পরীমনি কাহিনী: আইনের শাসনের একটি উদ্বেগজনক গল্প
জামিন নিয়ে দেশে যেসব আইন আছে সেগুলো বেশ সহজ এবং স্পষ্ট। এসব আইন বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িতদের স্বেচ্ছাচারী কাজকর্ম থেকে একজন গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয় এবং তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও জীবনকে উপভোগ করার অধিকারকে সমর্থন করে।
কিন্তু স্বেচ্ছাচারী ব্যবহারের কারণে এই একই আইন চিত্রনায়িকা পরীমনির ক্ষেত্রে মাকড়সার জাল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এই চিত্রনায়িকাকে ২৭ দিনের জন্য থাকতে হয়েছে কারাগারের ভেতর। মাদকের একটি মামলায় বেশ কয়েকবার তার জামিনের আবেদন করা হলেও তা নামঞ্জুর হয়। একই সময়ে তাকে তিন দফায় ৭ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
যখন কোনো ব্যক্তি জামিনযোগ্য অপরাধে গ্রেপ্তার হন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার জামিনে মুক্তি পাওয়ার অধিকার থাকে। জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি জামিনের অধিকারী হন না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির জন্য সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী বিচারকরা তাদের বিচারিক বিবেচনার ভিত্তিতে অভিযুক্তকে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন।
মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ না থাকলে ওই ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পেতে পারেন।
তবে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলেও এক্ষেত্রে আইনে নারী, শিশু এবং অসুস্থ ব্যক্তিরা অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন।
ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৬ এবং ৪৯৭ নম্বর ধারাতে স্পষ্টতই জামিনযোগ্য এবং অ-জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে নির্দেশিকা দেওয়া আছে। এই ধারাগুলো সংবিধানের ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত 'জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকাররক্ষণ'কে সমর্থন করে। সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, "আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।"
এর অর্থ হল, একজন অভিযুক্তকেও তার জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এটি ন্যায় বিচারের অন্যতম মৌলিক নিয়ম।
তবে এই আইনের আলোকে পরীমনি জামিনে মুক্ত হতে পারেননি কারণ নিম্ন আদালতের দুই বিচারক তাদের স্বীয় ইচ্ছাধীন বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে জামিন মঞ্জুর করেননি।
পরীমনির বিরুদ্ধে মদের বোতল রাখার অভিযোগ হওয়ায় তার নামে হওয়া মামলাটি অ-জামিনযোগ্য। সুতরাং তিনি দণ্ডবিধির ৪৯৬ ধারা অনুযায়ী জামিন পাওয়ার অধিকারী নন। তবে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগটির সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছরের কারাদণ্ড - মৃত্যুদণ্ড নয়।
সুতরাং, বিচারিক কাজের স্বাধীনতার ক্ষমতা প্রয়োগ করে, বিচারকরা দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় পরীমনিকে জামিন দিতে পারতেন। তাছাড়া, একজন নারী হওয়ায় তার জামিন পাওয়ার অতিরিক্ত সুযোগও ছিল।
কিন্তু নিম্ন আদালতের বিচারকরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আবেদনে সাড়া দিয়ে তাকে দফায় দফায় জেরা করতে পুলিশ হেফাজতে রাখেন এবং তার জামিন নামঞ্জুর করেন। এমনকি শুনানি ছাড়াই বিচারকরা তার শেষ জামিনের আবেদন ২১ দিন মূলতবি রাখেন।
পরীমনি যখন মাকড়সার এই জাল থেকে মুক্তি পেতে লড়াই করছিলেন, তখন এতে হস্তক্ষেপ করেন হাইকোর্ট। এরপর নিম্ন আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন, কারাগার থেকে বের হওয়ার অনুমতি দেন।
পরীমনির এই মামলাকে কেন্দ্র করে আইনের এ ধরণের চর্চা এবং তাকে বারবার রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়টি হাইকোর্টের বিচারকদের আইনগত মননে ধাক্কা দেয়। যার প্রেক্ষিতে তারা এই মন্তব্য করতে বাধ্য হন যে, "সভ্য সমাজে এভাবে চলতে পারে না।" গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাইকোর্ট আরও পর্যবেক্ষণ করে যে, নিম্ন আদালতের বিচারকরা পরীমনির বিরুদ্ধে হওয়া মামলায় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন।
মাদকের এই মামলায় পরীমনিকে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দফায় রিমান্ডে পাঠানোয় নিম্ন আদালতের দুই বিচারকের কাছে এর ব্যাখ্যা চেয়েছেন হাইকোর্ট। এছাড়াও হাইকোর্ট এই মামলায় পরীমনির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার রিমান্ডের আবেদন করার কারণ জানতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে ১৫ সেপ্টেম্বর প্রাসঙ্গিক নথি নিয়ে আদালতে হাজির হতে বলেছেন।
এই পুরো কাহিনী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং নিম্ন আদালতের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে এবং দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দুর্বল অবস্থার উপর আলোকপাত করে।
পরীমনিকে কারাগারের ভেতর রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমন নাছোড়বান্দা আচরণ করেছে কেন?
