২০২৩ কেন পশ্চিমাদের জন্য একটি অস্বস্তিকর বছর ছিল?
বিদায়ী এই বছরে ইউরোপসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিশ্ব রাজনীতির হাওয়া বয়েছে প্রতিকূল দিকে। ধারণা করা হচ্ছে, উদ্ভূত নানান চ্যালেঞ্জের কারণে বিশ্বে মার্কিন নেতৃত্বের আধিপত্যে কিছুটা পরিবর্তন আসবে।
যদিও এই চ্যালেঞ্জগুলো এখনও বিপর্যয়কর নয়, তবুও তারা একটি পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে আরও পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। যে পরিবর্তন পশ্চিমা স্বার্থের জন্য বেশ কিছু উদ্বেগ তৈরি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে, ভূরাজনীতির মোড় পরিবর্তনের পেছনের কারণগুলোর সন্ধান করা এবং চলমান রূপান্তর থেকেও- পশ্চিমা দুনিয়া কীভাবে সুবিধা নিতে পারে তা চিহ্নিত করার প্রয়াস রয়েছে এ প্রতিবেদনে।
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন
গাজায় যুদ্ধ শুরুর পরে রিয়াদে আরব ও মুসলিম বিশ্বের সাম্প্রতিক এক শীর্ষ জরুরি সম্মেলনে, আরব মন্ত্রীরা হতাশা প্রকাশ করে বিবিসির প্রতিবেদককে বলেন, বিশ্বব্যাপী সংঘাতের সময় ফিলিস্তিন নিয়ে পশ্চিমা সরকারগুলো দ্বৈত আচরণ করে। এর জন্য পশ্চিমা সরকারকে ভণ্ড হিসেবেও অভিহিত করেন তারা। প্রশ্ন তোলেন, কেন ইউক্রেনে বেসামরিক হতাহতের জন্য রাশিয়ার নিন্দা করা হয়; কিন্তু গাজায় যখন হাজার হাজার নারী, শিশু প্রাণ হারালেও সেটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হয় না!
ইসরায়েলের ওপর ফিলিস্তিনি গ্রুপ হামাস হামলা চালালে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ বলেন, "সন্ত্রাসী হামলায় যারা আত্মীয় বা ঘনিষ্ঠদের হারিয়েছেন, এমন প্রত্যেকের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।" তিনি আরও বলেন, "ইসরায়েলের আত্মরক্ষার সকল অধিকার আছে, এ নিয়ে কোনো প্রশ্নের অবকাশ নেই।"
অথচ ইউক্রেন যদি আক্রান্ত দেশ হয়, ফিলিস্তিনও ঠিক তাই। বরং তাদের সংগ্রাম ও শোষণ আরও দীর্ঘকালের। জেলেনস্কি ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রামকে 'সন্ত্রাসী' কার্যক্রম বলতে, তার পশ্চিমা সমর্থকদের মতোই একবিন্দু দ্বিধা, লজ্জার ধার ধারেননি। মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রি ঋষি সুনাকসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার-প্রধানেরা একই ধরনের মন্তব্য করেছেন।
৭ অক্টোবরের হামলার ঘটনার পর, ব্রিটিশ সরকার ইসরায়েলের সমর্থনে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে দ্রুত রয়্যাল নেভির যুদ্ধজাহাজ এবং নজরদারি বিমান মোতায়েন করে। প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, ১৯ অক্টোবর ইসরায়েল সফরের সময়, গাজায় উল্লেখযোগ্য বেসামরিক হতাহতের ঘটনাকে উপেক্ষা করে নেতানিয়াহুকে 'আমরা চাই, আপনি জয়ী হোন' বলে দৃঢ় সমর্থন দিয়েছেন।
অথচ ব্রিটিশ ম্যান্ডেন্টেই সৃষ্টি করা হয় ফিলিস্তিনের জমিতে ইসরায়েল রাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন নতুন রাষ্ট্রগঠনের মাধ্যমে আরও সংঘাতের পথ খুলে দেয় সাইকস-পিকো চুক্তি; যেখানে মূল কারিগর ছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্স।
তবু গাজায় গণহত্যা চলমান থাকা অবস্থায় যুক্তরাজ্য যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে চলেছে, এবং দাবি করছে এই ধরনের পদক্ষেপ শুধু হামাসের উপকারে আসবে। ব্রিটিশ সরকার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রাখতে— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছে। একইসময় যুক্তরাজ্যের মধ্যে ভিন্নমতের (ফিলিস্তিনপন্থী) কণ্ঠকে দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে, এবং প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্র্যেভারম্যান ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকে 'ঘৃণাত্মক মার্চ' বলে অভিহিত করেন। এই বিক্ষোভগুলো নিষিদ্ধ করার জন্য ব্রেভারম্যানের প্রচেষ্টায় জনসাধারণের মধ্যে তাঁর পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়, যে কারণে গত ১৩ নভেম্বর তাঁকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হন সুনাক।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন বলেছেন, "ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে – আজ এবং আগামী দিনে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরায়েলের পাশে আছে।"
