‘শূন্য’ কার? এল কোথা থেকে?
অনাদিকাল থেকেই মানুষ কিছু থাকা আর না থাকার পার্থক্য সহজেই বুঝতে পারতো। সে তুলনায় সংখ্যা হিসাবে অসীম বা 'শূন্য'র ব্যবহার কিন্তু প্রায় নতুন আবিষ্কারই বলা চলে। মানুষের বিবর্তন যাত্রা লাখ লাখ বছর পুরনো হলেও অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই এব্যাপারে একমত যে, খ্রিস্টজন্মের পাঁচশ' বছর পর বা হয়তো তার কয়েকশ' বছর আগেই প্রাচীন ভারতে শূন্য আবিষ্কৃত হয়েছিল।
এই আবিষ্কার সভ্যতার যাত্রায় নতুন গতি যোগ করে। তার আগে সাধারণ অঙ্ক কষতেও বেশ বেগ পেতে হতো গণিত বিশারদদের। আধুনিক যুগে 'শূন্য' (0) শুধু গাণিতিক সংখ্যা নয়, অসীমের ধারক হিসাবেও তাত্ত্বিকভাবে সমাদৃত। এটি থাকার কারণেই আমরা উচ্চতর গনিত বা ক্যালকুলাস করতে পারি। জটিল হিসাব সহজে করার সুযোগ করে দিয়েছে এ আবিষ্কার, যা না থাকলে আবিষ্কার করা যেতো না সর্বাধুনিক গণনাযন্ত্র কম্পিউটার।
নেদারল্যান্ডে অবস্থিত জিরোজিইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন আদি ভারতে শূন্যের উদ্ভাবন নিয়ে গবেষণার সঙ্গে জড়িত। তারা জিরো প্রজেক্ট নামে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সচিব পিটার গোবেটস মনে করেন, ''মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে ভারতীয় (০) শূন্য। আধুনিক গণিত আর পদার্থবিদ্যা-সহ বিজ্ঞানের সকল শাখা একে ছাড়া অচল। শূন্যই সকল হিসাবের অতি-প্রয়োজনীয় মূল ভিত্তি। প্রযুক্তির আশীর্বাদও আমরা পেয়েছি শূন্যের কল্যাণে।
প্রাচীন ইতিহাস এবং ত্রিকোণ চিহ্নের সংকেত:
বিশ্বব্যাপী নানা সভ্যতায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে শূন্যের ধারণা স্বতন্ত্রভাবেই তৈরি হয়েছিল বলে মনে করেন ডা. অ্যান্নেট ভ্যান ডার হোয়েক। তিনি 'ভারত বিশেষজ্ঞ' এবং জিরো প্রজেক্ট উদ্যোগের গবেষণা সমন্বয়ক।
পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো সভ্যতা হিসাবে সুমেরিয়দের কথাই জানা যায়। ৪-৫ হাজার বছর আগে এই সভ্যতায় প্রথম আবিষ্কার হয় সংখ্যার ব্যবহার। গণনা বিদ্যা আর সংখ্যার ব্যবহার তাদের কাছ থেকেই পায় ব্যাবেলনিয় সভ্যতা।
অবশ্য সুমেরিয়দের মতো ব্যাবেলনিয় গনিতেও একটি সংখ্যার মূল্য এবং তার অবস্থান নির্ধারিত হতো অন্যান্য সংখ্যার তুলনামূলক উপস্থিতির বিবেচনায়।
প্রাচীন জনপদ দুটিতে শূন্যের বিকাশ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেন রবার্ট কাপলান। তিনি 'দ্য নাথিং দ্যাট ইজ: অ্যা ন্যাচারাল হিস্টোরি অব জিরো' গ্রন্থের লেখক। তার মতে, ''আজকে আমরা যে গোলাকার শূন্যের সঙ্গে পরিচিত, তার পূর্ব-পুরুষ কিন্তু ছিল লম্বা ত্রিকোণাকৃতির চিহ্ন। সুমের এবং ব্যাবিলনে এভাবেই খালি সারিকে নির্দেশ করতে দুটি ত্রিকোণ চিহ্নের পাশাপাশি ব্যবহার প্রচলিত ছিল।''
শূন্য ত্রিকোণের মাধ্যমে বোঝানো হতো- এই মতামত অবশ্য কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ সমর্থন করেন না। এমন একজন হচ্ছেন চার্লস সেইফি। তিনি 'জিরো: দ্য বায়োগ্রাফি অব অ্যা ডেঞ্জারাস আইডিয়া' গ্রন্থের লেখক।
খ্রিস্টজন্মের ৩শ' বছর আগে আক্কাডিয় সাম্রাজ্যের মাধ্যমে সুমের সভ্যতার গণনা ব্যবস্থা ব্যাবিলনের হাতে আসে। কাপলান স্বীকার করেন, ''এসময় স্থান সম্পূরক হিসাবে শূন্যের মতো একটি সংখ্যা চিহ্ন হিসাবে ব্যবহার শুরু হয়েছিল, যার সাহায্যে ১০ বা ১০০'র পার্থক্য নির্ণয় করা বা ২,০২৫ এর মতো হাজারে গনণা বোঝানো যেতো। তবে শতকের ঘরে ছিল সংখ্যার অভাব, তাই ধীরে ধীরে ব্যবস্থাটি জটিল ও দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে। এই সমস্যা সমাধানেই পরবর্তীতে একটি খালি সংখ্যা সারি বোঝাতে তারপর পাশাপাশি দুটি ত্রিকোণ চিহ্নের ব্যবহার শুরু হয়। তবে ব্যাবেলিয়নিয়রা কখনোই শূন্যকে আলাদা একটি সংখ্যা হিসাবে আবিষ্কার করতে পারেনি।''
আটলান্টিকের অপর পাড়ে আরেক আবিষ্কার:
ব্যাবিলন থেকে ১২ হাজার মাইল দূরে তাদের ছয়শ' বছর পর- গণিতে স্থান সম্পূরক হিসেবে শূন্য বোঝানোর মতো চিহ্নের ব্যবহার শুরু হয় মায়া সভ্যতায়। আনুমানিক ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে মায়ারা তাদের বর্ষপুঞ্জি তৈরির কাজে এমন গণনা চিহ্নের আশ্রয় নেয়। তবে দক্ষ গণিতজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও মায়ারা কখনোই শূন্যেকে তাদের প্রচলিত গণিতে ব্যবহার করতে পারেনি। কাপলানের জানান, সাফল্য আর ব্যর্থতা সত্ত্বেও মায়া সভ্যতায় শূন্যের যে ব্যবহার দেখা যায়, তা প্রায় শূন্য থেকেই শূন্য আবিষ্কারের মতো চমকপ্রদ।
'ভারত' শূন্য যেখানে পেলো সংখ্যার স্বীকৃতি:
কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বাণিজ্য বা অভিবাসনের কোনো সূত্রে ব্যাবিলন থেকে শূন্যের ধারণা ভারতে এসেছিল। জিরো প্রজেক্টে জড়িত কিছু বিশেষজ্ঞও এমন অভিমত পোষণ করেন। তবে সংখ্যা হিসাবে আধুনিক শূন্যের ব্যবহার ও আবিষ্কারের কৃতিত্ব তারা প্রাচীন ভারতীয়দেরকেই দিয়েছেন।
''প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির বেশ কিছু ইঙ্গিত অসীমের নির্দেশ দেয়। আমাদের ধারণা সেখান থেকেই তারা শূন্যের মতো একটি সংখ্যা উদ্ভাবনের অনুপ্রেরণা পান। জিরো প্রজেক্টের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অনুসারে, শূন্যের আদি সংস্কৃত উচ্চারণ 'শুনইয়া' অসীমের বিশালয়তার দর্শন 'শুনইয়তা' (শূন্যতা) থেকে এসেছে,'' গোবেটস বলছিলেন।
সাংস্কৃতিক অনুপ্রেরণার অভাবেই অন্য সভ্যতায় ভারতের আগে শূন্যকে সংখ্যা হিসাবে আবিষ্কার করা হয়নি, বলে একমত পোষণ করেন আরেক বিশেষজ্ঞ ভ্যান ডার হোয়েক।
'দ্য ক্রেস্ট অব পিকক: নন-ইউরোপিয়ান রুটস অব ম্যাথম্যাটিক্স' শীর্ষক গ্রন্থে এর লেখক জর্জ ঘিভারঘেস জোসেফ লিখেছেন, ৪৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ভারতে শূন্যের ব্যবহার প্রচলন হয়। সংস্কৃতের অসীম বা খালি অর্থ আসলে উর্বরতা ও প্রবৃদ্ধির দিকেও ইঙ্গিত করে। আবার এটি অভাবকেও বোঝায়। ঋগ-বেদে যার আদি সংজ্ঞা দেখা যায়। আবার শূন্যতার দুই ব্যাখ্যা বৌদ্ধিক দর্শনে কারো মানসিক আকঙ্খা-বাসনামুক্ত 'চিন্তাশূন্য' দশাকেও তুলে ধরছে।