তাদের এই বেপরোয়া মনোভাব জনসাধারণের মনে এমন ধারণার জন্ম দিয়েছে যে, এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ঢাকা বোট ক্লাবে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করায় এখন পরীমনিকে ভিক্টিম বানানো হচ্ছে। ধনী ও ক্ষমতাবান একটি অংশ পরীমনির 'ডানা' কেটে দিতে চাচ্ছে।
পুরো ঘটনায় এই চিত্রনায়িকাকে যথেষ্ট শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তবে এর জন্য সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে এই রাষ্ট্রকে। এ ঘটনায় মনে হয়েছে, কেবলমাত্র একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং নিম্ন আদালতের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অযৌক্তিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
নিম্ন আদালতের স্বাধীনতার অভাব কয়েক দশক ধরেই একটি সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। ক্ষমতায় আসা একের পর এক সরকার সংকীর্ণ রাজনৈতিক লাভের জন্য অধস্তন বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। নিম্ন আদালত এখনও সরকার দ্বারা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত, যদিও সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকে এর উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার ক্ষমতা দিয়েছে।
কিন্তু পরীমনির এই ঘটনা আরও উদ্বেগজনক চিত্র উন্মোচন করেছে। অধস্তন বিচার বিভাগ যে ধনী ও শক্তিশালী মহল দ্বারাও প্রভাবিত হতে পারে সেই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এ ঘটনায়।
এই পুরো ঘটনায় সরকারের কোনো লাভ নেই। তবে সব সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে সরকারকেই।
এই মামলায়, পরীমনির জামিনের তীব্র বিরোধিতার জন্য পাবলিক প্রসিকিউটরের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
একজন আদর্শ প্রসিকিউটর অবশ্যই নিজেকে ন্যায়বিচারের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করেন। প্রসিকিউটর হতে হবে নিরপেক্ষ, ন্যায্য এবং সত্যবাদী। কিন্তু পরীমনির ক্ষেত্রে মেট্রোপলিটন পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু এই অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে গিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ নিয়েছেন।
এই মামলায়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, অধস্তন আদালতের দুই বিচারক এবং পাবলিক প্রসিকিউটের ভূমিকায় মনে হয়েছে, তারা আইনের শাসনের মৌলিক নীতিটি উপেক্ষা করেছেন। এই নীতি অনুযায়ী, ব্যক্তির স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে এমন কোনো পদক্ষেপও অবশ্যই আইন অনুযায়ী হতে হবে।
এ মামলায় হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ প্রমাণ করে যে, পরীমনির জামিন নামঞ্জুর আইনানুগভাবে হয়নি- যার ফলে সংবিধানে দেওয়া নাগরিকের 'জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার' ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
সংবিধানের সার্বভৌমত্বও তাদের কর্মের দ্বারা ক্ষুণ্ন হয়েছে। কারণ সংবিধানের ৩১ ও ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদ নাগরিকের জীবন এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সুরক্ষায় মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়।
পরীমনির এই কাহিনী সংবিধানের মাধ্যমে দেওয়া নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তার কথা না বলে, বরং দেশে আইনের শাসনের একটি অযৌক্তিক গল্পই বলে।
প্রখ্যাত আইনবিদ ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম তার 'কনসটিটিউশনাল ল'জ অব বাংলাদেশ' বইতে যা লিখেছেন তা এখানে লক্ষ্য করা যেতে পারে।
তিনি লিখেছেন "মানুষের অধিকার সংজ্ঞায়িত করতে পারে এমন অনেক আইন হয়তো আছে, কিন্তু যদি সাধারণ মানুষ এই অধিকারগুলোর প্রয়োগের চেষ্টা করতে না পারেন, তবে সেই অধিকারগুলো কেবল কাগজে মুদ্রিত হয়েই থাকবে, বাস্তব জীবনে এর কোনো গুরুত্ব থাকবে না।"
- লেখক: উপ নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা: Pori Moni saga: A worrisome story of rule of law
- অনুবাদ: তারেক হাসান নির্ঝর