১৮৯৮ সালে বিলুপ্ত ঘোষণা, ৫০ বছর পর পায়ের ছাপ দেখে পুনঃআবিষ্কার হয়েছিল যে পাখি
উজ্জ্বল নীল-সবুজ পালক এবং প্রাচীন কঙ্কাল সদৃশ গঠনের তাকাহে পাখি উড়তে পারে না। এর দেখা পাওয়া যায় শুধু নিউজিল্যান্ডেই। এক সময় এটি উত্তর এবং দক্ষিণ দ্বীপে বিস্তৃত ছিল। কিন্তু পাখিটির সংখ্যা অনেক বেশি কমে গেছে। কয়েক শতক আগে উত্তর দ্বীপের তাকাহে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
দক্ষিণ দ্বীপের তাকাহে (Porphyrio hochstetteri) পাখিকে বিজ্ঞানীরা ১৮৯৮ সালে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিলেন। তবে, এই পাখি গোপন, দূরবর্তী পাহাড়ি উপত্যকায় বেঁচে ছিল।
তাকাহে নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী মাওরি জনগণের জন্য গভীর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বহন করে। মাওরিদের বিভিন্ন গল্প বা কাহিনীতে তাকাহে একটি 'তাওঙ্গা' (সম্পদ) হিসেবে বিবেচিত।
১৯৪৮ সালে যখন পাখিটি আবারও আবিষ্কার করা হয়, তখন এটি শুধু একটি অলৌকিক ঘটনাই ছিল না। এটি নিউজিল্যান্ডের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি পুনরুজ্জীবিত করার একটি প্রতীকও ছিল।
দক্ষিণ দ্বীপের তাকাহের হারানো বছরগুলো এবং ১৯৪৮ সালের পুনঃআবিষ্কার
প্রায় ৫০ বছর ধরে দক্ষিণ দ্বীপের তাকাহে পাখিকে বিলুপ্ত বলে মনে করা হয়েছিল। তবে ১৯৪৮ সালে লেক তে আনাউয়ের কাছে অজানা পাখির ডাক এবং অস্বাভাবিক পায়ের ছাপের মতো রহস্যময় সংকেতগুলো নতুন আশা জাগায়। প্রাকৃতিক ইতিহাসে গভীর আগ্রহ এবং চিকিৎসক ড. জেফ্রি অরবেল এর তদন্ত করতে একটি ছোট দল গঠন করেন।
১৯৪৮ সালের ২০ নভেম্বর ড. অরবেল এবং তার দল মরচিসন পর্বতের দুর্গম, দূরবর্তী অঞ্চলে একটি চ্যালেঞ্জিং অভিযান শুরু করেন। এই এলাকা খাড়া উপত্যকা, ঘন উদ্ভিদ এবং কঠিন পাহাড়ি পরিবেশের জন্য পরিচিত।
অঞ্চলটি এতটাই বিচ্ছিন্ন, এখানে খুব কমই বা হয়ত কখনই অনুসন্ধান চালানো হয়নি। তারা খুব বেশি সরঞ্জাম ছাড়া, শুধু তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা এবং কিছু মৌলিক যন্ত্র সঙ্গে নিয়ে এই অরণ্যে প্রবেশ করেন, অজানা পাখির ডাক ও পায়ের ছাপের রহস্য সমাধান করার সংকল্প নিয়ে।
অদ্ভুত পায়ের ছাপ ও পাখির ডাকের খবরে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা বনের আরও গভীরে প্রবেশ করেন। অবশেষে তারা এক অভূতপূর্ব পাখির দেখা পান। সেটি ছিল মোটা, উজ্জ্বল রঙের এবং নীল-সবুজ পালকের সঙ্গে লাল ঠোঁটযুক্ত।
দীর্ঘদিন ধরে বিলুপ্ত মনে করা তাকাহে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। পাখিটি নির্বিকার ছিল, যেন জানত না পৃথিবী থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার কতটা কাছে পৌঁছে গিয়েছিল সে।
এই আবিষ্কারকে নথিভুক্ত করা সহজ কাজ ছিল না। তবে ড. অরবেল এবং তার দল ছবির মাধ্যমে এবং শারীরিক প্রমাণ সংগ্রহ করে তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হন। তাদের পুনঃআবিষ্কার বিশ্বজুড়ে শিরোনাম হয় এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ গবেষণায় নতুন প্রাণ সঞ্চার করে।
তাকাহে পাখির বিশেষ অভ্যাস
এই অভিযান শুধু দক্ষিণ দ্বীপের তাকাহের স্থিতিশীলতা প্রমাণ করেনি, বরং এর বিশেষ অভ্যাসগুলোর দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
এই পাখি অ্যালপাইন তৃণভূমিতে ভালোভাবে বেঁচে থাকে। তারা তুষার ঘাসের পাতা ছাড়িয়ে নরম ভিত্তি পর্যন্ত খায়। শীতে নীচু এলাকায় নেমে বনাঞ্চলে আশ্রয় নেয়।
তাকাহে পাখি একটি সঙ্গীর সঙ্গেই দীর্ঘমেয়াদি জুটি বাঁধে এবং প্রতি মৌসুমে একটি ছানা লালন-পালন করে। ঘন উদ্ভিদের মধ্যে লুকানো নিজেদের বাসা সতর্কভাবে রক্ষা করে।
