স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও অমীমাংসিত পরিবেশ-প্রশ্ন
মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের একটি গান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। 'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি'। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে আজ দুনিয়া আরো এক মুক্তি আন্দোলনে সামিল। পরিবেশবিনাশী বাহাদুরির বিরুদ্ধে আজকের এই সংগ্রাম। মাতৃদুনিয়ার টিকে থাকবার শর্ত ও কারিগরি সুরক্ষার লড়াই। কেবল ফুল, পাখি, মাছ, জল, জংগল, মাটি, মানুষ নয়। আজ আর একটি-দুটি দেশ কেবলমাত্র নয়। পৃথিবী নামের এই গ্রহ আজ জীবনমরণের এক প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়েছে। কারণ, ২০০ বছর ধরে পৃথিবীকে নিয়ে ধনী আর উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রসমূহ এক নির্দয় খেলা খেলে চলেছে। খেলাটির বাহারি নাম 'শিল্প বিপ্লব' এবং 'উন্নয়ন'।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে দুনিয়ার স্রোতস্বিনী নদীগুলো বাঁধ দিয়ে খুন করা হয়েছে। অরণ্যের হাড় পাঁজর খুবলে টেনে তোলা হয়েছে বুকের দম আর ধমনীর রক্ত। বাজারের অভিধানে যার নাম কয়লা, তেল আর গ্যাস।দুনিয়ার সব কৃষিজমির মাটি আজ বিষাক্ত আর পিপাসার্ত। প্রতিদিন এই মাটি আরও সার ও বিষ খেতে চায়, প্রতিদিন বাড়ছে পানির জ্বালা। কৃষিকে ঘিরে এই হত্যাকান্ডের পুস্তকি নাম 'সবুজ বিপ্লব'। শহরের ভোগবিলাসী মানুষ একটু আরাম করবে বলে বাতাসে ছড়িয়েছে সীসা আর পানিতে আর্সেনিক। আজ কাউকে কোনো খাবার দিলে সন্দেহ আর আশংকামুক্ত হয়ে সে কামড় বসাতে পারে না, কাউকে এক পেয়ালা পানি দিলে নি:সংকোচে গিলতে পারে না। খাদ্য আজ অবিশ্বাস আর আংশকাকে আমদানি করে টেনে এনেছে বেদে বহরের হোড়া থেকে শহরের দীর্ঘ দালান পর্যন্ত। এ কেবল বাংলাদেশ নয়, তৃতীয় দুনিয়া নয়, এ ঘটনা বিশ্বব্যাপী ঘটে চলেছে। এক নির্দয় প্রশ্নহীন রক্তপাত। কিন্তু এই কী ঘটে চলবে? এভাবেই কি মাতৃদুনিয়ার করুণ মরদেহ নিয়ে দাঁড়াবে মানুষ। দুনিয়ার ৭০০ কোটি মানুষের কী কোনো দায় নাই? তবে ৭০০ কোটির দায় ও দায়িত্ব কি সমান? নিশ্চয়ই নয়।
২.
মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে চলতি আলাপখানি দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য ঘিরে একটা সাধারণ আলাপ তুলতে চায়। পঞ্চাশ বছরের স্বাধীন দেশে কেমন আছে দেশের প্রাণ ও প্রকৃতি?