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসরায়েলের প্রতি অবিচল সমর্থন প্রকাশ করেছে ইইউ এর প্রভাবশালী সদস্য জার্মানি। গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান সত্ত্বেও, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রতি সমর্থনের ওপর জোর দিয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পশ্চিমাদের এ ধরণের দ্বৈত আচরণ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। নেটিজেনরা বলছেন, ইউক্রেনের আত্মরক্ষার অধিকার বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক নেতাদের দ্বারা প্রশংসিত হয়, রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা করা হয়। অথচ গাজায় ইসরায়েলের দখল নিয়ে তাঁদের একই কথা বলতে দেখা যায় না। অনেক ব্যবহারকারী বলেছেন যে, নিজ ভূখণ্ড রক্ষার লড়াইরত ইউক্রেণীয়দের পশ্চিমা কূটনীতিক এবং গণমাধ্যম সমর্থন করে, কিন্তু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ফিলিস্তিনিদেরকে 'সন্ত্রাসী' হিসাবে চিহ্নিত করে।
ফিলিস্তিনি ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভের সাধারণ সম্পাদক মুস্তাফা বারঘৌতির সাথে ইসরায়েলপন্থী মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন- এর একটি সাক্ষাৎকার সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছে, যেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, "কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনকে সমর্থন করে — যখন তারাই আবার ইসরায়েলের দখলদারিত্বকে সমর্থন দিচ্ছে?"
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিমা দেশগুলোর ফিলিস্তিনের প্রতি এই দ্বৈত আচরণের অভিযোগ এটাই প্রথম নয়।
বছরের শুরুতে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের বিষয়ে পশ্চিমাদের 'দ্বিচারিতা' তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
অ্যামনেস্টির মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড সেই সময় আল জাজিরাকে বলেছিলেন যে, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের দখল (ঐতিহাসিক বিচারে) 'বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ' ঘটনা ছিল।
উল্লেখ্য, ইসরায়েল এবং হামাস পরিচালিত গাজা উপত্যকার কর্মকর্তারা বলছেন, এ যুদ্ধে প্রায় ২১ হাজার ৫০০ ফিলিস্তিনি এবং ১,২০০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে পশ্চিমের এই দ্বৈত আচরণ তাদের জন্য নেতিবাচক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেন থেকে বিশ্ববাসী মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে। অনেকে মনে করে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য গাজা ধ্বংসের জন্য জাতিসংঘে ইসরায়েলকে সমর্থন করায় তা মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার অবস্থানকে গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছে। সংঘাত দক্ষিণ লোহিত সাগর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে, যেখানে ইরান-সমর্থিত হুথিরা বিস্ফোরক ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েল-সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য জাহাজকে লক্ষ্য করে হামলা করছে। হামলা এড়াতে বাণিজ্য জাহাজকে বিশাল আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণতম প্রান্ত ঘুরে চলাচল করতে হওয়ায় জাহাজভাড়া ও পণ্যের দামও বেড়ে গেছে।
