সামান্যই কাজে লাগানো একটি কয়লাখনির ভবিষ্যৎ কি অনিশ্চয়তার পথে?
দেশব্যাপী যখন বিদ্যুতের চাহিদা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে – তারমধ্যেই কয়লা সংকটে দেশের নতুন কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। এর একমাত্র ব্যতিক্রম ৫২৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালিত হয় স্থানীয় কয়লায়; যা আমদানি করতে হলে- প্রতি বছরে লাগতো ১৪৪ মিলিয়ন ডলার।
২০২৭ সাল পর্যন্ত বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি পরিচালনার অনুমোদন রয়েছে। এই মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নিকটবর্তী খনিটি থেকে নির্ভরযোগ্য জোগান পাওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তার আশঙ্কা করছেন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কর্মকর্তারা।
বড়পুকুরিয়া কোল মাইন লিমিটেড (বিসিএমসিএল)- এর শীর্ষ এক কর্মকর্তা দাবি করেন, দেশের একমাত্র সচল এই কয়লা খনিতে আরও মজুত রয়েছে, যা উত্তোলনের জন্য জানুয়ারিতে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন তারা। বর্তমানে তারা সেটি অনুমোদনের অপেক্ষা করছেন।
২০০৫ সাল থেকে এপর্যন্ত কয়লাক্ষেত্রটির প্রাক্কলিত মজুতের মাত্র ৩.৪১ শতাংশ উত্তোলন করা হয়েছে, বলে জানায় খনি পরিচালক সংস্থাটি।
তবে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, স্থানীয় খনিটি থেকে আরও কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে তারা বর্তমানে ভাবছেন না।
বিদ্যুৎ বিভাগের নীতিমালা প্রণয়নকারী শাখা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, বর্তমানে তারা এনিয়ে ভাবছেন না।
"দুঃসহ গরমের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের মতো যেসব কারণে লোডশেডিংয়ের তীব্রতা বেড়েছে, বর্তমানে আমরা সেগুলো সমাধানের দিকে মনোযোগ দিচ্ছি। এই বিষয়ে আমরা পরে ভাববো"- বলেন তিনি।
কয়লার ভবিষ্যৎ সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগ
নিকটবর্তী বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে উত্তোলন করা কয়লার জোগানের ওপর নির্ভর করে – এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনটি ইউনিটের মধ্যে দুটি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে।
কিন্তু, ২০২৭ সালের পর বড়পুকুরিয়া কোল মাইন লিমিটেড (বিসিএমসিএল)- এর কয়লা উত্তোলনের কার্যত কোনো অনুমোদিত পরিকল্পনা না থাকায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ভবিষ্যৎ ঘিরে অনিশ্চিয়তা তৈরি হয়েছে।
এছাড়া, ২০০৫ সাল থেকে উত্তোলন করা খনির মধ্যভাগে, কয়লার মজুত আগামী চার বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এমনকী সরকার যদি এখন আরেকটি কয়লাক্ষেত্র উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলেও সেখান থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু করতে তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় লাগবে বলে জানা গেছে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিসিএমসিএল থেকে প্রাপ্ত নথি অনুসারে।
রংপুর বিভাগের দৈনিক বিদ্যুৎ চাহিদা ৪০৯ মেগাওয়াট, যার ৬৪ শতাংশ সরবরাহ করা বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র – জ্বালানির জন্য একমাত্র বড়পুকুরিয়া খনির ওপরই নির্ভরশীল।
বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিকের মতে, খনিতে উত্তোলন কাজ বন্ধ হলে, এই কেন্দ্রটিও বন্ধ হয়ে যাবে। নাহলে এটি সচল রাখতে সরকারকে কয়লা আমদানি করতে হবে।
