কর ছাড় ও প্রণোদনায় শত কোটি ডলারে কৃষিপণ্য রপ্তানি
উচ্চ মানের পণ্য উৎপাদন ও সরকারের নীতি সমর্থনের কল্যাণে কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি একশ কোটি ডলার মূল্যের রপ্তানিখাতে পরিণত হয়েছে। মহামারি চলাকালেই প্রথমবারের মতো হয়েছে এ অর্জন।
সরকার প্রধানত কৃষি পণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানির জন্য কর রেয়াত এবং ২০ শতাংশ আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করছে।
ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং সরবরাহ চক্রে নানা রকম ব্যাঘাত আসা সত্ত্বেও প্রায় ১৪৪টি দেশের বৈশ্বিক ভোক্তাশ্রেণির দ্বারপ্রান্তে পণ্য নিয়ে পৌঁছে যান বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা। বাজার সংশ্লিষ্ট শীর্ষ ব্যবসায়ীরা একথা জানান।
তারা আরও উল্লেখ করেন, লকডাউনের সময় অধিকাংশ মানুষকে ঘরে অবস্থান করতে হলেও এসময় বিশ্বব্যাপী প্রক্রিয়াজাত খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে, যা এধরনের খাদ্য রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুসারে, কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে 'ড্রাই ফুড' বা শুকনো খাদ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এসব ড্রাই ফুডের মধ্যে আছে- বিস্কুট, চানাচুর, কেক, পটেতো ক্র্যাকার্স ও বাদামের মতো নানান রকম পণ্য।
বাংলাদেশের কৃষি পণ্য রপ্তানির প্রধান গন্তব্যগুলো হলো- ইউরোপিয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য এবং উপসাগরীয় অঞ্চল। তবে এসব দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশি ও অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় প্রবাসীরাই হচ্ছেন মূল ভোক্তা।
২০২০-২১ অর্থবছরে এসব ড্রাই ফুড রপ্তানি করে ২৮ কোটি ডলারের বেশি বা ২৮৩.৩৮ মিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ। অথচ মাত্র এক দশক আগেও যার পরিমাণ ছিল মাত্র ২৯.৩৭ মিলিয়ন ডলার।
খাত সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা জানান, প্রযুক্তির আধুনিকায়ন এবং মানসম্মত পণ্য উৎপাদন নিশ্চিত করার ফলে বাংলাদেশ এ অগ্রগতি করেছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সরকার শুরু থেকেই কৃষি ভিত্তিক শিল্প স্থাপনে কর রেয়াতের সুযোগ দিচ্ছে। রপ্তানি পণ্য বৈচিত্র্যকরণ ও নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে প্রতিবছরই এ শিল্পকে দেওয়া সুবিধা আরও বিস্তৃত করে এর আওতাধীন খাতের কলেবর বাড়ানো হচ্ছে।
এজন্য ২০০৫ ও ২০১০ সালের শিল্প নীতির আলোকে সরকার কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে কর ছাড়ের সুবিধা অব্যাহত রেখেছে, বলেও জানান তিনি।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ২০১১-১২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটেও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাদ্য ও সবজি প্রক্রিয়াজাত শিল্পকে দেওয়া কর রেয়াতের পরিধি বাড়ানো হয়। নতুন বিনিয়োগ আনতে চলতি বছরের বাজেটে এ সুবিধার ব্যাপ্তি আরও বেড়েছে।
রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পে সম্ভাব্য প্রতিকূল পরিস্থিতি অনুমান করে ২০০৫ সালের শিল্প নীতিতে কৃষি ভিত্তিক ও কৃষিজ পণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বিস্তার ও উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
শিল্পনীতিতে বলা হয়, "দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কৃষি ভিত্তিক শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সম্ভাবনাকে আমলে নিয়ে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ জোন (ইপিজেড) এ অবস্থিত কৃষি ভিত্তিক শিল্পগুলোকে সরকার অর্থ সহায়তার মতো প্রণোদনা দিতে পারে।"
সেখানে আরও বলা হয়, "দারিদ্র দূরীকরণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে কৃষি ভিত্তিক শিল্প স্থাপন ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে আরও জোর প্রচেষ্টা দরকার। এ ধরনের পদক্ষেপ কৃষি পণ্যের সুরক্ষা ও ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। কৃষি খাতের বাইরে আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে সারা দেশে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।"
বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর পর থেকে গত ১০ বছরে দেশের কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আয়কর ছাড় পাচ্ছে; ২০০২ সালের ১ জুন থেকে ২০০৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত স্থাপন করা কারখানাও এ সুবিধা পাচ্ছে।
এছাড়া, কর রেয়াতের বিকল্প হিসেবে ২০০২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০০৫ সালের ৩০ জুন মেয়াদে স্থাপিত শিল্প কারখানাও ২০ শতাংশ কম করদানের সুবিধা পাচ্ছে।
বাংলাদেশ অটো-বিস্কিটস অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শফিকুর রহমান ভূঁইয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দীর্ঘদিন ধরেই আমরা কাজ করেছি দক্ষতা উন্নয়নে। এর ফলে আমরা এখন মানসম্মত পণ্য নিশ্চিত করতে পারছি। মানসম্পন্ন পণ্যের ওপর মানুষের আস্থাও বাড়ছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশি ও বিদেশি বাজার প্রসারিত হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করছে সরকার। এই নীতিমালার বাস্তবায়ন হলে এ খাতে প্রচুর বিনিয়োগ আসবে। শিল্পটিও দ্রুত এগিয়ে যাবে। যদিও আমরা ইতোমধ্যেই একটা টেকসইভাব অর্জন করতে পেরেছি, প্যাকেজিং ডেভেলপড করতে পেরেছি।"