নরওয়ে ৭ অক্টোবরের হামলার পরে প্রাথমিকভাবে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করেছিল। যাইহোক, সংঘাত বেড়ে যাওয়ায় এবং হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার ফলে, প্রধানমন্ত্রী জোনাস গার স্টুর আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়াকে 'অসমানুপাতিক' বলে অভিহিত করেছেন। পরবর্তীকালে, তাঁর সরকার পার্লামেন্টে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য 'প্রস্তুতি' প্রস্তাব করে। প্রস্তাবে শান্তি প্রক্রিয়ায় সম্ভাব্য ইতিবাচক প্রভাবের কথা উল্লেখ করে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে নিঃশর্ত স্বীকৃতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া, কলম্বিয়ার বামপন্থী সরকারের নিন্দার মুখে গত ১৬ অক্টোবর লাতিন আমেরিকার দেশটিতে নিরাপত্তা সামগ্রী রপ্তানি বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। তখন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থগিত করার ঘোষণা দেন।
পেট্রো ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বলেন, ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের বর্বরতা– ইসরায়েলের বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে হামাসের চেয়ে বহুগুণে বেশি। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার জন্য আলজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি আবদেলমাদজিদ তেবোউনের আহ্বানকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতিও দেন।
ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো ৭ নভেম্বর গাজায় ইসরায়েলের হামলার নিন্দা করেছেন এবং ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা, ২৬ অক্টোবর, পরিস্থিতিটিকে যুদ্ধের পরিবর্তে গণহত্যা হিসাবে অভিহিত করেছেন, শিশুদের এবং নিরপরাধদের মৃত্যুর বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এছাড়া, বলিভিয়া ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং হন্ডুরাস ইসরায়েল থেকে তার রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে।
ইউক্রেন যুদ্ধ
ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্তের যুদ্ধাবস্থা ভালো যাচ্ছে না। ইউক্রেনের সংকট তার সমর্থক- ন্যাটো জোট এবং ইইউ উভয়কেই প্রভাবিত করছে, যারা ইউক্রেনের যুদ্ধে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।
গত বছর, ন্যাটোর উচ্চ আশা ছিল যে, পশ্চিমা সরবরাহকৃত সামরিক সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে, ইউক্রেনের সেনাবাহিনী রাশিয়ার কাছ থেকে অঞ্চল পুনরুদ্ধার করতে পারে। কিন্তু আদতে তা সম্ভব হয়নি।
ন্যাটো দেশগুলো ইউক্রেনে ব্রিটেনের চ্যালেঞ্জার-২ এবং জার্মানির লেপার্ড-২-এর মতো আধুনিক মেইন ব্যাটেল ট্যাঙ্ক (এমবিটি) পাঠাতে দ্বিধা করেছিল, এই ভয়ে যে এ সিদ্ধান্ত রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ক্ষুদ্ধ করতে পারে। কিন্তু পরে, এই ট্যাংকগুলো পাঠানো হয়, এবং পুতিন বার্লিনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধ নেননি। যাইহোক, জুনে যখন ট্যাংকগুলো মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত ছিল, রাশিয়ান কমান্ডাররা ইতোমধ্যেই মানচিত্র অধ্যয়ন করে ইউক্রেনের মূল কৌশলটি অনুমান করে ফেলেন।
রাশিয়ান কমান্ডাররা অনুমান করেছিলেন যে, ইউক্রেন দক্ষিণে জাপোরিঝিয়া ওব্লাস্ট হয়ে আজভ সাগরের দিকে অগ্রসর হবে, কৌশলগতভাবে রাশিয়ান লাইনকে বিভক্ত করবে এবং ক্রিমিয়াকে রাশিয়ান ফ্রন্ট থেকে বিচ্ছিন্ন করবে।
রাশিয়ান সেনাবাহিনী ২০২২ সালে কিয়েভ দখলে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী। ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে, যখন ইউক্রেনীয় ব্রিগেডগুলো বিদেশে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল এবং পশ্চিমা ট্যাংক পাওয়া নিয়ে দেন-দরবার চলছিল, ঠিক তখনই রাশিয়া এন্টি-ট্যাংক এবং এন্টি-পার্সোনেল মাইন, বাঙ্কার, ট্যাংক ফাঁদ, ড্রোন এবং আর্টিলারিসহ ব্যাপক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছিল ফ্রন্টলাইনে। এই প্রতিরক্ষাগুলো কার্যকরভাবে ইউক্রেনের বহুল প্রত্যাশিত পাল্টা আক্রমণকে ব্যর্থ করেছে।
