গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: সুলতান সুলেমান এবং সুইডিশ রেসিপি’র গল্প
অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় ছিলেন সাম্রাজ্যটির দশম শাসক সুলেমান। ইতিহাসে তিনি 'সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট' নামে সুপরিচিত। একটি টেলিভিশন সিরিয়ালের সুবাদে এই সুলতান বাংলাদেশেও অত্যন্ত পরিচিত একটি চরিত্র। বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত সুলতান সুলেমানের রাজ্য শাসনের কাহিনী বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জেও পৌঁছে গেছে গত কয়েকবছরে।
বাক স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার চর্চা যাতে তাদের রাজ্যে না হয় সেজন্য সুলেমানের পূর্বপুরুষরা বরাবরই সচেতন ছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় সুলেমানও তার সাম্রাজ্যে মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহারের ঘোরতর বিরোধী বনে যান।
১৪৫০ সালে জার্মানির মেইনজ শহরে বিশ্বের প্রথম ছাপাখানা গুটেনবার্গ প্রেস স্থাপনের পর ইউরোপজুড়ে মুদ্রণশিল্পের জোয়ার তৈরি হয়। তবে নিজেদের সাম্রাজ্যে কোনো ছাপাখানা স্থাপন করতে দেয়নি অটোমানরা।
১৫২০ থেকে ১৫৬৬ মোট ৪৬ বছর অটোমান সাম্রাজ্যের শাসক হিসেবে থাকা সুলেমানও পূর্বপুরুষদের ন্যায় তার রাজ্যে যাতে বই এবং অন্যান্য কিছু মুদ্রিত হতে না পারে সেজন্য ছাপাখানা নিষিদ্ধের আইন বহাল রাখেন।
সুলেমানের ক্ষমতা গ্রহণের পাঁচ বছর আগে ১৫১৫ সালে এই আইনটি কঠোর করেন তার পূর্বসুরি সুলতান সেলিম। জার্মানির আবিষ্কার ছাপাখানা ব্যবহার করে তুর্কি ভাষা কিংবা আরবিতে বই প্রকাশের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয় ওই আইনে।
মৃত্যুদণ্ডের এই আইন পরবর্তী ২৭০ বছর বহাল থাকে অটোমান সাম্রাজ্যে। ১৭৮৪ সালের দিকে এই পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। সময়ের ব্যবধানে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে ছাপাখানার ব্যবহার শুরু হয়।
মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ৩৬২ বছর পর ১৮১৭ সালে প্রথমবারের মতো ইরানে ফতোয়া সংক্রান্ত একটি মুদ্রিত বই প্রকাশিত হয়।
অন্যদিকে পুরো পঞ্চদশ শতাব্দীজুড়ে ইউরোপে মুদ্রণযন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। বই, সংবাদপত্র এবং অন্যান্য মুদ্রিত জিনিসের মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকাশ লাভ করতে থাকে সেখানে। ইউরোপের পুনর্গঠন এবং আজকের ইউরোপ হয়ে ওঠার পেছনে মুদ্রণযন্ত্রকে শক্তিশালী একটি ইঞ্জিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাক-স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রেও এর অবদান রয়েছে। আর এর চূড়ান্ত ফলাফল হলো ইউরোপের দেশগুলোর এবং জনগণের অর্থনৈতিক অগ্রগতি।
'হোয়াই ন্যাশনস ফেইল: দ্য অরিজিনস অব পাওয়ার, প্রসপেরিটি অ্যান্ড পোভার্টি' শিরোনামে ড্যারন এসেমোগলু এবং জেমস এ রবিনসনের লেখা বিখ্যাত বইয়ে বলা হয়েছে, ছাপাখানার বিরুদ্ধে অটোমানদের এমন অবস্থান সাম্রাজ্যটির শিক্ষা, সাহিত্য এবং অর্থনৈতিক উন্নতিতে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
১৮০০ সালে অটোমান সাম্রাজ্যে শিক্ষিতের হার ছিল সম্ভবত দুই থেকে তিন শতাংশ। অথচ একই সময়ে ইউরোপের দেশ ইংল্যান্ডের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে ৬০ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ শিক্ষিত ছিল।
জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডসে শিক্ষিতের হার ছিলো আরও বেশি। এই সময়ে সবচেয়ে কম শিক্ষাগত অর্জন নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে ছিল অটোমান সাম্রাজ্য।
কেন মুদ্রণযন্ত্রের বিরুদ্ধে অটোমানদের অবস্থান ছিল?
