অব্যবস্থাপনায় সম্ভাবনা হারাচ্ছে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি
দিনাজপুর জেলার উত্তরাঞ্চলের পার্বতীপুরে দেশের একমাত্র কঠিন শিলা খনি অবস্থিত।
অভ্যন্তরীণ বাজারে ছয় হাজার কোটি টাকার পাথরের চাহিদা থাকায় খনি উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানের বরাবরই আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু, সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি এখন সীমাহীন অব্যবস্থাপনা এবং লোকসানের উদাহরণে পরিণত হয়েছে।
২০০৭ সালে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৫৯৩ কোটি টাকার লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে খনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (এমজিএমসিএল)।
দাপ্তরিক নথিপত্র অনুযায়ী গত দুই বছরে প্রতিষ্ঠানটি যথাক্রমে সাত কোটি এবং ২২ কোটি টাকার মুনাফা অর্জন করে।
কিন্তু, দেশের বাজারে প্রতিষ্ঠানটির বিপুল সম্ভাবনার তুলনায় মুনাফার এই পরিমাণ নিতান্ত তুচ্ছ। এখন পর্যন্ত দেশের গ্রানাইট বাজারের মাত্র ৬ শতাংশ দখলে নিতে পেরেছে এমজিএমসিএল।
দেশের পাথরের বাজারের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। বিশাল এই চাহিদা মূলত আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়ে থাকে।
মধ্যপাড়ার দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক পরিচালনার পেছনে মূল দায় প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকার পেট্রোবাংলার। খনির বিদেশি ঠিকাদার জার্মানিয়া করপোরেশন এবং বেলারুশ ট্রেস্টের যৌথ উদ্যোগে গঠিত জার্মানিয়া-ট্রেস্ট কনসোর্টিয়ামকে (জিটিসি) পরিচালিত করতে ব্যর্থ বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)।
২০১৩ সালে ১৪০০ কোটি টাকার প্রকল্পে ছয় বছরের জন্য জিটিসিকে খনি থেকে ৯২ লাখ টন পাথর উত্তোলনের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু, ২০১৯ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টন পাথর উৎপাদন করতে সক্ষম হয়।
উত্তোলনের কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদির সরবরাহে বিলম্ব হওয়ায় চুক্তির বেশিরভাগ সময় ধরে জিটিসিকে পাথর উত্তোলন না করে বসে থাকতে হয়। একইসঙ্গে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে চুক্তি অনুযায়ী যথাসময়ে অর্থ পরিশোধ না করার অভিযোগ রয়েছে।
উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার ৫২ শতাংশ পূরণে ব্যর্থ জিটিসি
জিটিসির সাথে মূল চুক্তি দুই বছর আগে শেষ হয়ে গেলেও পেট্রোবাংলা এখন পর্যন্ত বিকল্প কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুঁজে পেতে ব্যর্থ। আর তাই পাথর উত্তোলনে জিটিসির চুক্তির মেয়াদ সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।
সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, "খনির উৎপাদন অবস্থা ভালো থাকায় আমরা বিদ্যমান ঠিকাদারকে মেয়াদ বৃদ্ধির সুযোগ দিচ্ছি।"
এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিটিসির কাজের প্রতি নজরদারি অব্যাহত রাখার নির্দেশনা প্রদান করেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, "বর্তমান ঠিকাদারের কাজে দুর্বলতা দেখতে থাকলে আমরা নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করব।"
ঠিকাদারকে দেরীতে হিসাব পরিশোধ করাসহ একাধিক কারণে খনি উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানটি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
লোকসানের পেছনে বড় একটি কারণ হিসেবে খনি উন্নয়নকারী সংস্থা কোরিয়ার সাউথ-সাউথ কোঅপারেশন করপোরেশনকে (নাম-নাম) দায়ী করেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান।
কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান নাম-নাম'কে সাপ্লায়ার ক্রেডিট বা ঋণচুক্তির আওতায় ১৯৯৪ সালে খনি উন্নয়নের কাজ দেওয়া হয়। ২০০১ সালের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ২০০৭ সালে এসে তা সম্পন্ন করে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ফলে, প্রকল্পের খরচ বহুগুণে বৃদ্ধি পায় এবং প্রতিষ্ঠানটি এক হাজার ১৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত খনি থেকে ২০ লাখ টন পাথর উত্তোলন করা হলেও ১৩২ কোটি টাকার লোকসান হয়।
পরবর্তীতে, জিটিসিকে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। চুক্তি চলাকালে প্রতিষ্ঠানটির ছয় বছরে ৯২ লাখ টন পাথর উত্তোলনের কথা থাকলেও ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া অবধি প্রতিষ্ঠানটি লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪১ শতাংশ পূরণে সক্ষম হয়।
কিন্তু ছয় বছরে জিটিসি চুক্তির মোট অর্থায়নের ৫১ শতাংশ অর্থাৎ, ৭১২ কোটি টাকা পায়। এসময় খনি পরিচালনা করা এমজিএমসিএল কে লোকসান গুনতে হয়।
"তবে, গত তিন বছর ধরে, খনিটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখন আমাদের তা ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে," বলে আনিছুর রহমান।
তবে, খনি বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদদের মতে, দক্ষ ঠিকাদার এবং যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার অভাবে কঠিন শিলা খনিটি সম্ভাবনা হারাতে বসেছে।
খনিজ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডক্টর বদরুল ইমাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পাথর উত্তোলন করা সম্ভব হলে খনি থেকে মুনাফা অর্জন অব্যাহত থাকবে।"
"সেজন্য, কর্তৃপক্ষের উচিত যোগ্য ঠিকাদার নিয়োগ প্রদানের পাশাপাশি দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা," বলেন তিনি।
দেশে বার্ষিক পাথরের চাহিদা এক কোটি ৫০ লাখ টন। মোট চাহিদার মধ্যে প্রায় ১০ লাখ টন সরবরাহ করে থাকে মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি।
আর তাই, সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে নির্মাণকাজের অপরিহার্য এই উপাদানের চাহিদা পূরণ করে থাকে।
আবারও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা
বর্তমানে জিটিসি সম্প্রসারিত চুক্তির অধীনে কাজ করে চলেছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু কর্তৃপক্ষ গত দুই বছরে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করতে পারেনি।
সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান বলেন, "গত বছর উত্তোলনকারীদের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করে আমরা দেশ ও বিদেশ উভয় স্থান থেকেই ব্যাপক সাড়া পাই। তবে, মহামারির কারণে দরপত্র মূল্যায়নে বিলম্ব দেখা দেয়।"
তবে, বর্তমান চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নতুন ঠিকাদার নিয়োগ প্রদানের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
প্রাতিষ্ঠানিক সূত্র অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নতুন ঠিকাদার নির্বাচন করা সম্ভব না হলে উৎপাদন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে পড়বে। ফলে, খনি উত্তোলনে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও উল্লেখ করেন তারা।
২০২০ সালের আগস্ট মাসে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ছয় বছরে ৮৮ লাখ ৫০ হাজার টন পাথর উৎপাদনের পাশাপাশি খনিতে ১৫টি ইউনিট বিস্তারের লক্ষ্যে পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ, উন্নয়ন এবং সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য যোগ্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
বর্ধিত সময় অনুযায়ী ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে টেন্ডার বন্ধের সময় নির্ধারিত হয়।