এই পুনঃআবিষ্কার ছিল মানব অধ্যবসায় এবং পরিবেশগত কৌতূহলের এক সাফল্য। তবে এটি বাসস্থান ধ্বংস ও আনাড়ি শিকারিদের কারণে প্রজাতির ভঙ্গুর অবস্থাকেও তুলে ধরে।
তাকাহে পাখি খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টা ছিল নিউজিল্যান্ডের বন্য ঐতিহ্যের প্রতীক সংরক্ষণের দীর্ঘ যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ।
তাকাহে পুনঃআবিষ্কারের পরপরই সংরক্ষণ কার্যক্রম শুরু
তাকাহে যে এখনো বন্য পরিবেশে বেঁচে আছে, এই খবর নিউজিল্যান্ড এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। পুনঃআবিষ্কার সঙ্গে সঙ্গে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার বার্তা ছড়িয়ে পরে। পরিবেশবিদ ও সরকারি কর্মকর্তারা এই বিরল ও প্রতীকী পাখি রক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন।
প্রথম পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি ছিল, মুর্চিসন পর্বতমালা সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা। এতে পাখির প্রাকৃতিক আবাসস্থল মানুষের কার্যকলাপ এবং স্টোট ও ইঁদুরের মতো শিকারিদের হাত থেকে সুরক্ষিত থাকে। এসব শিকারি প্রাণী নিউজিল্যান্ডের অনেক স্থানীয় পাখি ধ্বংস করেছে।
আজকের ডিপার্টমেন্ট অব কনজার্ভেশনের পূর্বসূরি নিউজিল্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিস দ্রুত তাকাহের টিকে থাকার জন্য একটি বিশেষ প্রোগ্রাম চালু করে।
প্রাথমিক উদ্যোগগুলোর মধ্যে ছিল– শিকারি নিয়ন্ত্রণ, আবাসস্থল পুনরুদ্ধার এবং বেঁচে থাকা জনসংখ্যার নিবিড় পর্যবেক্ষণ।
তাকাহের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জগুলো আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য মাঠ পর্যায়ের গবেষকরা পাখিদের আচরণ, খাদ্যাভ্যাস এবং প্রজনন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন, তাদের ।
পরবর্তী সময়ে সংরক্ষণ কার্যক্রম আরও উন্নত হয়। সংখ্যা বৃদ্ধি এবং প্রজাতির জন্য একটি নিরাপত্তা জাল তৈরি করতে একটি ক্যাপটিভ ব্রিডিং [বন্দী প্রজনন] কর্মসূচি চালু করা হয়।
তাকাহে পাখিদের তিরিতিরি মাতাঙ্গি এবং কাপিতি দ্বীপের মতো শিকারিমুক্ত অভয়ারণ্যে স্থানান্তর করা হয়, যাতে তারা নিরাপদ পরিবেশে প্রজনন এবং নিজেদের বিকাশ ঘটাতে পারে।
সতর্কতা ও আশাবাদের এক সফল গল্প
আজ তাকাহে পাখি সংরক্ষণের এক সফল উদাহরণ। ১৯৪৮ সালে পুনঃআবিষ্কারের পর থেকে এই পাখির সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৫০০ হয়েছে।
তাকাহে এখন আইইউসিএন রেড লিস্টে "বিপন্ন" হিসেবে তালিকাভুক্ত। এটি একটি প্রজাতিটির বিপজ্জনক অবস্থাকে প্রতিফলিত করে, তবে সংরক্ষণ প্রচেষ্টার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিকেও স্বীকার করে।
তাকাহের বাসস্থান এখন শিকারিমুক্ত অভয়ারণ্য এবং মুর্চিসন পর্বতে ছড়িয়ে আছে। আক্রমণকারী প্রজাতির প্রভাব কমাতে ব্যাপক শিকারি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। শিকারিমুক্ত অভয়ারণ্যগুলোতে প্রজনন ও ছানা লালন-পালনের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।
নিউজিল্যান্ডের জনসচেতনতা ও সংরক্ষণ কর্মসূচি এই পাখিকে বাঁচাতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তবে ধীর প্রজনন, বিশেষায়িত বাসস্থানের প্রয়োজনীয়তা এবং পরিবেশগত পরিবর্তন এখনো এই পাখির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তাই তাকাহের ওপর নিবিড় নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।