এছাড়া, চলতি বছরের বাজেটে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে ১০ বছরের জন্য ক্যাশ হলিডে ঘোষণা করা হয়েছে। যা শিল্পে নতুন নতুন বিনিয়োগ আনতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে ২০২০-২১ বছরে মশলার রপ্তানি বেড়ে ৪৩.২৯ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা ১০ বছর আগে ছিল মাত্র ৯০ লাখ ডলার। বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশি মসলার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ উঠলেও সেটা সামাল দিয়ে মানসম্মত মসলা বিশ্ববাজারে বিক্রি করছে উদ্যোক্তারা। ফলে বাজারটি ধীরে ধীরে বাড়ছে।
এছাড়া চা, জুস, জ্যাম, জেলি, ফলমূলসহ বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানিও বেড়েছে। বাংলাদেশ এগ্রো- প্রসেসর্স অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) সূত্র বলছে, এ বছর শুধু প্রসেস ফুডের এক্সপোর্ট হয়েছে ৫১কোটি ৪০ লাখ ডলার। যা আগের বছর ছিল ৪০ কোটি ডলার।
এনিয়ে বাপা'র ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ শোয়েব হাসান টিবিএসকে বলেন, "এগ্রো প্রসেসিং সেক্টরের অনেক উন্নয়ন হলেও গত ৫-৭ বছরে এসএমই থেকে খুব কম উদ্যোক্তাই উঠে এসেছে। এদেরকে তুলে আনার জন্য সরকারকে কাজ করতে হবে। কারণ এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা সহজে ঋণ সুবিধা পায় না। এজন্য এ খাতে যারা বিনিয়োগে আসবে তাদেরকে প্রণোদনা দিতে হবে। নির্দিষ্ট একটা পলিসি থাকতে হবে। তাহলে এই সেক্টরের উন্নয়ন আরো দ্রুত হবে।"
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী আমরা বিভিন্ন বাজারে প্রবেশ করেছি। এখন এই বাজারগুলোতে পণ্য রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে হবে। পুরনো পণ্যের সুবিধা নিয়ে নতুন নতুন পণ্য মার্কেটিং করতে হবে। এছাড়া বড় উদ্যোক্তারা কি ধরনের পণ্য তৈরি করবে এবং ছোটরা কি ধরনের পণ্য তৈরি করবে- তাঁর একটি নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
বাপা সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বের ১৪৪টি দেশে বাংলাদেশের প্রসেস ফুড রপ্তানি হচ্ছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, সবচেয়ে ভালো রপ্তানি হচ্ছে ভারতে। দেশটিতে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশি পণ্যের। করোনার কারণে সরবরাহ চক্রে কিছুটা সমস্যা হলেও রপ্তানি বেড়েছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও পণ্য রপ্তানি প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে শুধুমাত্র প্রাণ গ্রুপই ৩৪ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করে, যা এখাতের এক বিলিয়ন ডলার আয়ের এক-তৃতীয়াংশ। বিষয়টি উল্লেখ করে প্রাণ গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও আহসান খান চৌধুরী বলেন, কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যে আমরা একশ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছি, যা খুবই আনন্দের সংবাদ। তবে এই পথচলা খুব একটা মসৃণ ছিল না।
"যেসব খাত ভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা আমরা পাচ্ছি তাতে আগামীদিনে ধীরে ধীরে পণ্যের সরবরাহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের বাজারে করা সম্ভব হবে। এজন্য রপ্তানিতে নানান রকম প্রণোদনা দিয়ে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণে সরকারওঁ অবদান রাখছে," যোগ করেন তিনি।
প্রাণ গ্রুপ বিপুল পরিমাণ কনফেকশনারি পণ্য রপ্তানি করছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা টমেটো কেচাপের মতো পণ্য রপ্তানি করব। ইতোমধ্যেই সোমালিয়ায় দুই লাখ ডলার মূল্যের পণ্য পাঠানো হয়েছে, যা আমরা ২০ লাখ ডলারে উন্নীত করতে চাই।
কিছুটা হোঁচট খেয়েছে সবজির রপ্তানি:
এদিকে ফলের রপ্তানি বড়লেও কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে সবজির রপ্তানি। ১৬৪ মিলিয়ন থেকে কমে ১১৮ মিলিয়নে নেমেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার মধ্যে বিশ্বব্যাপি সরবরাহ চক্রে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছিল। যে কারণে সবজির রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে এখন আবার এ সমস্যা কেটে যাওয়ায় প্রচুর রপ্তানি হচ্ছে। তবে এ বছর প্রচুর রপ্তানি হচ্ছে ফলমূল। যে তালিকার প্রথমেই রয়েছে আম, যা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালায়েড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা কৃষিবিদ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, করোনার একটা সময় পর্যন্ত সরবরাহ চক্রের সমস্যায় রপ্তানি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। চাহিদাও কমে গিয়েছিল। যে কারণে রপ্তানি কিছুটা কমেছে। তবে এখন আবার চাহিদা বেড়েছে এবং সমস্যাও নেই। যে কারণে রপ্তানিও বাড়ছে।
বাপা সূত্রানুসারে, কৃষিখাত দেশের জিডিপি'তে ১৩.৬ শতাংশ অবদান রাখে, আর মোট কর্মীর ৪০.৬২ শতাংশের কর্মসংস্থান হয়েছে এখানে। এই খাতের একটি বড় উপখাত হচ্ছে কৃষি- প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, যা বর্তমানে দেশের উৎপাদন খাতে ৮ শতাংশ অবদান যোগ করেছে।
বাপা প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, কৃষি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প জিডিপিতে ১.৭ শতাংশ অবদান রাখছে।