১৫০ কোটি টাকার শুটকি নিয়ে শঙ্কায় লালপুর শুটকিপল্লীর ব্যবসায়ীরা
শতবছর ধরে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের শুটকি তৈরি হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর শুটকি পল্লীতে। এ পল্লী থেকে বছরে ১৫০- ২০০ কোটি টাকার শুটকি বাজারজাত করা হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে গেল বছর করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ব্যবসা না হওয়ায় মজুদ করা শুটকি নষ্ট হয়ে অন্তত ১২ কোটি টাকার লোকসান হয় ব্যবসায়ীদের।
যদিও মহামারির প্রভাব কাটিয়ে গত ডিসেম্বর মাস থেকে স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল লালপুর শুটকি পল্লী, চলতি বছর বিক্রির জন্য প্রায় ১৫০ কোটি টাকার শুটকি মজুদ করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু আবারও করোনার সংক্রমণ হারে ঊর্ধ্বগতির কারণে শঙ্কায় পড়েছেন শুটকি পল্লীর ব্যবসায়ীরা। যদি করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে টানা লকডাউন দেওয়া হয় তাহলে এবার আরও বড় লোকসানে পড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীদের।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, শুটকির ক্রেতা মূলত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। আর করোনাভাইরাসের কারণে এই দুই শ্রেণির মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে করোনাকালে শুটকি ব্যবসায়ও মন্দা চলছিল। কিন্তু করোনার ধকল কাটিয়ে গত ডিসেম্বর মাস থেকে আবারও চাঙা হয়ে উঠেছিল শুটকি পল্লী। চলতি বছর বিক্রির জন্য প্রায় ১৫০ কোটি টাকার শুটকি মজুদ করেছেন লালপুর শুটকি পল্লীর ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর ইউনিয়নের লালপুর গ্রামটিতে শতবছর ধরে শুটকি তৈরি হওয়ায় গ্রামটিকে এখন শুটকি পল্লী হিসেবে চেনেন সবাই। এ পল্লীর কয়েকশ পরিবার শুটকি তৈরি ও বিক্রির সাথে যুক্ত।
লালপুর শুটকি পল্লীতে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় তিনশব্যবসায়ী আছেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছ এনে প্রক্রিয়াজত করে শুটকি তৈরি করা হয় এখানে। শুটকিগুলো গ্রামের মেঘনা নদীর পাশে মাচায় শুকানো হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাতকরণের পাশাপাশি ভারতেও রপ্তানি হয় লালপুরের শুটকি। লালপুর থেকে বাজারজাত হওয়া শুটকির প্রায় ৫০ ভাগই পুঁটি মাছের শুটকি।
বর্তমানে আকার ও মানভেদে শুটকি পল্লী থেকে প্রতি কেজি পুঁটি শুটকি বিক্রি হচ্ছে ১০০-৫০০ টাকা, ট্যাংরা আড়াইশ থেকে ৬০০ টাকা, চান্দা ৩৫০-৪৫০ টাকা, গইন্না ৩০০-৬০০ টাকা, বুজুরি আড়াইশ থেকে ৩৫০ টাকা এবং তারাবাইম শুটকি বিক্রি হচ্ছে ১০০০-১১০০ টাকা পর্যন্ত দামে।
মূলত অক্টোবর- মার্চ পর্যন্ত মাছ সংগ্রহ করে শুটকি তৈরির কর্মজজ্ঞ চলে শুটকি পল্লীতে। এসময় শুটকি তৈরি করে বেচাকেনার পাশাপাশি মজুদও করা হয়। পরবর্তী সময়ে মজুদকৃত শুটকিগুলো এপ্রিল- সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। তবে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব শুরুর পর পাইকারি ব্যবসায়ীরা শুটকি না নেওয়ায় ব্যবসায়ীদের গুদামে স্টক করে রাখা বেশিরভাগ শুটকি নষ্ট হয়ে যায়। এতে করে লোকসানের মুখে পড়েন ব্যবসায়ীরা। অনেকে ব্যবসায়ী পুঁজি সংকটে পড়েন।
লালপুর শুটকি পল্লীর ব্যবসায়ী সুকমল চন্দ্র দাস দ্য নিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বছরে আমি ১ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের শুটকি বিক্রি করতে পারি। দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসে আমাদের পল্লী থেকে শুটকি নিয়ে যান। করোনার কারণে মজুদকৃত শুটকি নষ্ট হয়ে আমার ৪-৫ লাখ টাকার লোকসান হয়। গত জানুয়ারি মাস থেকে আবারও শুটকি বেচাকেনা শুরু হেয়েছিল। এখন আবারও করোনায় প্রকোপ বাড়ায় আমার মজুদ করা শুটকি নিয়ে শঙ্কায় আছি।'
৩৫ বছর ধরে শুটকি ব্যবসা করছেন নারায়ণ চন্দ্র। তিনি টিবিএস-কে বলেন, 'করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসায় মন্দা চলায় শুটকি পল্লীর ব্যবসায়ীরা দুর্দিন পার করেছেন। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকায় গত ডিসেম্বর থেকে শুটকি ব্যবসা ভালোর দিকে যাচ্ছিল।'
ব্যবসার মাধ্যমে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে বলে আশা করলেও এখন করোনার সংক্রমণ বাড়ায় আবারও লোকসানে পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
লালপুরে তিন প্রজন্ম ধরে শুটকির ব্যবসায় থাকা পরিবারের শুটকি পল্লীর ব্যবসায়ী নিখিল দাস বলেন, 'করোনাভাইরাসের সময় বেচাকেনা না হওয়ায় গুদামে মজুদ করে রাখা বিগত বছরের অধিকাংশ শুটকি নষ্ট হয়ে যায়। এতে করে ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীদেরকেই লোকসান গুনতে হয়েছে। টাকার অংকে এই লোকসান ১২ কোটির মতো হবে,'
'ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত আমরা অন্তত ১৫০ কোটি টাকার শুটকি মজুদ করেছিলাম। এই শুটকিগুলো বিক্রি করতে পারলে আমরা গতবছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারব বলে মনে করেছিলাম। কিন্তু এখন করোনার যে হাল দেখছি, যদি টানা লকডাউন চলে তাহলে আমারা বিপর্যয়ে পড়বো,' যোগ করেন তিনি।