ইজ অব ডুয়িং বিজনেস: সময় এবং খরচ কোনটাই কমছে না
জারিফা এন্টারপ্রাইজ দক্ষিন আফ্রিকা থেকে ২ কন্টেইনার আপেল আমদানি করে। গত ১২ মে কন্টেইনারবাহী জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে পৌছায়। কিন্তু গত ৫ দিনেও বহির্নোঙ্গর থেকে জেটিতে ভেড়ার 'সিরিয়াল' পায়নি জাহাজটি। জাহাজটি জেটিতে ভেড়ার পর পণ্য খালাসে আরো ৩ দিন সময় লাগবে। এরপর কাস্টমস থেকে ক্লিয়ারেন্স পেতে কমপক্ষে ৩ থেকে ১০ দিন সময় লাগবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সীমানায় আমদানি পণ্য নিয়ে কোন জাহাজ প্রবেশ করলে পণ্য হাতে পেতে বর্তমানে কমপক্ষে ১১ থেকে ২০ দিন সময় লাগছে।
প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী জোনায়েদুল হক বলেন, ঈদের আগে কন্টেইনার দুটি খালাস নিতে পারলে ভালো মুনাফা হতো। সময়মতো খালাস না হওয়ায় এখন ১০ লাখ টাকার লোকসানের আশঙ্কা করছি।
সময় ও খরচ কমাতে 'ইজ অব ডুয়িং বিজনেস' বা ব্যবসা সহজীকরণ সূচকের টার্গেট অনুযায়ী রপ্তানি পণ্য বন্দর গেইট থেকে ৩৬ ঘন্টার মধ্যে জাহাজীকরণ করতে হবে। এবং পণ্য জাহাজীকরণের খরচ ২০০ ডলারের মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, ইজ অব ডুয়িং বিজনেস এর ট্রেডিং এক্সেস বর্ডারের সূচকে চট্টগ্রাম বন্দরে রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণ ৩৬ ঘন্টার স্থলে ২২ ঘন্টায় আনা হয়েছে। এমনকি খরচও ২০০ ডলারের নিচে নিয়ে আসা হয়েছে।
রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রপ্তানি পণ্য অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) থেকে জাহাজীকরণ সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে কন্টেইনার ডেলিভারি নিতে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে বেসরকারী আইসিডিতে বেশি সময় ক্ষেপণ হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ। চলতি বছরের ২০ এপ্রিল বিজিএমইএ'র সভাপতি ফারুক হাসান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য ( শুল্ক ও কাস্টম নীতি) বরাবর একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে তৈরী পোষাক শিল্পের কন্টেইার ডেলিভারি নিতে সময় লাগে ২ দিন। কিন্তু আইসিডি থেকে ডেলিভারি নিতে গেলে ৭ দিন।
বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) মহাসচিব রুহুল আমিন শিকদার বলেন, আইসিডিতে আসার পর পণ্য জাহাজীকরনের সময় লাগে গড়ে ২ দশমিক ৭ দিন বা প্রায় ৬৫ ঘন্টা। পণ্য ভর্তি ২০ ফুট সাইজের একটি কন্টেইনার আইসিডি থেকে জাহাজীকরণ পর্যন্ত আইসিডি এবং বন্দরের চার্জ ১৪২.২৯ ডলার। ৪০ ফুট সাইজের কন্টেইনারের চার্জ ২১৭.৭৩ ডলার।
ইজ অব ডুয়িং বিজনেসের সূচক অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময় এবং বাজেটের মধ্যে পণ্য জাহাজীকরণে চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যানের বক্তব্য মানতে নারাজ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানিতে নানামুখী জটিলতায় আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বাড়ছে ব্যবসায়ের সময় এবং খরচ। বার্থিং পেতে বিলম্ব, শুল্কায়নে জটিলতা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্য পরীক্ষা প্রতিবেদন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য খালাস কিংবা গন্তব্যে পাঠাতে পারছেনা ব্যবসায়ীরা। এর ফলে বাজারে পণ্যের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে।
পোষাক শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্লিপটন গ্রুপ এবং বিজিএমইএ'র পরিচালক এমডিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আমদানি এবং রপ্তানি বাণিজ্যে সময় এবং ব্যয় দুটোই বাড়ছে। বন্দরে আমদানি পণ্য আসার পর বিভিন্ন পরীক্ষার নামে হয়রানি হতে হয়। পণ্য ঠিক থাকার পরও কাস্টমস ল্যাবে নেগেটিভ প্রতিবেদন দিয়ে হয়রানি করা হয়। পরবর্তীতে বুয়েটের ল্যাবে পরীক্ষায় পণ্য সঠিক পাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অসৎ কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সময় এবং খরচ দুটোই কমে আসবে।