দীর্ঘ এই পঞ্চাশ বছরে মানুষের সংখ্যা তরতর করে বেড়েছে। কিন্তু, নিদারুণভাবে নিখোঁজ হয়েছে বাঘ, শকুন, হাতি, বনরুই কী বটগাছ। গ্রামের পর গ্রাম সবুজ ধানক্ষেত আর পাটের জমিন দুমড়েমুচড়ে তৈরি হয়েছে হাপিত্যেশ নগর। স্বাধীনতার এই দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে আমরা হারিয়েছি তিনটি ঋতুর অবিরল বৈচিত্র্য। শরত, হেমন্ত আর বসন্ত উধাও হয়েছে ষড়ঋতুর বাংলাদেশ থেকে। আগে চারপাশে শাকসব্জি-ফলমূল দেখে ঠাহর করা যেত- সেটি কোন ঋতু, কোন কালের চিহ্ন। উৎপাদনমুখী বাণিজ্যিক কৃষির চাপে তা আর ঠাহর করা যাচ্ছে না। চারদিকে শস্য-ফসলের ঠাসা উৎপাদন। দামে সস্তা। কিন্তু সেই স্বাদ-গন্ধ আর পুষ্টি কোথায়? এমনকি এসব ফলাতে গিয়ে বিপুল সার-বিষ ঢালতে হচ্ছে মাটিতে। খাবারে মিশে গেছে বিষ, বিপদজনক সীসা আর ধাতব দূষণ। ক্যান্সারসহ জটিল অসুখ নিত্য বাড়ছে গ্রাম কী শহরে।
গত পঞ্চাশ বছরে বেশকিছু নির্দয় দমবন্ধ পরিবেশগত পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠেছে। চারপাশে তৈরি হয়েছে অনেক নতুন যন্ত্রণাময় শব্দভান্ড। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ, দূষিত পানি, বননিধন, বৃক্ষউজাড়, কালোধোঁয়া, ইটের ভাটা, কৃষিজমি হ্রাস, নদী দখল, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, সীসাদূষণ। এরকম পরিস্থিতিগুলো তৈরি করেছি আমরাই, প্রিয় জন্মভূমিতে, গত পঞ্চাশ বছরে। পাশাপাশি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বেড়েছে লবণাক্ততা ও ঘূর্ণিঝড়, উত্তরাঞ্চলে তাপদাহ ও খরা, উত্তর-পূর্বে পাহাড়ি ঢল, মধ্যাঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ধস, দেশজুড়ে নদীভাঙন, বজ্রপাত, অগ্নিকান্ড, রাসায়নিক বিস্ফোরণ, জলাবদ্ধতা।
রক্তজয়ী স্বাধীনতার স্বাদ এখনো পায়নি দেশের সামগ্রিক প্রাণ ও প্রকৃতি। পরিবেশের আয়নায় তাকালে পঞ্চাশ বছরের এক স্বাধীন দেশকে আজ আমাদের কাছে কেমন মনে হয়? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বুকের অতল থেকে আজ নিজেকেই আসুন এই প্রশ্নটি করি। দেশের প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষা ও বিনাশে আমাদের ভূমিকা কী ছিল গত পঞ্চাশ বছর? কীভাবে আমরা এই ক্ষত ও দাগ সারিয়ে তুলতে নিজ থেকে উদ্যোগী হতে পারি? প্রাণ-প্রকৃতির অনিন্দ্য বিকাশের সম্ভাবনাকে স্বাধীনতার শতবর্ষে আমরা কেমন দেখতে চাই?
৩.
একটা সময় রাজা-বাদশাহের আমলে বাঘ, হরিণ, বুনোমহিষ, গয়াল, অজগর, গন্ডার খুন করাকে 'অভিজাতপনা' হিসেবে দেখা হত। সেই কাল চলে গেছে। বন্যপ্রাণী হত্যাকে রাষ্ট্র এখন 'অবৈধ' ও 'বেআইনী' ঘোষণা করেছে। কিন্তু, তার মানে কি বন্যপ্রাণী হত্যা বন্ধ হয়েছে? বরং, বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য আরো মোটাতাজা হয়েছে। চাইলে বাঘ কী বনরুই নিমিষেই হাজির হবে। শুধু পয়সা ছড়ালেই হয়। সবুজ বিপ্লবের নামে মাটি ও শস্যদানা সব আজ বিষাক্ত। কিন্তু এই বিষ কে খাচ্ছে? আর কে খেতে চাচ্ছে না!