বৌদ্ধ ধর্মও ভারতের মাটিতে জন্ম নেয়। তাই অনেক আধ্যাত্মিক ইঙ্গিত যে সেখানে অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে, তা ছিল খুবই স্বাভাবিক।
ভ্যান ডার হোয়েক জানান, '' আধ্যাত্মিক এমন দর্শন থেকেই সংখ্যা হিসাবে গাণিতিক হিসাব-নিকাশে শূন্যের ব্যবহার শুরু হয়। এজন্যেই আমরা ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে গণিতের সংযোগ সেতুর উৎস নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি।''
গোবেটস বলেন, 'শূন্যের ধারণা এবং সর্বপ্রথম এর ব্যবহার সম্পর্কে লিখেছেন হিন্দু জ্যোতিষী এবং গণিতজ্ঞ ব্রহ্মগুপ্ত। তিনিই শূন্যের জন্য কোনো সংখ্যার নিচে ফোটার মতো একটি চিহ্ন দেওয়া শুরু করেন। অবশ্য ব্রহ্মগুপ্ত নিজেকে কখনোই শূন্যের আবিষ্কারক বলে দাবি করেননি। এ থেকে ধারণা করা হয়, তার সময়ের বেশ আগে থেকেই শূন্য ব্যবহারের চল ছিল।''
মধ্যপ্রাচ্য হয়ে আবার ইউরোপে আসার ইতিকথা:
ইয়েলগ্লোবাল- এর বিশেষজ্ঞ নিলস বার্টিল ওয়ালিনের মতে, বৌদ্ধ ধর্মের কল্যাণে পরবর্তী কয়েক শতকে চীন ও মধ্যপ্রাচ্যে শূন্যের ধারণাটি ছড়িয়ে পরে। ৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে আরবি সংখ্যায় এটি যুক্ত হয়। আর আরবি সংখ্যা প্রণালী ভারতীয় ব্যবস্থা থেকেই অনুপ্রেণিত।
নবম শতকে মোহাম্মদ ইবন-মুসা আল খোওয়ারেজেমি নামক একজন পার্সী গণিতবিদ প্রথম দশের স্থানে একটি গোলাকার বৃত্ত ব্যবহারের প্রস্তাব করেন। আরবিয়রা এই নতুন সংখ্যার নাম দেয় 'সিফর' বা খালি। আল খোয়ারেজেমি শূন্যের আধুনিক লিখিত রূপ শুধু আবিষ্কার করেননি, তিনি ছিলেন বীজগণিতের জনক। তার হাত ধরেই দ্রুত সংখ্যাকে গুণ ও ভাগ করার পদ্ধতি হিসাবে গণিতের এ শাখাটি পথচলা শুরু করে।
ইউরোপে শূন্যের ব্যবহার পৌঁছায় মুরদের স্পেন জয়ের মধ্য দিয়ে। এই ধারণাকে আরও অগ্রসর করেন ইতালিয় গণিতবিদ ফিবোনাচ্চি। তিনি এর সাহায্যে উন্নত একটি পাটিগণিত পদ্ধতি আবিষ্কার করেন যা স্থানীয় বণিক শ্রেণির মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তারা নিজেদের ব্যবসায় দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণে ফিবোনাচ্চির গাণিতিক সূত্র ও শূন্যের ব্যবহার শুরু করেন।
ভ্যান ডার হুক বলেন, মধ্যযুগের ইউরোপীয় ধর্মনেতারা তা মেনে নিতে পারেননি। তারা একে শয়তানের প্রতীক হিসেবে দেখতেন। তাদের দৃষ্টিতে, 'ঈশ্বরই সবকিছু, কিছু নেই মানে কী? এতো সাক্ষাৎ শয়তানের চিহ্ন।'
ওয়ালিন জানান, 'ইতালির সরকার আরবি সংখ্যা ব্যবহার নিয়ে সন্দেহপোষন করতো এবং এর ব্যবহারও নিষিদ্ধ করে। কিন্তু, হিসাব-নিকেশের সুবিধার কারণে গোপনভাবেই এর চর্চা ধরে রাখেন বণিক সম্প্রদায়।
আর এ ব্যবহারের সূত্র ধরেই শূন্যের আরবি উচ্চারণ 'সিফর' থেকে ইউরোপীয় ভাষায় 'সাইফার' বা সাংকেতিক সংখ্যা শব্দটি যুক্ত হয়।
- সূত্র: লাইভ সায়েন্স