দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ২৪ ঘণ্টায় ট্রাম্প তুললেন ৫২.৮ মিলিয়ন ডলারের তহবিল
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর তার নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের পক্ষ থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৫২.৮ মিলিয়ন ডলারের তহবিল যোগাড় করা হয়েছে।
এদিকে আদালত ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করার আগেই ওয়াল স্ট্রিটের ধনকুবেররা ট্রাম্পের পক্ষে নিজেদের অবস্থানের কথা জানান। তাদের সিদ্ধান্ত এমন ছিল যে যদি অভিযোগ প্রমাণও হয়, তবুও হোয়াইট হাউসের দৌড়ে ট্রাম্পকেই সমর্থন দেবেন তারা।
২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে পর্ন তারকাকে মুখ বন্ধ রাখতে টাকা দেওয়ার ঘটনা ধামাচাপা দিতে নথিপত্রে তথ্য গোপন করার অভিযোগে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন নিউইয়র্কের একটি আদালতের জুরিদল। ১২ সদস্যের জুরিদল সাবেক এই প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আনা ৩৪টি অভিযোগেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। আর এটিকেই যেন তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন।
পুরো এপ্রিল মাসজুড়ে ট্রাম্প ৭৬ মিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন; যা প্রথমবারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী বাইডেনের তুলনায় বেশি ছিল। একইভাবে তার এই একদিনের সংগ্রহ পুরো এপ্রিল মাসের সংগ্রহের দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি।
গতকাল (শুক্রবার) রাতে ট্রাম্প ক্যাম্পেইনের এক বিবৃতিতে বলা হয়, "প্রতি ঘণ্টায় গড়ে দুই মিলিয়নেরও বেশি সংগ্রহ হয়েছে। এদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ দাতা নতুন।"
টেক্সট ও ইমেইলে ট্রাম্প নিজেকে একজন 'রাজনৈতিক বন্দী' বলে অভিহিত করেছেন। একইসাথে তার দোষী সাব্যস্ত হওয়াকে মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার দিন বলে চিহ্নিত করেছে। তিনি বলেন, "আমি ভুল কিছু করিনি!"
ট্রাম্প ক্যাম্পেইনের পক্ষ থেকে ৪৭ ডলার অনুদানের জন্য 'মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' স্লোগান সম্বলিত একটি কালো ক্যাপ প্রদান করা হচ্ছে। যার পাশে এমব্রয়ডারি করে লেখা 'নেভার সারেন্ডার'।
রায়ের সময় ট্রাম্প আদালতেই উপস্থিত ছিলেন। দোষী সাব্যস্ত করার রায় ঘোষণার সময় তিনি নিরাসক্তভাবে জুরিদের দেখছিলেন। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কিছুদিন পর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাওয়া ট্রাম্পের ভাগ্যে কী রয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ট্রাম্প নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। কেননা মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের জন্য যেসব যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো সবই ট্রাম্প প্রার্থী হিসেবে পূরণ করেন। যেমন, তাদের কমপক্ষে ৩৫ বছর হতে হবে, জন্মগতভাবে মার্কিন নাগরিক হতে হবে এবং কমপক্ষে ১৪ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে হবে। এক্ষেত্রে অপরাধমূলক রেকর্ডের কারণে প্রার্থী হতে না পারার নিয়ম দেশটির সংবিধানে নেই।
তবে ট্রাম্পের এই দোষী সাব্যস্ত হওয়ার রায় নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। চলতি বছরের শুরুর দিকে ব্লুমবার্গ এবং মর্নিং কনসাল্টের একটি জরিপে দেখা যায়, মূল দোদুল্যমান স্টেটের ৫৩ ভাগ ভোটার ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে ভোট না দিতে পারে।
চলতি মাসে কুইনিপিয়াক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি জরিপে দেখা যায়, দোষী সাব্যস্ত হলে ট্রাম্পের পক্ষের ৬ ভাগ ভোটারেরও তাকে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা কম। এই ধরনের প্রভাব নির্বাচনকে আরও কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকে নিয়ে যাবে।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০০৬ সালে পর্নতারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি। ওই সময় বর্তমান স্ত্রী মেলানিয়ার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে ছিলেন ট্রাম্প। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে যাতে তাদের এই সম্পর্ক ফাঁস না হয়ে যায়, সেজন্য ওই পর্নতারকাকে মুখ বন্ধ রাখতে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া ওই অর্থ দেওয়ার বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ট্রাম্প তার ব্যবসায়িক নথিপত্রেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। ট্রাম্প অবশ্য এই পর্নতারকার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের কথা অস্বীকার করেছেন।