বলা হয় সচেতন মানুষ সার-বিষে ভরা এমনতর 'অনিরাপদ খাদ্য' খেতে চায় না। তারা গ্রামের টাটকা ফল-ফলাদি, গৃহস্থ বাড়ির সতেজ দানা আর নদীর খলবলে মাছ খেতে চায়। এই 'সচেতন' মানুষ কারা? গ্রামের গরিব কৃষিমজুর না শহরের ধনী চাকুরে বা ব্যবসায়ী? সকলেই সচেতন হলেও, গ্রামের গরিব কৃষিমজুর যারা আজও কৃষি-জুমের কাস্তে কী হাল ধরে রেখেছে তাদের পক্ষে কি সার-বিষহীন নিরাপদ খাবার খাওয়া সম্ভব? করপোরেট চেইন শপগুলো যেসব খাবারের নাম দিয়েছে 'অর্গানিক ফুড'? কারণ নিরাপদ খাবারের দাম বেশি। প্রশ্নটা কিন্তু অন্য জায়গায়। এসব সার-বিষের ব্যবসা কে করে আর এসব ব্যবহার করে কারা?
মনস্যান্টো কোম্পানির রাউন্ডআপ সারা দুনিয়ার বহুল বিক্রিত 'আগাছানাশক'। বাংলাদেশের চাবাগানেই এর ব্যবহারের অনুমোদন আছে। সিনজেনটা কোম্পানির রিফিট নামের একটি 'আগাছানাশক' বাংলাদেশের সর্বত্র বিক্রি হয়। দেখা গেছে, এসব রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে জমির শাকলতাগুল্ম ও ঔষধি গাছলতা সব মারা যায়। শামুক, কেঁচো, কুচে, ঘুঘরা পোকা, মাকড়সা, ফড়িং মরে যায়। এসব ব্যবহারের ফলে মানুষও আক্রান্ত হয় পেট ও শ্বাসনালীর নানা জটিল রোগে। প্রশ্ন হলো, মনস্যান্টো বা সিনজেনটা কোম্পানির মালিকের বাসায় কি সার-বিষ দেওয়া খাবার রান্না হয়? তাদের পরিবার-পরিজন কি হাইব্রিড ফসলের খাবার খায়? নিশ্চয়ই নয়। কারণ দুনিয়ার সবচে ভাল, সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাবারগুলো তাদের পাতেই যায়। আর দুনিয়ার একটা বড় অংশের পাতে পড়ে থাকে বিষাক্ত খাদ্যের উচ্ছিষ্ট। কারণ, এই বড় অংশটিই নিজের কলিজা ফানা ফানা করে বহুজাতিক কোম্পানির বিষ আর সংহারী বীজ ব্যবহার করতে বাধ্য। নিরাপদ খাদ্য আর নিরাপত্তা বলতে এই গরিব নিম্নবর্গের জন্য কিছুই নেই। সকল নিরাপদ আর নিরাপত্তা বহুজাতিক কোম্পানির মালিকদের। তার মানে রাজা-বাদশাহর আমল শেষ হলেও বিদ্যমান শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও বৈষম্যমূলক মনস্তত্ত্ব গায়েব হয়ে যায়নি। বরং আরো ভিন্নরূপে জোরালো ও দশাসই হয়েছে। গোটা দুনিয়া আজ করপোরেট সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি। তাদের নির্বিচার চাবুকের রক্তদাগ নিয়ে প্রতিদিন আমাদের ঘুম ভাঙে, তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে আমাদের কাহিল শরীর এলিয়ে পড়ে। মাতৃদুনিয়া কারো একতরফা পণ্য নয়। এটি কোনোভাবেই আমরা হতে দিতে পারি না। দুনিয়ার শরীর ও স্বাস্থ্যকে বহুজাতিক জিম্মায় ছেড়ে দিতে কোনোভাবেই আমাদের দায় এড়িয়ে যেতে পারি না।
৪.
পরিবেশ সুরক্ষা ও মাতৃদুনিয়ার দুর্দশার প্রশ্নটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক। বিচারহীন পরিবেশ-মুমূর্ষু দুনিয়ায় পরিবেশ-সুরক্ষা প্রশ্নকে বারবার অরাজনৈতিক করে দেখা হয়। বাহাদুরি আর ক্ষমতার গণিতকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। যেন পরিবেশ-সুরক্ষা মানে হলো কিছু 'গাছের চারা লাগানো'। কিংবা প্রাকৃতিক বনভূমিকে 'সংরক্ষিত বন' বানানো বা জলাভূমিকে দখল করে 'অভয়াশ্রম' এর সাইনবোর্ড টানানো। বড়জোর কৃষিতে রাসায়নিকের ব্যবহার কমিয়ে 'সমন্বিত বালাইনাশক' বা 'জিন প্রযুক্তিতে পরিবর্তিত জিএম বিটিবেগুনের' অনুমোদন। একটি ঢাকতে গিয়ে আরেকটি জুলুম চাপিয়ে দেয়া। একটি করপোরেট বাহাদুরির সাথে আরো প্রশ্নহীন অন্যায়ের বৈধতা। পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নকে স্থানীয় প্রতিবেশ ও বাস্তুসংস্থানের ঐতিহাসিকতা থেকে দেখতে হবে। প্রাণবৈচিত্র্যের সাথে চারপাশের নানা জীবনের নানা জটিল বহুমাত্রিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েই পরিবেশ সুরক্ষার যাত্রা শুরু করতে হবে। মাটি বাঁচাতে গিয়ে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বন্ধ করে মনস্যান্টোর হাইব্রিড ভূট্টা বীজের অনুমোদন দেওয়ার মাধ্যমে এটি হতে পারে না। কারণ, এই হাইব্রিড ভূট্টা বীজ স্থানীয় বীজ-সংস্কৃতিকে আঘাত করে। এটি পরাগায়নে অভ্যস্থ পতঙ্গ পাখির জন্য হুমকি তৈরি করে। মাটির স্বাস্থ্য ও গঠন ওলটপালট করে দেয়। গাছ লাগালেই পরিবেশ রক্ষা হয় না। গাছ লাগানোর নামে সারা দেশে একাশিয়া আর ইউক্যালিপটাসের মতো আগ্রাসি গাছের অনুমোদন কোনোভাবেই পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করে না। কারণ, এসব আগ্রাসি গাছ মাটির তলার জল শুষে নেয় মাত্রাতিরিক্ত হারে, পরাগরেণু এলার্জি তৈরি করে আর পশুপাখির জন্য বিপজ্জনক খাদ্য-বিশৃংখলা তৈরি করে।
৫.
জাতীয় ও আন্তজার্তিক নীতি, আইন ও সদন তৈরির ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই তা নিম্নবর্গের আকাংখা ও মনোজগতকে স্পর্শ করে না। তাই দেখা যায় অধিকাংশ নীতিমালাই বছরের পর বছর কার্যহীন ও বিকল সময় পাড়ি দেয়। নীতিমালা গ্রহণের এই জনবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া থেকে সরে এসে জনগণের যাপিতজীবনের প্রেক্ষাপটকে বিবেচনা করেই নীতিমালা গ্রহণ করা জরুরী। কারণ, একটি নীতিমালায় দেশের সামগ্রিক দর্শন, মূল্যবোধ, চিন্তাকাঠামো, রাজনৈতিক পরিসর ও রাষ্ট্রের চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠে। যদি নীতিমালার মাধ্যমে রাষ্ট্রের দর্শনই জনগণের দর্শন হিসেবে চাপানো হয় তবে আর রাষ্ট্রের জনগণতান্ত্রিক পরিচয় নেওয়ার দরকার থাকে না।
পরিবেশ নীতিমালায় দেশের জনগণের সামগ্রিক চিন্তা ও দর্শনই কোনো জাতীয় নীতিমালার কেন্দ্রীয় মৌলভিত্তি হওয়া প্রয়োজন। নিদারুণভাবে পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্পর্কিত বিরাজমান নীতিসমূহ জনগণের সামগ্রিক স্বর ও ভঙ্গিকে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই দেখা যায়, দুম করেই পরিবেশপ্রক্রিয়ার সামগ্রিক শৃংখলাকে তছনছ করেই কোনো উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু হয়। বাঁধ, প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাহীন উত্তোলন, বিনোদনপার্ক, সামাজিক বনায়ন, বহুজাতিক রাসায়নিক কৃষি, অবকাঠামো, বৃহৎ সড়ক ও রেলপথ, নগরায়ন, কলকারখানা, বিলাসী হোটেল, শিল্পদূষণ এরকমের নানান উন্নয়ন-মারদাঙ্গা আজ বাংলাদেশসহ মাতৃদুনিয়াকে গলা টিপে হত্যা করে চলেছে। মাতৃদুনিয়াকে সুস্থ রাখতে হলে দরকার বিশ্বব্যাপী গণজাগরণ। দরকার দেশে দেশের নিম্নবর্গের দর্শন ও পরিবেশ-সংগ্রামের সাথে ঐক্য ও সংহতি।
আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সুন্দরবনের মৌয়াল ও বাওয়ালি থেকে শুরু করে সাথে আমাজন বনের আদিবাসীদের পরিবেশ-সুরক্ষার বিজ্ঞানকেও একত্রে আগলে দাঁড়ানো জরুরি। কিলিমাঞ্জারো থেকে কৈলাশ, কামচাটকা থেকে কেওক্রাডং। প্রেইরি থেকে যমুনার বিস্তীর্ণ কাশবন, গোবি মরুভূমি থেকে নীল নদ। রাষ্ট্র নয়, সংহতি গড়ে ওঠুক বাস্তুসংস্থানের সাথে বাস্তুসংস্থানের। এক পরিবেশ-প্রক্রিয়ার সাথে আরেক পরিবেশ প্রক্রিয়ার। এক প্রতিবেশ-ভূগোলের জনজীবনের সাথে আরেক প্রতিবেশ-ভূগোলের। কেবল গরিব আর মেহনতি নিম্নবর্গ নয়। আজ জাগতে হবে ধনী আর বিলাসীদেরও যারা একইসাথে 'শিক্ষিত', 'আধুনিক' আর 'উন্নত' হিসেবেও পরিচিত। মাতৃদুনিয়ার প্রতি দায়বদ্ধতার ব্যাপারে তাদেরকে বাধ্য করতে হবে। কারণ গরিব মেহনতি নিম্নবর্গ পরিবেশ বিনাশ করে না, কার্বন নির্গমনে তার কোনো ভূমিকাও নাই। বায়ুদূষণ কী রাসায়নিক দূষণ সে আমদানিও করেনি। এসব দূষণ, বিনাশ, দখল সবই ধনী আর বিলাসীদের কারবার।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে, আগামীর এক নির্মল সুস্থ বাংলাদেশকে যদি আমরা দেখতে চাই- তবে অবশ্যই সবাইকে দায়বদ্ধ ও দায়িত্বশীল হতে হবে। পিৎজাহাটে বা কেএফসিতে গিয়ে কামড় বসানোর আগে বা ঢকঢক করে কোক-পেপসি গলায় ঢালার আগে; একটিবার ভাবতে হবে এই লাগামহীন ভোগবিলাসিতা দুনিয়াকে কোথায় ঠেলে দিচ্ছে। অন্যায় ভোগবিলাসিতার কারণে মাতৃদুনিয়ার শরীর ও মনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে তার দায়ভার দুনিয়ার সকল ধনী, বিলাসী উচ্চবর্গকে নিতেই হবে। কারণ, তা না হলে কোনোভাবেই এই পৃথিবী খুব বেশি দিন টিকবে না। আমরা কোনোভাবেই মাতৃদুনিয়ার এই করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারি না। স্বপ্ন দেখি আবারো ছয়টি ঋতু ডানা মেলবে দূষণমুক্ত নির্মল বাংলাদেশে। আসুন সবাই নিয়ত করি, প্রস্তুত হই। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশের প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় দেশময় জোরালো আওয়াজ তুলি।
- লেখক পরিচিতি: গবেষক ও লেখক