ট্রেন বন্ধ: কনটেইনারবাহী পণ্য নিয়ে আটকে ৯ ট্রেন; বন্দরে বাড়বে জট, সরবরাহ বিপর্যয়ের শঙ্কা
বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে চট্টগ্রাম থেকে রেলযোগে পণ্য পরিবহন বন্ধ রয়েছে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানিপণ্যবাহী কনটেইনার, তেল ও খাদ্যপণ্যবাহী ট্রেনগুলো বন্দর এবং চট্টগ্রাম পোর্ট গুডস ইয়ার্ডে (সিজিপিওয়াই) আটকে আছে।
সিজিপিওয়াই সূত্রে জানা গেছে, কর্মবিরতির ফলে অন্তত ৯টি পণ্যবাহী ট্রেন সোমবার (২৭ জানুয়ারি) রাত ৮টার পর থেকে যাত্রা করতে পারেনি। এর মধ্যে ছয়টি কনটেইনারবাহী এবং তিনটি তেল ও গমবাহী ট্রেন রয়েছে।
সোমবার রাত ৮টায় সিজিপিওয়াই থেকে গমবাহী একটি ট্রেন ঢাকা তেজগাঁওয়ের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেলেও পরবর্তী ৩টি ট্রেন শিডিউল অনুযায়ী যাত্রা করতে পারেনি। বাতিল হওয়া ট্রেনগুলোর মধ্যে একটি ছিল ঢাকা আইসিডিমুখী কনটেইনারবাহী, একটি সিলেটগামী তেলবাহী এবং আরেকটি রংপুরগামী গমবাহী ট্রেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেলে পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা অভিমুখী আমদানি পণ্যের জট তৈরি হবে বন্দর ইয়ার্ডে। সময়মতো আমদানি পণ্য না পৌঁছালে বিপাকে পড়বেন আমদানিকারকেরা।
সহসা এ সমস্যার সমাধান না হলে পরে এ জট সারতে কয়েকদিন সময় লেগে যেতে পারে বলেও জানান তারা।
সিজিপিওয়াই-এর প্রধান ইয়ার্ড মাস্টার আবদুল মালেক টিবিএসকে জানান, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্যবোঝাই ছয়টি কনটেইনার ট্রেন সিজিপিওয়াই ও বন্দরে অপেক্ষমাণ। প্রতিটি কনটেইনার ট্রেনে ৩১টি বগিতে ৬২ টিইইউ (কুড়ি-ফুট সমতুল্য একক) পণ্য পরিবহন হয়।
'এ ৬টি কনটেইনার ট্রেনের মোট ৩৭২ টিইইউ পণ্য ঢাকা কমলাপুর আইসিডিতে পাঠানোর অপেক্ষায় আছে। পাশাপাশি রংপুর, সিলেট এবং শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে তেলবাহী আরও ৩টি ট্রেন বন্দরে বোঝাই অবস্থায় রয়েছে,' বলেন তিনি।
চিটাগাং গুডস পোর্ট ইয়ার্ডের তথ্য অনুযায়ী, স্বাভাবিক সময়ে সিজিপিওয়াই থেকে প্রতিদিন ৪টি কনটেইনার ট্রেন ঢাকা আইসিডিতে এবং অন্তত ৩টি তেল ও গমবাহী ট্রেন দেশের বিভিন্ন স্থানে চলাচল করে। কর্মবিরতির কারণে বর্তমানে দিনে সাতটি ট্রেনের চলাচল বন্ধ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেলপথে যেসব পণ্য পরিবহন করা হয়, সেগুলো সড়ক পথে পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। খাদ্যপণ্য বিশেষ করে গম, তেল এবং আমদানিকৃত শিল্পের কাঁচামাল পরিবহন ব্যাহত হওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে সারাদেশে বর্তমানে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। গতকাল সোমবার রাত থেকেই রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে মারাত্মক দুর্ভোগে পড়েছেন রেলপথে চলাচলকারী সাধারণ যাত্রীরা।
আইসিডিমুখী কনটেইনার জট আরও বাড়ছে
চট্টগ্রাম বন্দর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আমদানিকারকদের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকা আইসিডিমুখী কনটেইনারের চাপ বেড়েছে। গত ১৯ জানুয়ারির পর জাহাজ থেকে নামানো কনটেইনারগুলো এখনও ট্রেনের শিডিউল পায়নি।
২৮ জানুয়ারি বন্দরে আইসিডিমুখী ১৩৪ টিইইউ কনটেইনার নামানো হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে রেলযোগে পরিবহনের স্লট সক্ষমতা ৮৫০ টিইইউ।
তবে রমজান সামনে রেখে আমদানি বাড়ায় বর্তমানে বন্দরে এক হাজার ৪৯ টিইইউ কনটেইনার রয়েছে। রেলপথে পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন টিবিএসকে বলেন, রেলপথে আইসিডিমুখী পণ্যের এখনো আট দিনের জট রয়েছে। রেল শ্রমিকদের কর্মবিরতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
তিনি বলেন, 'দিনের পর দিন বন্দরে কনটেইনার পড়ে থাকলে স্টোর রেন্ট বাড়বে। পণ্য সময়মতো না পেলে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে।'
তার মতে, রেলের ইঞ্জিন সংকটসহ নানা সমস্যায় এমনিতেই পণ্য পরিবহন পরিস্থিতি নাজুক। এর মধ্যে শ্রমিকদের কর্মবিরতি সংকট আরও প্রকট করবে।
ট্রেন চলাচল বন্ধ
রেলওয়ের রানিং স্টাফরা মাইলেজের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক প্রদান এবং নিয়োগপত্রের দুটি শর্ত প্রত্যাহারের জন্য কর্তৃপক্ষকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। অন্যথায় ২৮ জানুয়ারি থেকে তারা ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন।
রেলওয়ের রানিং স্টাফ বলতে ট্রেনের চালক, সহকারী চালক, গার্ড ও টিকিট পরিদর্শকদের (টিটিই) বোঝানো হয়। আট ঘণ্টার কর্মদিবস থাকলেও তাদের গড়ে ১৫–১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। এ কারণে তাদের বেতনের সঙ্গে বিশেষ আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়, যা রেলওয়ের পরিভাষায় 'মাইলেজ' নামে পরিচিত। প্রতি ১০০ কিলোমিটার ট্রেন চালালে রানিং স্টাফরা মূল বেতনের এক বেসিক সমপরিমাণ অর্থ বেশি পান।
আট ঘণ্টাকে এক দিনের কর্মদিবস ধরা হলে তাদের মাসিক কাজ দু–তিন মাসের সমপরিমাণ হয়ে দাঁড়ায়। সে অনুযায়ী তাদের বেতনও প্রদান করা হয়। অবসরকালীন ভাতা হিসেবেও তাদের মূল বেতনের হিসেবে যে ভাতা হয়, তার সঙ্গে অতিরিক্ত ৭৫ শতাংশ অর্থ দেওয়া হয়।
তবে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অর্থ মন্ত্রণালয় এ মাইলেজ সুবিধা বাতিল করে। এরপর থেকেই বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদ ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করে আসছে।