আইসিডিগুলোতে এখনো কমেনি রপ্তানি পণ্যবোঝাই কন্টেইনার জট
জাহাজ সংকটের কারণে বেসরকারি আইসিডিগুলোতে এখনো কাটেনি রপ্তানি পণ্যবোঝাই কন্টেইনার জট। স্বাভাবিক সময়ে ১৯ টি আইসিডিতে ৬ হাজার কন্টেইনার থাকলেও বর্তমানে জাহাজের অপেক্ষায় আছে ১৪,০৪৯ টিইউ'স (টুয়েন্টি ফুট ইকুয়েভিলেন্ট ইউনিট) কন্টেইনার। সাধারণত আইসিডিগুলোতে রপ্তানি কন্টেইনার ধারণক্ষমতা ১০ হাজার টিইউ'স।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, বন্দর কর্তৃপক্ষ, শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশন, বিজিএমইএ সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে দফায় দফায় সভা আয়োজনের পরও কন্টেইনার জট কমছে না।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, জাহাজের শিডিউল থাকা স্বত্ত্বেও বর্তমানে ডিপো থেকে রপ্তানি পণ্যবোঝাই কন্টেইনার সঠিক সময়ে হুক পয়েন্টে (জেটির যে স্থান থেকে কন্টেইনার জাহাজে তোলা হয়) এসে পৌঁছাতে পারছে না। নির্ধারিত সময়ে কন্টেইনার না আসার কারণে বুকিং থাকা স্বত্ত্বেও জাহাজগুলো তাদের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার বহন করতে পারছে না।
গত ১৯ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের টার্মিনাল ম্যানেজারের পক্ষ থেকে আইসিডি মালিকদের সংগঠন বিকডার সভাপতি সম্পাদককে দেওয়া এক চিঠিতে এসব অভিযোগ তোলা হয়।
তবে বিকডা এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলছে, জাহাজের নমিনেশন কিংবা ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের তাগাদা পত্র না পাওয়ায় কন্টেইনারে পণ্য বোঝাইয়ের পরও তারা চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠাতে পারছে না।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ঈদুল আজহার ছুটির সময়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক ট্রেইলার ও জনবল নিয়োজিত রেখে রপ্তানিমুখী কন্টেইনার শিপমেন্টের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোভিড -১৯ পরিস্থিতিতে বন্দরের ভেসেল অপারেশন , ইয়ার্ড অপারেশনসহ যাবতীয় অপারেশনাল কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার জাহাজ জেটি ত্যাগের ছয় ঘন্টা পূর্বে বন্দরে জাহাজের হুক পয়েন্টে পৌছানোর অনুরোধ করা হয় ওই চিঠিতে।
দেশের শতভাগ রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণের আগে কন্টেইনার বোঝাইয়ের উদ্দেশ্যে ১৯ টি বেসরকারি আইসিডিতে নিয়ে আসা হয়। কন্টেইনার বোঝাইয়ের পর জাহাজের শিডিউল অনুযায়ী কন্টেইনারগুলো আইসিডি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিকডার সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান টিবিএসকে বলেন, শিডিউল থাকা স্বত্ত্বেও সঠিক সময়ে রপ্তানি কন্টেইনার হুক পয়েন্টে পৌঁছানো যাচ্ছেনা এমন অভিযোগ সঠিক নয়। বিকডাকে দেওয়া ওই চিঠি গতানুগতিক। মূলত জাহাজ সংকটের কারণে রপ্তানি পণ্য বোঝাইয়ের পরও বন্দরে পাঠানো যাচ্ছে না।
বিকডা সভাপতি বলেন, ১৯ টি বেসরকারি আইসিডিতে কন্টেইনার রাখার জায়গা আছে ৭৭ হাজার টিইউ'স । এর মধ্যে গত ২৩ জুলাই পর্যন্ত রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেইনার জাহাজীকারণে উদ্দেশ্যে অপেক্ষমান ছিলো ১৪ হাজার ৪৯ টিইউ'স। এছাড়া আমদানি পণ্যবাহী কন্টেইনার ৯৫০০ টিইউ'স এবং খালি কন্টেইনার ছিলো ৩০৫০০ টিইউ'স।
রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেইনার আটকে থাকায় আইসিডিগুলোর গেইটে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রপ্তানি পণ্য নিয়ে আসা কাভার্ড ভ্যান, প্রাইম মুভার, লরি দাঁড়িয়ে থাকাতে দেখা গেছে। শনিবার এই প্রতিবেদক মিরসরাই থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসার পথে সীতাকুণ্ডের কুমিরা এলাকায় কেডিএস ডিপো এবং ভাটিয়ারি এলাকার পোর্ট লিংক ডিপো গেইটে শতাধিক পণ্য বোঝাই যান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, "সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখতে হলে বন্দর সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে একযোগে কাজ করতে হয়। বন্দরে জাহাজ থাকলেও শ্রমিক সংকটের কারণে পণ্য জাহাজীকরণ সঠিক সময়ে করা সম্ভব হচ্ছে না। ঈদের ছুটিতে বন্দর, কাস্টম, আইসিডি, শিপিং এজেন্টস সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শতভাগ চালু থাকলেও ব্যবসায়ীরা বন্দর থেকে কন্টেইনার খালাস নিচ্ছেনা। এসব কারণে কন্টেইনার জট সহসা কমার সম্ভাবনা দেখছিনা।"
