কানাডা থেকে পানামা খাল, গ্রিনল্যান্ড থেকে মেক্সিকো উপসাগর—ক্ষমতা গ্রহণের আগেই যত উদ্ভট দাবি ট্রাম্পের!
সবসময় বিতর্কে থাকতে পছন্দ করেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউজের দায়িত্ব বুঝে নিতে এখনও বেশ কিছুদিন বাকি। তবে এরই মধ্যে কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য বানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, মেক্সিকো উপসাগরের নাম বদলে রাখতে চান 'গালফ অব আমেরিকা', নিয়ন্ত্রণ চেয়েছেন গ্রিনল্যান্ড ও পানামা খালেরও। ট্রাম্পের এসব উদ্ভট খায়েশ নিয়ে তোলপাড় চলছে আন্তর্জাতিক মহলে।
পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ও ভৌগোলিক পরিসর বাড়ানোর কথা বলে আসছেন।
জাস্টিন ট্রুডোর প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে কানাডাকে অঙ্গরাজ্য বানানোর প্রস্তাব দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ প্রস্তাবের জবাবে আলাস্কা ও মিনেসোটা কেনার পাল্টা প্রস্তাব দেন কানাডার অন্টারিও প্রদেশের প্রিমিয়ার ডগ ফোর্ড।
ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প বলেন, 'কানাডার অনেক মানুষ আমাদের ৫১তম রাজ্যের অংশ হলে বেশি খুশি হবে। কানাডাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি এবং ভর্তুকির চাপ যুক্তরাষ্ট্র ভোগ করবে না। জাস্টিন ট্রুডো এটা জানতেন, তাই তিনি পদত্যাগ করেছেন।'
কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হিসেবে দেখিয়ে নতুন মানচিত্রের ছবিও প্রকাশ করেছেন তিনি। ক্যাপশনে আবার লিখেছেন 'ওহ কানাডা'।
গত ২৪ ডিসেম্বর আবার নতুন করে গ্রিনল্যান্ড কেনার ইচ্ছার কথা জানান ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আর্কটিক অঞ্চলের এই বিশাল দ্বীপের মালিকানা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, 'বিশ্বব্যাপী জাতীয় নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে গ্রিনল্যান্ডের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য।'
ট্রাম্পের এই মন্তব্যের পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মুটে এগেদে। তিনি বলেন, 'আমরা বিক্রির জন্য নই—এবং কখনও বিক্রি হবও না।'
২০১৯ সালে প্রথম বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন ট্রাম্প। ওই সময়ও তার মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান দ্বীপটির নেতারা।
ডেনমার্কের তৎকালীন—এবং বর্তমান—প্রধানমন্ত্রী মেট ফ্রেডরিকসেন, এই প্রস্তাবকে 'হাস্যকর' বলে অভিহিত করেন। এর জেরে ট্রাম্প ওই সময় তার ডেনমার্ক সফর বাতিল করেছিলেন।
অন্যদিকে, বিশ্ববাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ জলপথ হল পানামা খাল। ট্রাম্পের দখলের তালিকা থেকে বাদ যায়নি তা-ও। গত শতকের গোড়ায় আমেরিকাই প্রশান্ত এবং আটলান্টিক মহাসাগরের সংযোগরক্ষাকারী এই খালটি খনন করেছিল। তাদের হাতেই পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ ছিল। পরে ১৯৯৯ সালে মধ্য আমেরিকার দেশ পানামার হাতে পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়েছিল ওয়াশিংটন।
পানামা খাল দিয়ে মার্কিন জাহাজ পারাপারের জন্য পানামা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে, এমন অভিযোগ তুলে খালটির নিয়ন্ত্রণ দাবি করেন ট্রাম্প।
ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লেখেন, 'আমাদের নৌবাহিনী ও বাণিজ্যের সঙ্গে অত্যন্ত অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে। পানামা যে ফি নিচ্ছে, তা একেবারেই হাস্যকর।'
কয়েকদিন পর ট্রুথ সোশ্যালে একটি ছবিও পোস্ট করেন। ছবিতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা একটি সরু জলপথের উপর উড়ছে। ক্যাপশনে লেখেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের খালে স্বাগতম!'