বন্দরে পণ্য আসার পর কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পেতে বিলম্ব হয়। আনকাট এর তথ্য অনুযায়ী বন্দরে টার্ন এরাউন্ড টাইম ( জেটি থেকে পণ্য খালাস সময়) ৩ দিন। বন্দরের তথ্য অনুযায়ী বহির্নোঙ্গর থেকে জেটিতে আসতে একটি জাহাজকে গড়ে আড়াই দিন অপেক্ষা করতে হয়। সেই হিসেবে বহির্নোঙ্গরে জাহাজ আসার পর জেটিতে খালাস হতে সময় লাগেছ সাড়ে ৫ দিন। এরপর পণ্য খালাসে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পেতে নানামুখী জটিলতায় পড়তে হয় আমদানিকারকদের।
তবে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর থেকে জেটিতে শিডিউল পেতে স্ক্রাপ পণ্যবাহী জাহাজকে ২৬ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতিতে স্ক্র্যাপ পণ্যবাহী জাহাজের জন্য আলাদা জেটি বরাদ্দ দেওয়ার জন্য বন্দর চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দিয়েছিলো বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচার এসোসিয়েশন।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, এখনো ২০১১ সালের জনবল কাঠামোয় চলছে কাস্টম হাউস। অর্গানোগ্রামের তুলনায় মাত্র ৪২ শতাংশ জনবল নিয়োজিত রয়েছে। কাস্টম ল্যাবের সক্ষমতাও প্রয়োজনের তুলনায় কম। শুল্ক বিভাগের বিশেষায়িত সফটওয়্যার এ্যসাইকুড়া ওয়ার্ল্ডের গতিও ধীর। এসব কারণে শুল্কায়ন বিলম্বিত হয়। এছাড়া আমদানিকারক এবং সংশ্লিষ্ট সিএন্ডএফ এজেন্টের প্রক্রিয়াগত ত্রুটির কারণেও শুল্কায়নে সময়ক্ষেপণ হয়।
শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, একটি জাহাজ অলস বসে থাকলে ১ দিনে জাহাজের আকার ভেদে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার ডলার শিপিং ডেমারেজ বা জাহাজের ভাড়া গুনতে হয়। বার্থিং ডিলের কারণে আমদানিকারকদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এর ফলে পণ্যের দামে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের বার্থিং পেতে বিলম্বের কারণে বাংলাদেশের আমদানিকারকদের প্রতিবছর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা শিপিং ডেমারেজ দিতে হয়। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে একটি বেসরকারী কোম্পানির নির্মিত জেটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে টিবিএসকে এই তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম) এর হেড অব সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট সঞ্জয় কুমার ঘোষ।
চট্টগ্রাম সিএন্ডএফ এজেন্টস এসোসিয়েশনের ফাস্ট জয়েন্ট জেনারেল সেক্রেটারি কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, কাস্টমস এর কিছু পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে শুল্কায়ন বিলম্বিত হয়। যেখানে ১০ ভাগ পণ্যের বেশি কায়িক পরীক্ষার নিয়ম নেই সেখানে ২০ ভাগ পণ্য পরীক্ষা করা হয়। কাস্টম ল্যাবে রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন পেতে সময় লাগে ৭ থেকে ১৫ দিন। ১ দিনে শুল্কায়ন হওয়ার কথা থাকলেও লাগছে ৩ দিনের বেশি। অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন পেতেও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। এর ফলে বন্দরে কন্টেইনার আটকে থাকার কারণে পোর্ট ডেমারেজ দিতে হয় আমদানিকারকদের।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ইজ অব ডুয়িং বিজনেস কমাতে হলে কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যবসার শুরুতে ব্যবসায়ীদের, টিআইএন সার্টিফিকেট, ট্রেড লাইসেন্স সহ প্রক্রিয়াগত সকল বিষয় সহজীকরণ করতে হবে। বন্দরের পণ্য খালাস, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স দ্রুত করতে হবে। আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে।