সরকারি দপ্তরে ইন্টার্নশিপ: লাভবান হবে দুপক্ষই
ময়মনসিংহের জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষার্থী অনপুম সরকার ও মুস্তাফিজুর রহমান পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন শেষে চাকরি খোঁজার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু খুব দ্রুত তারা টের পেলেন, যতটা ভয় করেছিলেন তার চেয়েও বেশি সীমাবদ্ধ চাকরির বাজার। বর্তমানে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন নিয়োগকর্তারা।
'মনে হচ্ছে সব নিয়োগকর্তাই আজকাল অভিজ্ঞতা চান,' অনুপম বলেন।
তারা দুইজন বুঝতে পারলেন, চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে হলে কাজের কিছু অভিজ্ঞতা দরকার। কিন্তু বেসরকারি অফিসগুলোতে জায়গামতো ধরতে না পারলে ইন্টার্নশিপের সুযোগ পাওয়া বেশ কঠিন।
গত সপ্তাহে তারা বাংলাদেশ সরকারের নতুন ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামের কথা জানতে পেরেছেন। যদিও এখনো এ প্রোগ্রামের বিস্তারিত জানা যায়নি, তবে অনুপম আর মুস্তাফিজুর অনেক আশা নিয়েই সরকারি এ প্রকল্পে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
'আমার মতো কাজের অভিজ্ঞতাহীন গ্র্যাজুয়েটদের জন্য এ পলিসি আশীর্বাদ হয়ে উঠবে,' বলেন মুস্তাফিজুর।
সরকারি অফিসে ইন্টার্নশিপ কর্মী ও অফিসের ওপর কীরকম প্রভাব রাখতে পারে তার বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
ভাবী বিসিএস প্রার্থীদের প্রাথমিক ধারণা
বাংলাদেশে সরকারি চাকরির চাহিদা অনেক বেশি। তাই ভবিষ্যতে যারা সিভিল সার্ভিস বা অন্য কোনো সরকারি চাকরি করতে চান, সরকারি অফিসে ইন্টার্নশিপের সুযোগ পেলে তারা সরকারি সংস্থাগুলোতে কাজ করার গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারবেন।
'প্রাথমিক এ ধারণা (এক্সপোজার) তাদেরকে সরকারি অফিসের অভ্যন্তরীণ কর্মপদ্ধতি বিষয়ে নিগূঢ় ধারণা পেতে সাহায্য করবে। তারা প্রশাসনিক পদ্ধতির বিভিন্ন বিষয়ে পরিচিত হয়ে উঠবেন; কীভাবে সরকারের নীতিমাল ও প্রকল্প তৈরি, প্রণয়ন ও মনিটর করা হয় সে সম্পর্কে ধারণা পাবেন,' বলেন অ্যাস্পায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রামের পরিচালক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর।
পাবলিক সার্ভিস খাতে যোগাযোগ দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, ক্রিটিক্যাল চিন্তার দক্ষতা ও নেতৃত্বের গুণাবলিকে ভীষণ গুরুত্ব দেওয়া হয়। আর একজন সদ্য গ্র্যাজুয়েটকে এসব দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করতে পারে সরকারি অফিসে ইন্টার্নশিপ।
সরকারি অফিসগুলোতে অভিজ্ঞ পেশাদার লোকজনের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে তাদের সাংগঠনিক ও সময় ব্যবস্থাপনার দক্ষতায় উন্নতি এবং দলের সঙ্গে কাজ করার ও প্রশাসনিক কর্মপরিবেশে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতাকে বৃদ্ধি করবে।
নেটওয়ার্কের সুবিধা
সরকারি অফিসে ইন্টার্নশিপ কর্মীকে বেসরকারি অফিসে কাজ করার জন্যও প্রস্তুত করে তুলবে। ইন্টার্নশিপের সময় একজন ইন্টার্ন শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারবেন যা তাকে প্রাইভেট সেক্টরে কাজের সুযোগ এনে দেবে।
যেমন, বাংলাদেশ ব্যাংকে কেউ ইন্টার্নশিপ শেষ করলে এমন সব মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হবে, যা তাকে কোনো বেসরকারি ব্যাংকে যোগদানের পর বাড়তি সুবিধা দেবে। তেমনিভাবে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে ইন্টার্নশিপের পর বেসরকারি বিভিন্ন টেক্সটাইল কোম্পানিতে কাজের সুযোগ তৈরি হবে টেক্সটাইল গ্র্যাজুয়েটদের। এসব নেটওয়ার্ক গ্র্যাজুয়েটদেরকে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরিতে, তথ্যে অধিগম্যতা পেতে ও পার্টনারশিপ তৈরিতে সহায়তা করবে।
ড. কবীর মনে করেন, ভবিষ্যতে ক্যারিয়ারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় নেটওয়ার্ক এসব সরকারি ইন্টার্নশিপেই তৈরি সম্ভব। এসব নেটওয়ার্ক ইন্টার্নশিপের পর চাকরির সম্ভাব্য উৎস হতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।
সরকারের কর্মপদ্ধতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা
সরকারের বিভিন্ন বিভাগ সম্পর্কে ধারণা লাভ, সেগুলোর ভূমিকা ও দায়িত্ব, এসব এসব বিভাগ একত্রে কাজ করে কীভাবে সরকার ব্যবস্থাকে চালিয়ে নেয় — ইত্যাদি শেখা সম্ভব সরকারি অফিসে ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে। এমনকি যেসব ইন্টার্ন সুদূর ভবিষ্যতে সরকারি দপ্তরে কাজ করতে চান, তারাও ইন্টার্নশিপের সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা লাভ করতে পারবেন যা ভবিষ্যতে কেবল তাদের কর্মক্ষেত্রে নয় বরং একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে নিজেদের বিভিন্ন অধিকার ভোগের ক্ষেত্রেও কাজে দেবে।
বাংলাদেশ সরকার একটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। আর বিশাল এ কর্মযজ্ঞের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদেরকে ইন্টার্নিশিপের সুযোগ করে দেওয়া। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থী সময়ের প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদিক হাসান বলেন, 'প্রকৃত ক্যারিয়ার ফিল্ডের একটি প্রারম্ভিক সুযোগ এ ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম।'
সিভিও হবে ভারী
সরকারি অফিসে ইন্টার্নশিপ একজন প্রার্থীর সিভিকে আরও সমৃদ্ধ করবে। এর ফলে ভবিষ্যতে তাদের চাকরি পাওয়ার সুযোগ এবং এমনকি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শিক্ষা প্রোগ্রামগুলোতে ভর্তির সুযোগও বাড়িয়ে তুলবে।
সরকারি চাকরির বাইরে গিয়ে কেউ যদি পাবলিক পলিসি সম্পর্কিত কোনো কাজেও যোগ দিতে চান, তাহলেও এ পাবলিক সেক্টরে ইন্টার্নশিপ বেশ কাজে লাগবে। যেমন, একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ইন্টার্নশিপে যুক্ত হতে পারেন, আবার অর্থনীতি ও উন্নয়নবিদ্যার একজন গ্র্যাজুয়েট পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করতে পারেন। এ অভিজ্ঞতাগুলো তাদের ভবিষ্যৎ পড়ালেখা ও কর্ম অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সিভির মান আরও বাড়িয়ে তুলবে।
ইন্টার্নশিপের কারণে লাভবান হবে সরকারি অফিসগুলোও
সরকারি অফিসগুলোতে কাজ ধীরগতির হয় বলে অনেক অভিযোগ আছে। সেদিক থেকে দেখলে, তরুণরা সরকারি অফিসগুলোতে ইন্টার্নশিপ করলে এসব অফিসের কর্মদক্ষতায়ও গতি আসবে। তরুণ ইন্টার্নরা বিভিন্ন নতুন নতুন দৃষ্টিকোণ, আইডিয়াও অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারবেন যা সার্বিক উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতায় অবদান রাখবে।
ইন্টার্নরা প্রায়ই তরুণ ও উদ্যমী মানুষ হন যারা কর্মক্ষেত্রে এক স্বতন্ত্র শক্তি ও প্যাশনের সঞ্চার ঘটান। এর ফলে সরকারি অফিসের কর্মকর্তারাও আরও বেশি পরিমাণে ও সৃজনশীল উপায়ে কাজ করার ক্ষেত্রে উৎসাহ পাবেন।
এছাড়া ইন্টার্নদের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের জনসেবকদের মেন্টরিং ও পরামর্শ দিতে পারবেন বর্তমান সরকারি কর্মকর্তারা। এতে ব্যক্তিগতভাবেও তৃপ্তিলাভ করবেন তারা।
জনগণ ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে দূরত্ব কমানো
এসবের পাশাপাশি ইন্টার্নরা সরকার ও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দূরত্ব কমাতেও সাহায্য করতে পারবেন। এর মাধ্যমে দু্পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ ও বোঝাপড়া অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে।
এ ইন্টার্নেরা সরকার এবং জনগণ; উভয়ের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে পারবেন। সরকার ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমও হয়ে উঠতে পারবেন তারা।
'সরকারি ইন্টার্নশিপ ইন্টার্ন ও সরকার উভয়ের জন্যই একটি চমৎকার সুযোগ হতে পারে এবং আরও শক্তিশালী ও সক্ষম জনবল গড়ে তুলতেও সাহায্য করবে এটি,' বলেন ড. কবীর।
'এ প্রোগ্রামের মাধ্যমে অ্যাকাডেমিয়া ও ইন্ডাস্ট্রির মধ্যকার ফাঁকটুকু দূর করা যেতে পারে। আর পশ্চিমা দেশগুলো অনেক আগে থেকেই তা করছে,' বলেন অধ্যাপক সাদিক হাসান।
তিনি আরও বলেন, 'এ প্রোগ্রামের ফলে গ্র্যাজুয়েটরা সংশ্লিষ্ট খাতের কাজ সম্পাদনের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা লাভ করবেন, ইন্ডাস্ট্রিকে দক্ষ ও অভিজ্ঞ মানবসম্পদের যোগান দিতে পারবেন। ফলে এ প্রোগ্রাম দুপক্ষের জন্যই সমানভাবে লাভজনক হবে।'