পরে আদালতে যান স্টর্মি ড্যানিয়েলস। ট্রাম্পের সঙ্গে তার যৌন সম্পর্কের বিবরণ থেকে শুরু করে ঘুষের কথা জানান তিনি।
ছয় সপ্তাহ ধরে চলা বিচার শেষে, দুদিন আলোচনার পর মামলার রায় দেন জুরিরা। এর আগে জুরিরা ৬ সপ্তাহ ধরে ২২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য শুনেছেন। সব সাক্ষ্য-প্রমাণ যাচাইয়ের পর জুরিরা সর্বসম্মতভাবে ট্রাম্পকে দোষী বলে রায় দেন।
পর্নতারকাকে ঘুষ দেওয়া ছাড়াও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল বদলে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের মামলা চলছে। এছাড়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেয়াদ শেষের পর হোয়াইট হাউস থেকে সরকারি গোপন নথিপত্র সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে আরও একটি মামলা আছে তার বিরুদ্ধে।
ট্রাম্পকে সমর্থন জানাতে ওয়াল স্ট্রিটের ধনকুবেরদের হুড়োহুড়ি
আদালতের ঐতিহাসিক রায়ের ১৬ দিন আগে ওয়াল স্ট্রিটের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা বৈঠক করে ট্রাম্পের পক্ষে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেন। তাদের এ অবস্থান এখন মার্কিন অর্থনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে।
ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের সমর্থক থেকে শুরু করে মার্কিন অর্থনীতি ও ব্যবসায় প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরা ট্রাম্প যতই দোষী সাব্যস্ত হোক না কেন, তারা পুনরায় ট্রাম্পকেই ক্ষমতায় দেখতে চান।
বিনিয়োগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ১৭৮৯ ক্যাপিটালের প্রেসিডেন্ট ও ট্রাম্পের জন্য তহবিল সংগ্রহের সহ-উদ্যোক্তা ওমেদ মালিক বৃহস্পতিবার বলেন, '(ট্রাম্পকে) আমার সমর্থনের ওপর এ রায়ের প্রভাব শূন্যের চেয়েও কম।'
এটি অনেকটাই নিশ্চিত যে ২০১৬ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্পের সমর্থকদের দাঙ্গার ঘটনার পর অনেক ব্যবসায়ীই ট্রাম্পকে সমর্থন করা থেকে বিরত ছিলেন। এখন তারাও আবার ট্রাম্পকে সমর্থন দিচ্ছেন।
এক কথায় বলতে গেলে এর পেছনে বড় একটি কারণ হলো অর্থ। ট্রাম্প ধনীদের জন্য কর কমানো এবং প্রবিধান বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন এর বিপরীতটা চান।
ওমেদ মালিকের ধারণা ছিল- যখন আদালতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো বিস্তারিত তুলে ধরা হচ্ছিল, তখন সেগুলো শুনে হয়ত আদালত কক্ষে উপস্থিত কারো কারো মন পাল্টে যেতে পারে।
এদিকে বৃহস্পতিবার আদালতের রায় শোনার অপেক্ষা না করেই রিপবালিকান দলের দীর্ঘদিনের দাতা স্টিফেন শোওয়ার্জম্যান ট্রাম্পের পক্ষে থাকার ঘোষণা দেন।
ব্লুমবার্গের বিলিওনিয়ার্স ইনডেক্স অনুযায়ী, বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকস্টোন ইনক-এর সহপ্রতিষ্ঠা স্টিফেন বিশ্বের শীর্ষ ৪০ ধনী ব্যক্তির একজন। তার সম্পদমূল্য ৪১ বিলিয়ন ডলার।
বৃহস্পতিবার আদালতের রায় ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে নিউইয়র্কের আরেক ধনকুবের বিল অ্যাকম্যানও ট্রাম্পকে সমর্থনের কথা জানান।
এ বিষয়ে অ্যাকম্যানের এক মুখপাত্রের কাছে জানতে চাইলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আর শোয়ার্জম্যানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ডোনাল্ডসন, লাফকিন অ্যান্ড জেনরেটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড্যান লাফকিন বলেন, 'যদি মনে হয় ট্রাম্প সঠিক পথে আছেন, তাহলে কি ট্রাম্পকে সমর্থন করার ইচ্ছা আছে? হ্যাঁ।'
তবে তিনি বলেন, 'আমি ওটা নিয়ে গর্বিত নই, আর আমি সেটার অংশও নই।' (লাফকিন প্রাথমিকভাবে নিকি হ্যালিকে সমর্থন করেছিলেন। শুরুর দিকে ওয়াল স্ট্রিটে নিকির বেশ জনপ্রিয়তা ছিল)।
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান