নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা সংসদীয় কমিটির অদ্ভুত সুপারিশ
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের শীর্ষ তিনটি পদ হল স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতা এবং সংসদ নেতা'র পদ। বর্তমানে এই তিন পদেরই নেতৃত্বে আছেন তিন জন নারী। অথচ এই সংদেরই একটি সংসদীয় কমিটি নারীদের বিষয়ে অদ্ভুত এক সুপারিশ করে বসেছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশ করেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের 'গার্ড অব অনার' দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী কর্মকর্তাদের যেনো বাদ রাখা হয়।
নারীর জন্য অবমাননাকর এই সুপারিশ বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের উপরও সরাসরি আঘাত। শুধু তাই নয়, এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সংবিধানেরও পরিপন্থী।
রোববার সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এই সুপারিশটি করার পর এটির বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেছে সরকারকে ।
যখন দেশের প্রধান নির্বাহী একজন নারী, তখন এই সংসদীয় কমিটির সদস্য হিসেবে থাকা কয়েকজন এমপি মেনে নিতে পারছেন না যে একজন নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দেবেন।
এই সুপারিশ করার সময় তারা সংবিধানের ধারাগুলোরও তেমন একটা তোয়াক্কা করেননি। বাংলাদেশের সংবিধান লিঙ্গ এবং ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য তৈরিতে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
সংসদীয় এই কমিটির অত্যন্ত গর্হিত এই সিদ্ধান্তের কারণে সংবিধান কর্তৃক নিশ্চয়তা পাওয়া নারীদের কিছু মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।
সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, "সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।" আর ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।"
সংবিধানের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে আরও বলা আছে, "কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।"
কিন্তু হায়! এই সংসদীয় কমিটি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের 'গার্ড অব অনার' দিতে ইউএনও'র দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নারীদের অযোগ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
অযৌক্তিক পদক্ষেপটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনারও পরিপন্থী। অথচ একত্তরের রণাঙ্গনে আমাদের নারীরাও পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধ করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফসল আমাদের বাংলাদেশের সংবিধানে দ্ব্যর্থহীনভাবে যে মৌলিক উচ্চ আদর্শগুলোর ঘোষণা রয়েছে সেগুলো হল- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।
ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নারীকে বৈষম্যের বিষয় হিসেবে তৈরি করা যায় না। দুর্ভাগ্যক্রমে, উল্লিখিত সংসদীয় কমিটি এই কাজটিই করেছে।
এবং এইভাবে, এটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনের ১০ নম্বর অনুচ্ছেদটিকেও গুড়িয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করেনি। সেখানে বলা আছে, "মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।"
সারাদেশের প্রায় পাঁচশো উপজেলার মধ্যে উপজেলার সর্বোচ্চ পদ ইউএনওর দায়িত্ব পালন করছেন কম বেশি ১০০ জন নারী।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়ে আসছে বাংলাদেশ।
তবে গত রোববার উক্ত সংসদীয় কমিটি নারীর ক্ষমতায়নের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় লিখে দিয়েছে।
এই সুপারিশের পক্ষে যুক্তি হিসেবে ওই সংসদীয় কমিটির একজন সদস্য বলেছেন, নারী ইউএনও গার্ড অব অনার দিতে গেলে স্থানীয় পর্যায়ে অনেকে 'প্রশ্ন' তোলেন।
এ ধরনের খোঁড়া ও অদ্ভুত অজুহাতের মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া এমপিরা প্রকৃতপক্ষে নারী ক্ষমতায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মৌলবাদী শক্তিগুলোর অপচেষ্টাতেই যোগ দিয়েছেন।
নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে থাকা এই ব্যক্তিদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক এবং তাদের উচিত দেরি না করে সংসদীয় কমিটির ওই বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে এমন হঠকারি বিষয় বাদ দেওয়া।
- লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা ইংরেজিতে পড়ুন: A JS body's odd decision to belittle women
- বাংলায় অনুবাদ: তারেক হাসান নির্ঝর