তিনি জানান, ২০২৭ সালের পর নিশ্চিত সরবরাহের গ্যারান্টি দিতে পারছেন না খনি কর্তৃপক্ষ। "ভবিষ্যতে কয়লা সরবরাহের এই অনিশ্চয়তার বিষয়ে আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা সংস্থা- বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েছি। কিন্তু, এপর্যন্ত তাদের থেকে আমরা কোনো (সাড়া) পাইনি।"
বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে, প্রায় ২৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রতিদিন প্রায় ৩,০০০-৩,৫০০ টন কয়লা প্রয়োজন হয়। ২০২৭ সালের পর যদি বড়পুকরিয়া খনি থেকে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি সরবরাহ করতে কর্তৃপক্ষকে প্রতিবছর প্রায় ১.২ মিলিয়ন টন কয়লা আমদানি করতে হবে।
বিকল্প উপায়ে কয়লা উত্তোলনের উপায় সন্ধান
এবিষয়ে জানতে চাইলে, খনিটির মালিকানা সংস্থা- বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা)- এর চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, কয়লা উৎপাদন অব্যাহত রাখার বিভিন্ন উপায় নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে পেট্রোবাংলা।
"বর্তমান ওই খনির কাছাকাছি আমাদের আরও দুটি খনি – নবাবগঞ্জে ফুলবাড়ি ও দীঘিপাড়া কয়লাক্ষেত্র রয়েছে। আমাদের পরিকল্পনায় এই দুটিকে 'অপশন' হিসেবে রাখা হয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদন পেলে এর কোনো একটি উন্নয়নের বিষয়ে আমরা উদ্যোগ নিতে পারব। যদিও এসব খনি এখনও অনেকটা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে"- বলছিলেন তিনি।
তবে আরেকটি খনি উন্নয়নের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের মতো বিষয় জড়িত থাকায় সরকার একটু সময় নিচ্ছে। কারণ, খনি এলাকার জমি খুবই উর্বর এবং অনেক মানুষের জীবিকা এর উপর নির্ভরশীল হওয়ায়– এটা বেশ সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত।
জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, 'আমাদের এসব বিষয়ে ভারসাম্য রাখতে হবে। এটা নির্বাচনেরও বছর, ফলে আকস্মিক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।"
কয়লা উৎপাদন নিয়ে অনিশ্চয়তা
২০২১ সালের ডিসেম্বরে, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি কোম্পানি চীনের শোঝু কোল মাইনিং গ্রুপ লিমিটেড এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি) এর একটি কনসোর্টিয়ামের সাথে ভূগর্ভস্থ সড়ক নির্মাণ, কয়লা উত্তোলন, পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ছয় বছর মেয়াদি একটি চুক্তি সই করে।
ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন চুক্তির আওতায়, সিএমসি-এক্সএমসি কনসোর্টিয়াম ২০২৭ সাল পর্যন্ত ৪.৫ মিলিয়ন টন কয়লা উৎপাদন করবে। গত বছর খনিটি থেকে প্রায় ১ মিলিয়ন (১০ লাখ) টন কয়লা উত্তোলন করেছে কনসোর্টিয়ামটি। বর্তমানে দৈনিক উত্তোলন করছে প্রায় ৩,৫০০ টন।
চুক্তির অধীনে, ঠিকাদারটি আগামী চার বছরে অতিরিক্ত আরও ৩.৫ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করবে। কিন্তু, এরপরে কয়লা উত্তোলনের আর কোনো অনুমোদিত পরিকল্পনা নেই।
বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম সরকার বলেন, "আমরা পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে বর্তমান উৎপাদন পরিস্থিতি এবং সম্ভাব্য উৎপাদন প্রক্ষেপণ সম্পর্কে অবহিত করেছি। তবে আমরা এখনও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত পাইনি।"
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তর ও দক্ষিণ অংশ থেকে আরও বেশি কয়লা উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু সেখানে (অবকাঠামো) উন্নয়ন করা হয়নি বলেও উল্লেখ করেন সাইফুল।