এমন বক্তব্যের পর ট্রাম্প এবং পানামার প্রেসিডেন্ট রিকার্ডো মুলিনো বাকবিতণ্ডায় জড়িয়েছেন।
মুলিনো এক ভিডিও বার্তায় বলেন, 'পানামা খাল এবং তার আশেপাশের প্রতিটি স্কয়ার মিটার পানামার এবং ভবিষ্যতেও পানামারই থাকবে।'
আরেক পোস্টে ট্রাম্প বলেন, 'পানামা খাল পরিচালনার দায়িত্ব শুধুই পানামার, চীনের বা অন্য কারও নয়। আমরা কখনোই এটাকে ভুল হাতে যেতে দেবো না।'
এরপরে রোববার এক্স-এ দেওয়া আরেক বার্তায় মুলিনো বলেন, 'পানামা খালে চীনের কোনো প্রভাব নেই।'
মেক্সিকো থেকে আগত অভিবাসীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই সরব ট্রাম্প। ২০১৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে প্রচারণার সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প মেক্সিকান অভিবাসীদের নিয়ে একটি অত্যন্ত বিতর্কিত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, 'মেক্সিকো আমাদের কাছে তাদের ভালো লোকজন পাঠাচ্ছে না। তারা ড্রাগ, অপরাধ এবং ধর্ষণকারীদের পাঠাচ্ছে। কেউ কেউ হয়ত ভালো লোক, কিন্তু বেশিরভাগই সমস্যার কারণ।'
এটি যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতি এবং মেক্সিকোর সঙ্গে সম্পর্কের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। তার এই মন্তব্যের পর ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং অভিবাসী অধিকার কর্মীরা ট্রাম্পের বক্তব্যকে জাতিবিদ্বেষী ও বৈষম্যমূলক বলে অভিহিত করেন সে সময়।
তবে দ্বিতীয় বারের মতো আমেরিকার মসনদে বসার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার ঘোষণা করেছেন, মেক্সিকো উপসাগরের নামটাই বদলে দিতে চান তিনি!
মার-এ-লাগোতে সাংবাদিক বৈঠকে ট্রাম্প বলেন, 'আমরা মেক্সিকো উপসাগরের নাম পরিবর্তন করে আমেরিকা উপসাগর করতে যাচ্ছি। যেখানে একটি সুন্দর বলয় রয়েছে।'
এর জবাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উত্তর আমেরিকার নাম পরিবর্তন করে 'মেক্সিকান আমেরিকা' রাখার পরামর্শ দিয়েছেন মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লদিয়া শেনবাউম।
প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় ১৬০৭ সালের একটি মানচিত্রের দিকে ইঙ্গিত করে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট রসিকতাচ্ছলে বলেন, এ মহাদেশের নাম রাখা উচিত 'আমেরিকা মেক্সিকানা', বা 'মেক্সিকান আমেরিকা'।
'নামটা বেশ সুন্দর শোনাচ্ছে, তাই না?' উত্তর আমেরিকার নতুন নাম প্রস্তাব করে ব্যঙ্গের সুরে বলেন শেনবাউম। মজার ছলে এমন জবাব দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে এমন আশা ব্যক্ত করেছেন তিনি।
ট্রাম্পের বিতর্কিত মন্তব্য এবং উক্তি তাকে প্রায়ই সংবাদের শিরোনামে নিয়ে এসেছে। তার সমর্থকরা একে তার সৎ এবং স্পষ্টভাষী চরিত্র হিসেবে দেখেন, তবে সমালোচকরা মনে করেন, এসব মন্তব্য বিভাজন এবং বিদ্বেষ সৃষ্টি করে।
তবে কথার চেয়ে কাজে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে ট্রাম্পকে। নানা ধরনের অযৌক্তিক প্রস্তাব দিয়ে বিশ্ব রাজনীতির আলোচনায় থাকলেও, আগামী ২০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর, ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি, ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তার প্রশাসনের কৌশল কেমন হবে—তা দেখার জন্য বিশ্ববাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।