কোনোপ্রকার ব্র্যান্ডিং ছাড়াই আম রপ্তানিতে বড় চমক
বিশ্বের অন্যতম সুস্বাদু ফল আম রপ্তানিতে বড় চমক দেখাচ্ছে বাংলাদেশ। গত (২০২০-২১) অর্থবছরের ১২ মাসে বাংলাদেশ থেকে ফলটি রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৪০ হাজার ডলার হলেও, চলতি (২০২১-২২) অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই রপ্তানি হয়েছে ৬ লাখ ৬৪ হাজার ডলার।
আগের অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরে ১০ হাজার ডলারের আম রপ্তানি করেছিল। এবার একই সময়ে সিঙ্গাপুর ছাড়াও এশিয়া এবং ইউরোপের আরও ১৪টির বেশি দেশে আম রপ্তানি হয়েছে।
বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম হলেও, পণ্যটি রপ্তানি আয়ের দিক থেকে একদমই তলানিতে ছিল। বাংলাদেশের চেয়েও কম পরিমাণ আম উৎপাদন করে অনেক দেশ রপ্তানি থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে।
দেশে বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সে তুলনায় রপ্তানি অতি নগণ্য। অথচ ২০২০ সালে থাইল্যান্ড বিশ্বের সর্বোচ্চ ৭৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারের আম রপ্তানি করেছে। একইসময় বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত ১৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার ও পাকিস্তান ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারের আম রপ্তানি করে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আম রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে রপ্তানিযোগ্য উন্নত জাতের আমের অভাব। স্থানীয় আমের জাতগুলোর শেলফ লাইফ কম, অর্থাৎ দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া, মানস্মমত কৃষি পদ্ধতির চর্চা, আন্তর্জাতিক মানের প্যাকেজিং এর অভাব এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি আমের ব্রান্ডিং সংকটের কারণে এতদিন আম রপ্তানিতে সুফল আসেনি।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, গত মওসুমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে উপহার হিসেবে আম পাঠানোর খবর বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের আমের ব্রান্ডিং সৃষ্টিতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। তারপর থেকেই বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশি আমের রপ্তানি অর্ডার বাড়তে থাকে। এতেই রপ্তানির তলানি থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠার ইঙ্গিত মিলছে।
বাংলাদেশ ফ্রটুস অ্যান্ড ভেজিটেবল এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মনজুরুল ইসলাম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গতবছর বাংলাদেশ থেকে মাত্র ২ টন আম রপ্তানি হয়েছিল। এবছর ১৮শ টন আম রপ্তানি হয়েছে, যা বিরাট অর্জন।"
'বাংলাদেশের আম অত্যন্ত সুস্বাদু হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে এর কোন পরিচিতি ছিল না। ফলে রপ্তানি অর্ডারও আগে মিলত না। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত ও পাকিস্তানের সরকার প্রধানকে আম উপহার দেওয়ার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রচার পেয়েছে। এতে বাংলাদেশের আমের ব্রান্ডিং হওয়ায় এবছর রপ্তানি অনেক বেড়েছে'- যোগ করেন তিনি।
মনজুরুল ইসলাম বলেন, আগামী তিন বছরে সরকার ১ লাখ টন আম রপ্তানির লক্ষমাত্রা ঠিক করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমের দিকে সুনজর দিলে ভবিষ্যতে এখাত থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
কৃষিপণ্যের রপ্তানিকারক নাজমুল হায়দার ভূইয়া ইতালি, সুইজারল্যান্ড ও লন্ডনে আম রপ্তানি করেছেন। তিনি এবছর হিমসাগর ও আম্রপালি জাত রপ্তানি করেছেন। আমের সর্বোচ্চ দাম পেয়েছেন কেজিপ্রতি ৪০০ টাকা।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'বাংলাদেশের আমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ইউরোপের দেশগুলোতে। কিন্তু আমাদের রপ্তানি সক্ষমতা থাকলেও এয়ারলাইন্সের সমস্যার কারণে আমরা খুব বেশি রপ্তানি করতে পারিনি। পাকিস্তান ১ লাখ টনের বেশি আম রপ্তানি করে। এয়ারলাইন্সের সমস্যা দূর হলে, আমরা বর্তমানের চেয়ে বেশি আম রপ্তানি করতে পারব।'
২০২০-২১ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি আম রপ্তানি হয়েছে ইতালি ও যুক্তরাজ্যে। ইতালিতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৮৯২ ডলার এবং যুক্তরাজ্যে ১২ হাজার ১০৫ ডলার। এছাড়া, নেদারল্যান্ডসে ৫ হাজার ৬১৫ ডলার, অস্ট্রিয়ায় ৫ হাজার ৩৯৮ ডলারের আম রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
তবে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে যুক্তরাজ্যে ৫ লাখ ৬ হাজার ৪৮৭ ডলার এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭১,৮৭৪ ডলারের রপ্তানি হয়েছে কুয়েতে।
এছাড়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, জার্মানি, ইতালি, সৌদি আরব, সুইডেন, ভারত, সোয়াজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, নেপাল, সুইডেন ও সিঙ্গাপুরেও রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশের আম।
আম রপ্তানি বৃদ্ধির পাশপাশি সাত বছর পর এবার ইউরোপে লেবু রপ্তানি শুরু হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। যা দেশের ফলমূল রপ্তানি বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।
২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ফলমূল রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ৩০ লাখ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ফলমূল রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫.৮ লাখ ডলার।
মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১৫০-২০০ টন কাঁঠাল রপ্তানি হয়, এবার হয়েছে ৩ হাজার ৭০০ টন। কাঁঠাল রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪০ শতাংশের মতো।'
ইউরোপে জারা লেবু রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এ লেবুর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, দামও ভালো।
জারা লেবুর রপ্তানিকারক মো. আবুল হোসাইন বলেন, 'ফিনল্যান্ড, জার্মানি ও ইংল্যান্ডে লেবু রপ্তানি করছি। এর বাজার বেশ সম্ভাবনাময়। রপ্তানি সম্ভাবনা ভালো থাকায় এখন দেশেও এ লেবুর উৎপাদনও বাড়ছে।'