কালো টাকা সাদা করার অব্যাহত সুযোগ দেয়া ঠিক নয়: ফরাসউদ্দিন
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সরকার যেভাবে বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে এটা অব্যাহত থাকলে আগামীতে সৎ করদাতারা চরমভাবে নিরুৎসাহিত হবে। এই সুযোগ বন্ধ করা উচিত।
সাবেক এই গর্ভনর বলেন, যারা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি তাদের কাছ থেকেও টাকা আদায় করতে হবে। ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়ার পর যারা তিনবার ঋণ পুন:তফসিলের (রিসিডিউল) সুযোগ পেয়েও আবার খেলাপি হয়েছে তাদেরকেই ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।
ফরাসউদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি পাল্টাবে না।
সরকারের একার পক্ষে সংস্কার সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ জন্য দরকার শক্তিশালী বিরোধী দল। নির্বাচনকে নষ্ট করে বিরোধীদলকে বাইরে রাজনীতির বাইরে রাখা ঠিক নয়।
কোডিভ মোকাবেলায় প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর উপকারভোগী শুধুই বিত্তবানরা। কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য নির্ধারিত প্যাকেজ বাস্তবায়ন যাদের দায়িত্ব তারা প্রায় সম্পূর্ণ উদাসীন।
তার পরামর্শ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরশন (বিসিক), এসএমই ফাউন্ডেশন কিংবা পিকেএসএফ এর মত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি ভেনচারক্যাপিটাল তৈরি করে ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা উচিত।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির উদ্যোগে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত রচিত "বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে"শীর্ষক গ্রন্থের বিভিন্ন দিক নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনার ১৩-তম সিরিজ ওয়েবিনার এ আলোচক হিসেবে ফরাসউদ্দিন এসব কথা বলেন।
শনিবার সন্ধ্যায় আয়োজিত এই ওয়েবিনারের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল, বৈষম্যহ্রাস ও শোভন সমাজ প্রতিষ্ঠা: রাষ্ট্র-সরকার টাকা পয়সা পাবে কোথায়? কালো টাকা, অর্থপাচার, সম্পদ কর ইত্যাদি।
আলোচনা অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছেন অর্থনীতি সমিতি সহ-সভাপতি অধ্যাপক এ জেড এম সালেহ।
উল্লেখ্য, গেল বছরের এপ্রিলে সিএমএসএমই খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার প্যাকেজ থেকে এক বছরে ঋণ ছাড় করা হয়েছে মাত্র সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। এই প্যাকেজ থেকে ঋণ নিতে যেসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার জামানত দেয়ার সামর্থ্য নেই তাদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যে, ২ হাজার কোটি টাকার ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করেছে, সেখান থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ২৯ কোট টাকার গ্যারান্টি ইস্যু করা হয়েছে।
ফরাসউদ্দিন বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নই বলে দিচ্ছে বাংলাদেশে সুযোগ বৈষম্য বাড়ছে। এই সুযোগ বৈষম্য থেকে আয় বৈষম্য এবং তা থেকে সম্পদ বৈষম্য তৈরি হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ২৫ লাখ কুটির, ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আছে তাদেরকে প্রণোদনার অর্থ সহজভাবে পৌঁছে দিতে পারলে সুযোগ বৈষম্য কমে আসবে।
বোসটন কনসালটেশন গ্রুপ এর তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ২.৫ কোটি মানুষের মাথাপিছু গড় আয় বছরে সাড়ে চার হাজার কিংবা ৫ হাজার ডলার। এরা সবাই কর দেয়ার উপযুক্ত। অথচ এদের মধ্যে মাত্র ২৫ লাখ মানুষ কর দেয়। কর ফাঁকি বন্ধে অটোমেশন এর উপর গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশে বছরে ৫ হাজার মানুষ ধনীক শ্রেণিতে যুক্ত হচ্ছে উল্লেক করে তিনি বলেন, আয় বৈষম্য কমিয়ে আনতে চেষ্টা করতে হবে। তবে সহসাই তা পরিবর্তন হবে না। বিদ্যমান ব্যবস্থার মাঝে থেকেই ধীরে ধীরে আমাদের পরিবর্তন আনতে হবে। বৈষম্য কমাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে সংস্কার ও বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
আলোচক হিসেবে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকারের বর্তমান যে উন্নয়ন দর্শন তার মাঝেই বৈষম্য লুকিয়ে আছে।
তিনি বলেন, গেল ১০ বছর যেসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তার মধ্যে অনেক প্রকল্পের ব্যয় বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই বেশি। এই ব্যয়ের রহস্য হচ্ছে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ভয়ংকর দুর্নীতি। জবাবদিহীতা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়ায় প্রকল্পের নামে দুর্নীতির বন্ধ হচ্ছে না বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশর ধনীক শ্রেণিরা পাকিস্তান আমলের ২২ পরিবারের চেয়ে অনেক দ্রুত সময়ে ও আক্রমণাত্মকভাবে সম্পদ পুঞ্জিভূত করেছে। বর্তমানে চলা দুর্নীতি অনিয়মের ফলে গজিয়ে ওঠা ধনীক শ্রেণির উত্থানই হচ্ছে বেড়ে চলা আয় ও সম্পদ বৈষম্য।
আনু মুহাম্মদ বলেন, বৈষম্য বৃদ্ধি ও সুশাসনের সমস্যার ফলেই কালো টাকা বাড়ছে। এই কালো টাকার বড় অংশই অপরাধ দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাকনেজ স্টেট ইউনির্ভাসিটি এর ফাইন্যান্স এর অধ্যাপক ড. একেএম মতিউর রহমান আলোচনায় বলেন, কালো টাকার মালিকরা নিজের সম্পদ দেশে রাখা নিরাপদ মনে করে না। তাই তারা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয় নিয়ে অর্থ পাচার করে থাকে।
কালো টাকার উপার্জন কমিয়ে আনতে সম্পদ কর বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ। তবে হঠাৎ করে না বাড়িয়ে ধীরে ধীরে বাড়ানোর পরামর্শ তার। হঠাৎ বাড়ালে অর্থপাচার বেড়ে যেতে পারে বলে তার অভিমত।
তিনি বলেন, দেশে যারা সম্পদশালী হিসেবে পরিচিত আসলেই তারা কতটুকু সম্পদের মালিক তা খুঁজে দেখা উচিত। কারণ তাদের সম্পদের চেয়ে তাদের দেনা বেশি হয়ে থাকলে বুঝতে হবে তারা অন্যের অর্থে সম্পদশালী।