙ্গীত এবং সরকার রয়েছে।
এবছর, প্রথমবারের মতো কফি কায়ে সফরে আসেন বিনিয়োগকারীদের দল। সঙ্গে আসেন অনেক আগ্রহী পর্যটকও। বিশ্বের প্রথম গণ-অর্থায়নে কেনা দ্বীপ বলে কথা!
এই সফরে নেতৃত্ব দেন মেয়ার। বেলিজ সিটি থেকে ১৫ মিনিট বোটে চড়ে দ্বীপে পৌঁছানোর পর মেয়ার বলেন, "নিজের বিনিয়োগ করা এবং কেনা দ্বীপে পা রাখার অনুভূতিটা সত্যিই দুর্দান্ত।"
কফি কায়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত মাত্র কয়েক মিনিটের হাঁটা পথ। দ্বীপ হিসেবে কফি কায়ে লম্বা, চিকন এবং কফি বিনের মতো আকৃতির। দ্বীপের এক পাশে ছোট একটি সৈকতও রয়েছে। সেই সৈকতেই তাঁবু নিয়ে সবাই ঘাঁটি গাড়ে। দ্বীপের অন্য পাশটি ঝোপঝাড়ে ভরা, এবং ম্যানগ্রোভে আবদ্ধ।
একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা
গণ-অর্থায়নের মাধ্যমে দ্বীপ কেনার ধারণা প্রথম দেন গ্যারেথ জনসন, ১৫ বছর আগে। তিনি লেটস বাই অ্যান আইল্যান্ড ডট কম (letsbuyanisland.com) ডোমেইন কিনে দ্বীপ খোঁজার কাজ শুরু করেন।
জনসন 'ইয়ং পায়োনিয়ার ট্যুর' নামের একটি সংস্থাও খুলেন, যার কাজ হচ্ছে ভ্রমণকারীদের উত্তর কোরিয়া, সিরিয়ার মতো দুর্গম ও বিপজ্জনক জায়গায় নিয়ে যাওয়া। ট্রান্সনিস্ট্রিয়া, আবখাজিয়া এবং নাগর্নো-কারাবাখের মতো অচেনা দেশগুলোতেও ট্যুরের পরিকল্পনা করে এই সংস্থা।
২০১৮ সালে ফিলিপাইনের একটি দ্বীপ বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। তখন জনসনের গণ-অর্থায়নে দ্বীপ কেনার ধারণাটি আবার পুনরুজ্জীবিত হয়।
মেয়ার বলেন, "গ্যারেথ (জনসন) যখন প্রথম আমাকে দ্বীপ কেনার কথা বলে, আমি শুরুতেই উড়িয়ে দিয়েছিলাম তার কথা। এটাও কি সম্ভব! তখন সে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে, একটি দ্বীপের দাম কত হতে পারে এবং জানায়, বিশ্বের এমন কিছু অংশ রয়েছে যেখানে দ্বীপ কেনা তেমন কঠিন না। বিশেষ করে অনেকে মিলে যদি আমরা তহবিল সংগ্রহ করি।"
এই প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা প্রাথমিকভাবে দ্বীপের প্রতিটি শেয়ারের দাম ঠিক করেন তিন হাজার ২৫০ ডলার। এখন পর্যন্ত এরকম শতাধিক শেয়ার বিক্রি হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের একাধিক শেয়ার কেনার সুযোগ থাকলেও গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রতি ব্যক্তি শুধু একটি ভোটই দিতে পারবেন।
এবার দ্বীপ কেনার পালা। অনেক গবেষণার পর ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, আয়ারল্যান্ড, পানামা এবং বেলিজের কিছু দ্বীপ নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়। তারপর হয় ভোটাভোটি। সবচেয়ে বেশি ভোট পড়ে কফি কায়ের ঘরে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এই দ্বীপে আবহাওয়া যেমন চমৎকার, তেমনি সেখানে পৌঁছানো ও দ্বীপ কেনার প্রক্রিয়াও তুলনামূলকভাবে সহজ।
অবশেষে, এক লাখ ৮০ হাজার ডলারে কেনা হয় কফি কায়ে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সম্পন্ন হয় এই লেনদেন। এরপরই মহামারি নেমে আসায় বন্ধ হয়ে যায় পরবর্তী সকল পরিকল্পনা।
বিচ্ছিন্ন ও পরীক্ষামূলক জাতিরাষ্ট্র
গণ-অর্থায়নে দ্বীপ কেনার দৃষ্টান্ত এটিই প্রথম হতে পারে, কিন্তু মাইক্রোন্যাশনের নজির কিন্তু অনেক আছে। অন্যান্য মাইক্রোন্যাশন থেকেই অনুপ্রেরণা নিয়েছে প্রিন্সিপালিটি অব আইল্যান্ডিয়া।
দ্য প্রিন্সিপালিটি অফ সিল্যান্ড এমন একটি মাইক্রোন্যাশন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়াইয়ের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত ইংল্যান্ড উপকূলের এই দ্বীপের নতুন মালিকেরা ১৯৬৭ সালে একে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, উজুপিস প্রজাতন্ত্র। এটি লিথুয়ানিয়ার ভিলনিয়াসে অবস্থিত একটি ভূখণ্ড, যার নিজস্ব সংবিধান রয়েছে। এখানকার অধিবাসীরা নিজেদের স্বাধীন বলে দাবি করে।