"বর্তমানে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে যেটুকু কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে, তা মধ্য এলাকা থেকেই করা হচ্ছে। উত্তর ও দক্ষিণ এলাকা যেখানে কয়লার মজুত অপেক্ষাকৃত অগভীর অংশে রয়েছে, সেখানে এখনও খনন ও উত্তোলনের খনি অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি"- যোগ করেন তিনি।
চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে পাঠানো প্রস্তাবে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড প্রক্ষেপণ করে যে, উন্মুক্ত খননপদ্ধতি অবলম্বন করলে এই দুটি অংশ থেকে বছরে প্রায় ৬ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে। তবে খনি পরিচালক সংস্থাকে এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি।
দেশের প্রথম কয়লা খনি থেকে প্রাপ্তি
১৯৯৪ সালের জুন মাসে 'বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি উন্নয়ন প্রকল্প' এর আওতায় বাংলাদেশের প্রথম কয়লাখনিটি উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ১৯৪ মিলিয়ন ডলার, বা প্রায় ১,৩৬৫.৬৬ কোটি টাকা। তবে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলন শুরু হয় ২০০৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণাপত্র অনুসারে, ভূগর্ভস্থ পদ্ধতির খনি কার্যক্রমে খনিতে মোট কয়লা মজুতের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ অনুত্তোলিত রয়ে যায়। ফলে কিছু ভূগর্ভস্থ পদ্ধতির খনি থেকে তাদের মোট উত্তোলনযোগ্য মজুতের মাত্র ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ উত্তোলন করা যায়। সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের ভূগর্ভস্থ পদ্ধতির খনিগুলোর গড় উত্তোলনের অনুপাত হলো ৬৩ শতাংশ।
অন্যদিকে, উন্মুক্ত পদ্ধতির খনি থেকে সাধারণত ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ উত্তোলনযোগ্য সম্পদ আহরণ করা যায়।
মোট মজুদ প্রায় ৪০০ মিলিয়ন টন হলেও, ২০০৫ সাল থেকে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির মাত্র ১৪ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। অর্থাৎ, মোট মজুতের মাত্র ৩.৪১ শতাংশই উত্তোলন করা হয়েছে।
বর্তমান চুক্তির আওতায় খনির কেন্দ্রীয় অংশ থেকে মোট মজুতের ১০ থেকে ১২ শতাংশ উত্তোলন করা যাবে বলে আশাপ্রকাশ করেন মো. সাইফুল ইসলাম সরকার। এই চুক্তির আওতায়, অতিরিক্ত ৩.৫ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলনের আশাও করা হচ্ছে।
গত ১৮ বছরে চারটি চুক্তির আওতায় চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৬,৮২৭ কোটি টাকা আয় করেছে। এসময়ে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং স্থানীয় ক্রেতাদের কাছে কয়লা বিক্রয় থেকে বাংলাদেশ সরকারের কোষাগারে এসেছে ৩,৫৫২ কোটি টাকা।
একটি অনুপযুক্ত এবং পুরানো খনি পরিকল্পনার কারণেই খনি থেকে উত্তোলনের হার কম বলে ব্যাখ্যা করেন দেশের জ্যেষ্ঠ ভূতত্ত্ববিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম।
বিসিএমসিএল এর বোর্ডে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে থাকা এই বিশেষজ্ঞের মতে, "চীনা ঠিকাদারটি খনির এক স্তর থেকে কয়লা উত্তোলন করে ভূমি ধস এড়াতে অন্য অংশটি রেখে দেয়। কম উৎপাদনের এটা অন্যতম কারণ। চীনের ডিজাইনটি সর্বোত্তমও নয়, যা পরিবর্তন করে উৎপাদন আরও বাড়ানো যেত।"
প্রতিবেদনটি থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের সহায়তায় প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রতিবেদনের সম্পূর্ণ দায়ভার এর লেখক ও প্রকাশকের।