এদিকে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণ সংকট নিরসনে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে অতিরিক্ত আরও দুটি কন্টেইনারবাহী জাহাজ ভেড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। আগে বন্দর জেটিতে ১০ টি কন্টেইনার জাহাজ ভেড়ানো হলেও এই সংখ্যা বাড়িয়ে ১২টি করা হয়েছে।
এছাড়া ২০ ফুট সাইজের ২ থেকে আড়াই হাজার খালি কন্টেইনার ট্রান্টশিপমেন্ট বন্দরে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
গত ১২ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত আমদানি রপ্তানি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কর্মপরিকল্পনা বিষয়ক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। গত ১২ জুলাই পর্যন্ত আইসিডিগুলোতে ১৫,৫৩৩ টিইউ'স রপ্তানি পণ্যের কন্টেইনার পূর্ণ অবস্থায় ছিলো।
দুটি জাহাজ বাড়ানোর ১১ দিন পর ২৩ জুলাই পর্যন্ত রপ্তানি পণ্যের কন্টেইনার জট কমেছে মাত্রা দেড় হাজার। স্বাভাবিকভাবে কন্টেইনার পণ্য লোড হওয়ার ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে জাহাজীকরণ হলেও বর্তমানে ১০ থেকে ১৫ দিনেও জাহাজীকরণ সম্ভব হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো: ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, "ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে জট কামানোর লক্ষে চট্টগ্রাম কলম্বো রুটে ৬ টি নতুন ফিডার ভ্যাসেল চালুর সিন্ধান্ত নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। ক্রমান্বয়ে সবগুলো অপারেশন শুরু করবে। তাছাড়া বন্দর জেটিতে অতিরিক্ত দুটো কন্টেইনার জাহাজ বার্থিং দেওয়ায় আইসিডিগুলোতে রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার জট ধিরে ধিরে কম আসবে।"
আমদানি পণ্যের কন্টেইনার ডেলিভারি না নেওয়ায় বন্দরের ইয়ার্ডে বাড়ছে জট
এদিকে ঈদের ছুটিতে চট্টগ্রাম আমদানি পণ্যের কন্টেইনার ডেলিভারি না নেওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডেও বাড়ছে কন্টেইনার জট। এমন পরিস্থিতিতে ২৪ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন , কিকেএমইএ এবং বিজিএিমইএকে চিঠি দিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতা ৪৯০১৮ টিইউ'স। বন্দরের ইয়ার্ডে কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে ধারণ ক্ষমতার ১৫ ভাগ খালি রাখার বিধান রয়েছে। ২৩ জুলাই সকাল ৮ টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে কন্টেইনার ছিলো ৪২৩৮৬ টিইউ'স।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো: ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত বন্দরের দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জরুরী উদ্যোগ নিয়ে ঈদুল আযহার ছুটি কালীন সময়ে ২৪*৭ চট্টগ্রাম বন্দর চালু রেখেছে। চট্টগ্রাম বন্দর ২৪*৭ চালু থাকলেও কন্টেইনার/পণ্য খালাসে আপনাদের কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছেনা যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
এই অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কন্টেইনার/পণ্য খালাস না করলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জমে থাকা কন্টেইনারের উপর দন্ড ভাড়া আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে বলে জানানো হয় ওই চিঠিতে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমই'এর ফাস্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, "ঈদের ছুটিতে কারখানা বন্ধ। তাছাড়া বর্তমানে লকডাউনের কারণেও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি পণ্য ডেলিভারি নিতে পারছেনা গার্মেন্টস মালিকরা। সরকার যদি গার্মেন্টস কারখানাগুলো লকডাউনের আওতার বাইরে রাখে তাহলে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি হওয়া তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল ডেলিভারি নেওয়া সহজ হবে।"