ইউক্রেন এবং পশ্চিমা বিশ্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন এখন। ইউক্রেন গোলাবারুদ এবং সৈন্যের গুরুতর ঘাটতি মোকাবিলা করছে এবং মার্কিন কংগ্রেস ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামরিক সহায়তা প্যাকেজ বিলম্বিত করছে। একইভাবে, হাঙ্গেরি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৫০ বিলিয়ন ইউরোর সহায়তা প্যাকেজ আটকে রেখেছে। যদিও এই সাহায্য প্যাকেজগুলো শেষ পর্যন্ত পাশ হতে পারে, কিন্তু এই বিলম্ব ইউক্রেনের আক্রমণাত্মক মনোভাবকে প্রভাবিত করে এরমধ্যে একটি প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিতে বাধ্য করেছে। ইতোমধ্যে, মস্কো তার প্রতিরক্ষা বাজেট উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। জাতীয় বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ সামরিক খাতে বরাদ্দ করেছে ক্রেমলিন এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যথেষ্ট জনশক্তি ও আর্টিলারি মোতায়েন করেছে।
এই পরিস্থিতি ইউক্রেনের জন্য হতাশাজনক, যা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে। পশ্চিমাদের জন্য চিন্তার বিষয় হল, প্রেসিডেন্ট পুতিনকে বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের উপর জোর দিয়ে জয়ী হতে শুধুমাত্র দখলকৃত এলাকা (ইউক্রেনের প্রায় ১৮%) ধরে রাখতে হবে।
ন্যাটো ইউক্রেনকে সমর্থন করার জন্য যথেষ্ট প্রচেষ্টা করেছে, সরাসরি যুদ্ধে জড়িত না হয়েও তার সম্পদ প্রায় অকাতরে দিয়েছে। যাইহোক, এই প্রচেষ্টাগুলো এখন রাশিয়ান আগ্রাসনের বিপরীতে ব্যর্থ হতে পারে, যা যুদ্ধকে পশ্চিমাদের জন্য বিব্রতকর অবস্থার দিকে পরিচালিত করতে পারে। উপরন্তু, ন্যাটো অন্তর্ভুক্ত বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো-এস্তোনিয়া, লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়াও উদ্বিগ্ন যে পুতিন যদি ইউক্রেনে সফল হন, তাহলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তারাও একই ধরনের হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
ভ্লাদিমির পুতিন
২০২৩ সালের মার্চ মাসে ইউক্রেনীয় শিশুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
পশ্চিমারা আশা করেছিল, এই রায় তাঁকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একঘরে করে তুলবে এবং তাঁর বৈশ্বিক সফরকে বাধাগ্রস্ত করবে। গ্রেফতার এবং হেগে নির্বাসনের ভয়ে হয়তো তিনি ভ্রমণ করতে পারবেন না। তবে এরকম কিছুই হয়নি।
প্রেসিডেন্ট পুতিন কিরগিজস্তান, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবে গেছেন, প্রতিবার লাল গালিচা সংবর্ধনা পাচ্ছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস সম্মেলনেও কার্যত অংশ নিয়েছেন তিনি। রাশিয়ান অর্থনীতিকে পঙ্গু করার লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বহু দফা নিষেধাজ্ঞা দিলেও– রুশ পণ্যের বিকল্প বাজার তিনি খুঁজে বের করেছেন। রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের জন্য কমদামে নতুন গ্রাহকদের সন্ধান করেছেন। যদিও পশ্চিমারা পুতিনের কর্মকাণ্ডের নিন্দা করে, অনেক দেশ এই সংঘাতকে ইউরোপের ইস্যু হিসেবে দেখে, কেউ কেউ আবার রাশিয়াকে উস্কে দেওয়ার জন্য ন্যাটোকে দায়ী করে।
ইরান
ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, যা তারা অস্বীকার করে। পশ্চিমা উদ্বেগ সত্ত্বেও, ইরান বিচ্ছিন্ন নয় এবং প্রক্সি মিলিশিয়া ব্যবহার করে বিভিন্ন অঞ্চলে তার সামরিক প্রভাব বিস্তার করেছে। এই বছর, তেহরান মস্কোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করেছে এবং ইউক্রেনের সংঘাতের জন্য 'শাহেদ' ড্রোন সরবরাহ করেছে। পশ্চিমা দেশগুলোকে হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা ইরান গাজা যুদ্ধে ফিলিস্তিনের সমর্থন দিয়ে আসছে।
আফ্রিকার 'সাহেল'
পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে, একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে জিহাদি বিদ্রোহের বিরুদ্ধে লড়াই করা ইউরোপীয় বাহিনীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মালি, বুর্কিনা ফাসো এবং মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রসহ প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশগুলো ইউরোপীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। জুলাই মাসে, নাইজারে আরেকটি অভ্যুত্থান পশ্চিমাপন্থী রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাচ্যুত করে, যার ফলে ফরাসি সৈন্যরা চলে যায় এবং তবে নতুন সরকারগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও ৬০০ মার্কিন সেনা দুটি ঘাঁটিতে রয়ে গেছে।
ওয়াগনার গ্রুপের রাশিয়ান ভাড়াটেরা সাহেল অঞ্চলে ফরাসি এবং আন্তর্জাতিক বাহিনীর জায়গায় অবস্থান নিয়েছে। আগস্টে একটি বিমান দুর্ঘটনায় ওয়াগনার নেতা ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের রহস্যজনক মৃত্যু সত্ত্বেও, গ্রুপটি তার লাভজনক ব্যবসায়িক চুক্তি বজায় রেখেছে। উপরন্তু, একসময়ে পশ্চিমা মিত্র হিসাবে বিবেচিত দক্ষিণ আফ্রিকা– রাশিয়ান এবং চীনা যুদ্ধজাহাজের সাথে যৌথ নৌ মহড়ায় অংশ নিয়েছে।
চীন
২০২৩ সালে, সান ফ্রান্সিসকোতে রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন এবং শি জিনপিং-এর মধ্যে একটি সফল শীর্ষ বৈঠকের পরে বেইজিং এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনা কিছুটা শিথিল হয়। কিন্তু চীন, দক্ষিণ চীন সাগরের বেশিরভাগ অংশের ওপর তার দাবি থেকে সরে আসার কোন লক্ষণ দেখায়নি। বেইজিং একটি নতুন মানচিত্র জারি করেছে যা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কয়েকটি দেশের উপকূলরেখা পর্যন্ত তাদের সমুদ্রসীমার দাবিগুলোকে আরও জোরদার করে। একইভাবে, চীন তাইওয়ানের উপর তার দাবি পরিত্যাগ করেনি এবং প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করেও তাইওয়ানকে মূল ভূখণ্ডে যুক্ত করার অভিপ্রায় পুনর্ব্যক্ত করেছে।
উত্তর কোরিয়া
নিষিদ্ধ পারমাণবিক অস্ত্র এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির কারণে কঠোর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও, উত্তর কোরিয়া ২০২৩ সালে রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন একটি রাশিয়ান মহাকাশ স্টেশন পরিদর্শন করেছেন এবং তাঁর দেশ রাশিয়াকে এপর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ আর্টিলারি শেল পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে। একইসঙ্গে, উত্তর কোরিয়া আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে, এসব ক্ষেপণাস্ত্র এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ অংশে পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে বলে মনে করা হয়।
পরিস্থিতি উন্নতির কি আশা আছে?
বৈশ্বিক এ চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে পশ্চিমাদের আশার আলো দেখা কিছুটা কঠিন। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ন্যাটো জোট তার প্রতিরক্ষামূলক প্রচেষ্টা জোরদার করেছে, যদিও এর মধ্যেও কিছু বিভাজন দেখা যাচ্ছে। গাজা-ইসরায়েল পরিস্থিতির জন্য মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের অবস্থান আরও উন্নতির সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা রয়েছে।
৭ অক্টোবরের আগে, একটি ভবিষ্যত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নের সমাধান খোঁজার প্রচেষ্টা অনেকাংশে থমকে গিয়েছিল। ইসরায়েল কিছুটা আত্মতুষ্টিতে ভুগছিল, ফিলিস্তিনিদের তাদের নিজস্ব রাষ্ট্রের পদক্ষেপ ব্যাহত করতে না দিয়ে ইসরায়েল– সামরিক দখলদারি চালিয়ে যায়। সহজ কথায়, দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের সমাধানে সক্রিয় প্রচেষ্টার অভাব ছিল। এই পদ্ধতি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে. বিশ্বব্যাপী নেতারা এখন জোর দিচ্ছেন যে ফিলিস্তিনিদের শান্তি ও নিরাপত্তার সাথেই ইসরায়েলিদের শান্তি ও নিরাপত্তা-জড়িত।
দীর্ঘস্থায়ী এই সমস্যার একটি ন্যায্য এবং দীর্ঘস্থায়ী সমাধান খুঁজে পাওয়া অবিশ্বাস্যভাবে চ্যালেঞ্জিং হবে, উভয় পক্ষের থেকে সমঝোতা এবং ত্যাগের প্রয়োজন হবে। তা সত্ত্বেও, এই জটিল সমস্যা সমাধানের দিকে বিশ্ববাসীর মনোযোগ পুনরায় আকৃষ্ট হয়েছে।