ড্যারন এসেমোগলু এবং জেমস এ রবিনসনের লেখা ওই বইয়ে বলা হয়, "বইয়ের মাধ্যমে আইডিয়া ছড়ায় যার ফলে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন হয়ে যায়। এই আইডিয়াগুলোর মধ্যে কিছুক্ষেত্রে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য মূল্যবান নতুন উপায় হতে পারে, তবে অনেকগুলোই আছে যেগুলো বিদ্যমান রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে।"
সেন্সরশিপ-ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা উনবিংশ শতাব্দীর অটোমান সাম্রাজ্যের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল। শিক্ষার আলো থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা ছাড়া আর কিছুই করেনি এই সেন্সরশিপ। মানুষের বাকস্বাধীনতা এবং স্বাধীন গণমাধ্যমের মতো মৌলিক অধিকারগুলো একেবারেই কম ছিল সেখানে। একসময় অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা কিছু দেশ বর্তমান যুগে এসেও সংবাদমাধ্যমের সীমিত স্বাধীনতা নিয়ে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে।
আধুনিক তুরস্কের দিকেই দেখুন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ১৯২০ সালে জন্ম হয় তুরস্কের। বর্তমান তুরস্ককে ঘিরেই পরিচালিত হত অটোমান সাম্রাজ্য।
বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সেসব দেশে সাংবাদিকদের কাজ করার সুযোগসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রতিবছরই ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স প্রকাশ করে সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স। বিশ্বের ১৮০টি দেশ নিয়ে করা প্রতিষ্ঠানটির র্যাংকিংয়ে তুরস্কের অবস্থান এসেছে ১৫৩ তম তে।
প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বলা হয়েছে, "তুরস্ক এখন সাংবাদিকদের কারাদণ্ড দেওয়া বিশ্বের বৃহত্তম দেশগুলোর একটি না হলেও এখানে কারাদণ্ডের ঝুঁকি রয়েছে, বিচারিক নিয়ন্ত্রণের শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, এমনকি কারও কারও ক্ষেত্রে পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেওয়ার আশঙ্কাও আগের মতোই রয়ে গেছে। নিয়ন্ত্রক হিসেবেই দেশটির সরকার ৯০ শতাংশ জাতীয় গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে।"
স্বৈরাচারী শাসনের জন্য ইতোমধ্যেই তুরস্কের বর্তমান নেতা রিসেপ এরদোগানকে অনেকেই 'সুলতান এরদোগান' বলে ডাকেন।
অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা বর্তমান বিশ্বের আরেক দেশ হল মিশর; প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স র্যাংকিংয়ে যাদের অবস্থান ১৬৬ তম।
সাংবাদিকদের অফিসে প্রায়শই বিভিন্ন অভিযান ও গ্রেপ্তারের কারণে মিশরেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিস্থিতি ক্রমশ উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে।
প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বলা হয়েছে, বিশ্বের যে দেশগুলোতে সাংবাদিকদের কারাবন্দি করা হয় মিশর তাদের মধ্যে অন্যতম। সেখানে অনেক সাংবাদিককে বিনা বিচারে বছরের পর বছর কারাবন্দি রাখা হয়। কোনো কোনো সাংবাদিককে গণবিচারের মাধ্যমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছে।
দুই
তবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে অনুপ্রেরণামূলক বার্তা দেয় ইউরোপের দেশ সুইডেন।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো সুইডেনও প্রিন্টিং প্রেসের উদ্ভাবন সাদরে গ্রহণ করেছিল। ১৪৮৩ সালে, লাতিন ভাষার উপকথা সমগ্রের একটি বই প্রথমবারের মতো সুইডেনে প্রকাশিত হয় যা দেশটিতে বাক স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার এক নতুন যুগের সূচনা করে।