কফি কায়েকে মাইক্রোন্যাশনে পরিণত করার ব্যাপারে জনসন বলেন, "নিজে একটি দেশ গড়ার স্বপ্ন কে না দেখে? বিশেষ করে ট্রাম্প-পরবর্তী, ব্রেক্সিট-পরবর্তী, কোভিডে জর্জরিত এই বিশ্বে? যদি সাধারণ কয়েকজন মানুষ মিলে এই কাজ করতে পারি আমরা, তাহলে এটি ভালোর পক্ষের শক্তি হিসেবেই হয়তো গড়ে উঠবে।"
আইল্যান্ডিয়াও অন্যান্য মাইক্রোন্যাশনের মতো একটি জাতি-রাষ্ট্রের সমস্ত ঐতিহ্যকে গ্রহণ করেছে। তাদের একটি নিজস্ব জাতীয় সঙ্গীত রয়েছে। রয়েছে পতাকাও। বিনিয়োগকারীদের নিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন করা হয়েছে একটি সরকারও।
কফি কায়ের বিনিয়োগকারী এবং দর্শনার্থীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রিন্সিপালিটি অব আইল্যান্ডিয়ার নাগরিক হয়ে যাবেন। এখানে নাগরিকত্ব কেনারও সুযোগ থাকবে। অর্থের বিনিময়ে লর্ড বা লেডি অব আইল্যান্ডিয়ার মতো উপাধি কিনতে পারবেন আপনি।
জাতি গঠনেরও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আইল্যান্ডিয়ার জাতিসত্তাকে অনেকে আবার বেশ গুরুত্বের সাথে নেন। যেমন জনসন আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছেন, "সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী না থাকলেও আমরা অন্য যেকোনো জাতির মতোই।"
মেয়ার যদিও একে একটি 'মার্কেটিং টুল' হিসেবে দেখেন। তিনি বলেন, দ্বীপে তাদের নিজস্ব আইন-কানুন প্রয়োগ করার সুযোগ থাকলেও (যেমন, প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ) কফি কায়ে এখনও বেলিজের সীমানার মধ্যেই পড়ে।
ভালোর পক্ষের শক্তি?
জনসনের 'লেটস বাই অ্যান আইল্যান্ড'-এর জন্য কফি কায়েকে খুঁজে দিয়েছিলেন বেলিজিয়ান রিয়েল এস্টেট এজেন্ট অস্কার ডি. রোমেরো। তিনি বলেন, "পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে এই গ্রুপের।"
ম্যানগ্রোভ এবং নিকটবর্তী ব্যারিয়ার রিফে কোনো কিছু স্থাপন করতে চাইলে সরকারের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে বলেও জানান তিনি।
রোমেরো আরও বলেন, "এই দ্বীপকে যদি টেকসইভাবে বিকশিত করা হয়, এখানে যদি স্থানীয় বেলিজিয়ানদের সুযোগ দেওয়া হয় এবং পরিবেশ সুরক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাহলে এই প্রকল্প ভালোর পক্ষের শক্তি হয়ে উঠতে পারে।"
কফি কায়ে এবং প্রিন্সিপালিটি অব আইল্যান্ডিয়ার ভবিষ্যৎ এখন এর বিনিয়োগকারীদের হাতে। দ্বীপটি কীভাবে বিকশিত হবে এবং মাইক্রোন্যাশনের স্বপ্ন আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না, তা-ই এখন দেখার বিষয়।
তবে কফি কায়ে এবং প্রিন্সিপালিটি অব আইল্যান্ডিয়া ইতোমধ্যেই একটি অদ্ভুত ভ্রমণপ্রেমী সম্প্রদায় তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। ট্রেনের কন্ডাক্টর থেকে শুরু করে সিইও, বিশ্বের ২৫টি ভিন্ন দেশ থেকে মানুষ বিনিয়োগ করেছে এই দ্বীপে।
মেয়ার এমনকি তার গার্লফ্রেন্ডকেও নিয়ে এসেছেন এই দ্বীপে। এবং এখানে এনেই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন তাকে (হ্যাঁ বলেছেন তার ভবিষ্যৎ সহধর্মিণী)। আরেকজন বিনিয়োগকারী, স্টিফেন রাইস বলেন, "আমার ঘুরতে যাওয়ার দর্শন ছিল এরকম- এক জায়গায় শুধু একবারই যাব। সেই দর্শনে পুরোপুরি তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে এই দ্বীপ। এরই মধ্যে তিনবার কফি কায়েতে এসেছি আমি।"
দ্বীপ ছেড়ে আসার সময় মেয়ার বলেন, "মানুষজন সত্যিই এই ধারণাতে বিশ্বাস রেখেছে। পাগলাটে এক ধারণা ছিল এটি। কিন্তু দ্বীপ কেনার প্রাথমিক পরিকল্পনা ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করেছি আমরা। এখন পরবর্তী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার পালা। কিন্তু কথা হচ্ছে, আর কোনো পরিকল্পনাই করা হয়নি। কারণ আমরা এতদূর আসব, এটাই কখনো কল্পনা করিনি।"
- সূত্র: সিএনএন