আমানতের সুদহার এখন মুদ্রাস্ফীতির নিচে হবে না
মুদ্রাস্ফীতির হারের বিপরীতে আমানতের সুদের হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ায় ও আমানতকারীদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায়, আমানতের সুদহার নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এখন থেকে মেয়াদি আমানতের সুদের হার মুদ্রাস্ফীতির হারের চেয়ে কম হবে না।
তিন মাস বা তার অধিক সময় জমা থাকা আমানতের ওপর মাসিক সুদের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে, পূর্বের তিন মাসের গড় মুদ্রাস্ফীতি গণনার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী যা অবিলম্বে কার্যকর করা হবে।
প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, তাদের পর্যবেক্ষণ, অধিকাংশ ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতির হারের চেয়ে আমানতের জন্য কম সুদের হার দিচ্ছে। ফলস্বরূপ, সঞ্চয়ীরা প্রভাবিত হচ্ছে এবং তাদের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।
এই অবস্থায় আমানতকারীরা তাদের অর্থ ব্যাংকে রাখার বদলে অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করছে। এই ধরনের প্রবণতা ভবিষ্যতে ব্যাংকগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, সেই সঙ্গে আমানত এবং সম্পদের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করবে বলে জানানো হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।
বর্তমানে, বেশিরভাগ ব্যাংক আমানতের ওপর ২ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ হারে সুদ দিয়ে থাকে, যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে সর্বনিম্ন এবং যা ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ (জুন পর্যন্ত) মুদ্রাস্ফীতির হারের চেয়ে অনেক কম।
আমানতের এমন নিম্ন হারের ফলেই দেখা দিয়েছে অধিক তারল্য এবং লেন্ডিং রেট ক্যাপ।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে অর্থ ধার দেয়ার ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ সুদের হার নির্ধারণ করে। ফলস্বরূপ, ব্যাংকগুলো তাদের তহবিলের ব্যয় সামঞ্জস্য রাখতে আমানতের হার ব্যাপকভাবে হ্রাস করে।
এদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মহামারী চলাকালীন আর্থিক নীতি শিথিল করার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে তারল্য বাজারে ছেড়েছে, যার লক্ষ্য ছিল অর্থ মূল্যমান কমানো।
অতিরিক্ত তারল্য, যা জুন মাসে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ স্তর ২.৩ লক্ষ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছিল, তা এখন ব্যাংকের জন্য এক বিরাট সমস্যায় পরিণত হয়েছে। মূল্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করার সঙ্গে সঙ্গে আমানতের হারও নিচে নামিয়ে এনেছে।
একই সময়ে, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত তারল্যের মাঝেও ঋণ সুদের হার ৬ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোমবার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিল জারির মাধ্যমে বাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য উঠিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ বলেন, আমানতের সুদের হারের মাত্রা এমন সময়ে এসে ঠেকছে, যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত তারল্যের লাগাম টানতে চলেছে। ফলস্বরূপ, বাজারে একটি কৃত্রিম সংকট তৈরি হতে পারে, যা আমানতের হার বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
নিম্ন সুদের হার ঋণ গ্রহীতাদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ হলেও মধ্যবিত্ত আমানতকারীদের জন্য তা অভিশাপ, যারা সুদের উপার্জনের উপরই জীবননির্বাহ করেন। ব্যাংকে টাকা রাখা এখন তাদের জন্য ক্ষতি।
যদি কেউ ব্যাংকে ৪ শতাংশ সুদের হারে ২৫ হাজার এক টাকা রাখেন, তাহলে বার্ষিক সুদ আসবে এক হাজার টাকা।
কিন্তু, আমানতকারীদের হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ফি ৪০০ টাকা (বছরে দুইবারের প্রতিবার ২০০ টাকা) এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাটের ওপর ৬০ টাকা এবং ১৫ শতাংশ কর (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর না থাকলে) ১২০ টাকা দিতে হবে। তার সঙ্গে ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হলে, ২৫ হাজার এক টাকা আমানতে ব্যয় হবে এক হাজার ৪০৭ টাকা।
মোট খরচ দুই হাজার ১৭ টাকা কেটে নেওয়ার পর, আমানতকারী তার আমানত থেকে এক হাজার ১৭ টাকা ক্ষতি দেখতে পাবে – অর্থাৎ বছরের শেষে মোট আমানতের পরিমাণ কমে যাবে ২৩ হাজার ৯৮৩ টাকায়।
মধ্যবিত্তের এই দ্বিধা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে এসেছে। তাই চলতি বছরের এপ্রিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রক মহামারী বিবেচনায় এই বছরের হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ ফি অর্ধেক করে দিয়েছে।
যেসব আমানতকারীরা ২০২১ সালে তাদের সঞ্চয়ী হিসাবে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা রাখবেন তারা এই সুবিধা পাবেন। তবে চলতি হিসাবের ক্ষেত্রে এই সুবিধা প্রযোজ্য হবে না।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো এই বছরের জন্য হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ ফি দুইবারের পরিবর্তে একবার কাটবে।
হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ ফি হ্রাস সঞ্চয়কারীদের খানিকটা স্বস্তি দেবে। কারণ হল হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ ফি কমানোর পর, একজন সঞ্চয়কারী এখন বছরের শেষে ২৫ হাজার এক টাকা জমা দেওয়ার বিপরীতে ৮১৭ টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন, যা পূর্বের তুলনায় কম।
অর্থ হারানো সত্ত্বেও, জুন মাসে আমানতের প্রবৃদ্ধি এখনও ১৪ শতাংশের ওপরে; কারণ সংকটের সময় মানুষ ব্যয় করতে রক্ষণশীল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে ব্যাংকিং খাতে মোট আমানত ছিল ১৪.২৭ লাখ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মেয়াদী আমানতের সুদের হারের ওপর ভিত্তি করে মুদ্রাস্ফীতি ব্যবহারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। ফলস্বরূপ, ব্যাংকগুলোয় আর স্থায়ী আমানত থাকবে না।"
ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদের হারে আমানত পাবে না, কারণ কল মানি মার্কেটে এরচেয়ে কম সুদের হারে টাকা পাওয়া যাবে। এছাড়া অর্থনীতিতে ঋণের চাহিদা কম বলেও তিনি জানান।
মুদ্রাস্ফীতির হারের চেয়ে কম নয় এমন হারে আমানত নেওয়ার পর ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ সুদের হারে ঋণ দিতে পারবে না। সুতরাং, এই সিদ্ধান্ত কেবল ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা বাড়াবে। ড. আহসান মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত এ ধরনের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট স্টকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা।
তিনি আরও বলেন, আমানতের সুদের হার তখনই বাড়বে যখন বাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য সংগ্রহের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হবে। এছাড়া মূল্যস্ফীতিও তখন নিয়ন্ত্রণে আসবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের রিসার্চ ডিরেক্টর ড খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, "যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক পূর্বে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ এবং আমানতের উপর ৬ শতাংশ হার নির্ধারণ করেছিল তখন সিপিডি তা সমর্থন করেনি। এর কারণ হল, সুদের হারের এই সীমা ব্যাংকগুলো মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ বিতরণ কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করবে।"
তিনি আরও বলেন, "কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন আমানতের উপর সুদের হার নির্ধারণের জন্য মুদ্রাস্ফীতিকে ব্যবহার করছে, কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।"