তবে সুইডেনের আজকের অবস্থানে আসার পেছনের যাত্রা খুব একটা মসৃণ ছিল না। প্রকাশনাগুলিকে সেসময়কার রাজাদের সেন্সরশিপের মুখোমুখি হতে হতো।
একাদশ কিং চার্লসের শাসনামলে সুইডেনের প্রথম সত্যিকারের সেন্সরশিপ আইন চালু হয়। ওই আইন অনুযায়ী, রাজ্যে মুদ্রিত প্রতিটি বইয়ের দুটি করে কপি রাজার অফিসে পাঠাতে হত। যেখানে কোনো আপত্তিকর বা ক্ষতিকারক কন্টেন্ট থাকলে বইগুলি বাজেয়াপ্ত এবং জরিমানা করার সুযোগ ছিল ওই আইনে।
১৬৬২ সালে চালু হওয়া ওই আইনে মুদ্রণের আগেও বই সেন্সর করার বিধান ছিল।
১৭৬৫ সালে সুইডিশ সরকার তাদের সংবিধানে ব্যাপক সংশোধন শুরু করে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংবিধানে যোগ করতে তিনটি আবেদন জমা দেওয়া হয় সুইডেনের সংসদে যার মধ্যে একটি জমা দেন তখনকার ধর্মযাজক আন্দ্রেস সাইডেনিয়াস।
এর এক বছর পর ১৭৬৬ সালে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি সংবিধানে যোগ করে সুইডেন। সুইডিশ ফ্রিডম অফ প্রেস অ্যাক্টের মাধ্যমে সরকারি তথ্যভাণ্ডারে প্রবেশগম্যতা সৃষ্টি হয় এবং সরকারি নথি সরাসরি প্রকাশ করে দেওয়ার আইনগত বাধা দূর হয়।
সুইডেনের একটি অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, জনসাধারণের প্রবেশাধিকারের নীতিটি এখনও সুইডিশ সংবিধানের ভিত্তি হিসাবে রয়েছে।
সেখানে বলা হয়, তথ্য স্বাধীনতার বিষয়টির অর্থ হল, সাধারণ জনগণ এবং গণমাধ্যমের সরকারি রেকর্ডে প্রবেশাধিকার পাওয়া। এর মানে তারা জাতীয়, আঞ্চলিক এবং স্থানীয় সব স্তরে সরকারের কার্যক্রম খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পায়। তথ্যের স্বচ্ছতা ক্ষমতার অপব্যবহারের ঝুঁকি হ্রাস করে।
ওয়েবসাইটটি বলছে, সরকারি কর্মচারী এবং সরকারের পক্ষে কাজ করা অন্যরাও গণমাধ্যম বা বহিরাগতদের যেকোনো বিষয়ে অবহিত করতে পারেন। তবে, নির্দিষ্ট কিছু নথি গোপন রাখা যেতে পারে- যদি সেগুলোর সঙ্গে জাতীয় সুরক্ষা সম্পর্কিত বিষয়গুলো জড়িত থাকে।
প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে এ বছর র্যাংকিংয়ে তিন নম্বরে আছে সুইডেন। বছরের পর বছর ধরেই এ র্যাংকিংয়ে এগিয়ে আছে দেশটি। দুর্নীতির ধারণা, আইনের শাসন এবং গণতন্ত্রের মতো অন্যান্য সূচকে দেশটি সামনের কাতারে এগিয়ে আছে। বসবাসের জন্য সুইডেন পৃথিবীর সেরা স্থানগুলির মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত হয়।
তিন
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সাংবিধানিক নিশ্চয়তা এবং তথ্য অধিকার আইনের মতো ভালো কিছু আইন থাকলেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অনেকটা তলানির দিকে। চলতি বছরে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২ তম যা তুরস্কের চেয়ে সামান্য ভালো।
গত বছরের অবস্থান থেকে এ বছর একধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ, যা উদ্বেগজনক। তালিকায় দুর্বল এই অবস্থান প্রশাসনের কার্যক্রমে স্বচ্ছতার অভাবকে ইঙ্গিত করে।
গোপনীয়তাই এখানে সর্বোচ্চ নিয়ম। আইন থাকা সত্বেও সুইডেন কিংবা অন্যান্য দেশের মতো সরকারি তথ্যভাণ্ডারে জনগণ ও গণমাধ্যমের তেমন কোনো কার্যকরী প্রবেশাধিকার নেই বাংলাদেশে।
গোপনীয়তার এই সংস্কৃতির সুস্পষ্ট পরিণতি হলো দুর্নীতির ধারণা, আইনের শাসন এবং গণতন্ত্রের মতো অন্যান্য বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা। এ কারণে শাসনপদ্ধতির গুণগতমান এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান পরিমাপ করে, বিশ্বব্যাপী এ ধরনের সূচকে সবসময়ই দুর্বল অবস্থানে থাকে বাংলাদেশ।
- লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা ইংরেজিতে পড়ুন: Press freedom: A story of Sultan Suleiman and a Swedish recipe
- বাংলায় অনুবাদ: তারেক হাসান নির্ঝর