গাজীপুরে গ্যাসের স্বল্প চাপ, কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত
শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুরে হঠাৎ তিতাসের সরবরাহ করা গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে পোশাক কারখানায়। এতে সুতা ও কাপড় উৎপাদনে সক্ষমতা কমেছে শতকরা ৩০-৪০ ভাগ। লোকসানের মুখে থাকা মালিকপক্ষ বলছেন, রপ্তানিমুখী কারখানাগুলোতে গ্যাসের চাপ কম থাকায় দিনে বেশিরভাগ মেশিনপত্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আর বিকল্প জ্বালানী দিয়ে মেশিনপত্র চালালে দিতে হচ্ছে বাড়তি মাসুল। গ্যাসের তীব্র সঙ্কট চললেও সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এসব বিষয়ে কথা বলতেও নারাজ গ্যাস কর্তৃপক্ষ।
শিল্প পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, গাজীপুরে তিন হাজারের বেশি তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। কারখানাগুলোর মধ্যে টেক্সটাইল, স্পিনিং, উইভিং ও ফ্যাব্রিক প্রসেসিং বা সুতা-কাপড় উৎপাদনকারী কারখানাগুলোতে বেশিরভাগই গ্যাস নির্ভর উৎপাদন। প্রতি বর্গফুটে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকার কথা থাকলেও সম্প্রতি সেটি ওঠানামা করছে দুই থেকে আট-দশে। এতে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সমস্যা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দিনের বেশিরভাগ সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে জেনারেটর, মেশিনপত্র। ফলে আর্থিক লোকসানের মধ্যে পড়েছে এসব প্রতিষ্ঠান।
শ্রীপুর উপজেলায় স্থাপিত মোশারফ স্পিনিং মিলস লিমিটেড। উৎপাদন যন্ত্র পরিচালনায় জেনারেটর ব্যবহার হয় কারখানাটিতে। যার অনুমোদিত গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই। ৬ এপ্রিল রাত থেকে হঠাৎ করে গ্যাসের চাপ অনেক কমে যায়। যদিও এর আগে থেকেই নির্ধারিত চাপের গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। এ সমস্যার প্রভাবে উৎপাদন যন্ত্র ৪০-৫০ শতাংশ বন্ধ রেখেই কারখানা চালাতে হচ্ছিল। কিন্তু ৬ এপ্রিলের পর থেকে ৭৫ শতাংশের বেশি যন্ত্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আর রপ্তানি আদেশ ঠিক রাখতে বিকল্প জ্বালানী ব্যবহার করছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এতে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়, মান কমছে উৎপাদিত পণ্যে।
এ সমস্যা শুধু মোশারফ কম্পোজিট নয় একই এলাকার ইসরাক স্পিনিং মিলস ও টেক্সটাইল মিলসসহ মহানগর এলাকার সুতা-কাপড় উৎপাদনকারী বহু কারখানায়; গ্যাসের চাপ অতিমাত্রায় কম। ফলে দিনের বেশির ভাগ সময় প্রায় অর্ধেক উৎপাদন যন্ত্র বন্ধ রেখেই চালাতে হচ্ছে কারখানা।
কারখানা সংশ্লিষ্টরা জানান, সকাল ৬টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গ্যাসের চাপ একদম থাকে না। এতে কারখানার বেশিরভাগ মেশিন বন্ধ রেখে কিছু কিছু মেশিন চালু রাখা হয়। ফলে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটছে তাদের। এছাড়া কারখানার নিজস্ব জেনারেটর চালাতে যে পরিমাণ চাপ থাকার কথা পরিমাণের তুলনায় তা অনেক কম হওয়ার কারণে জেনারেটরও চালানো যাচ্ছে না। গ্যাসের মেইন লাইনে ১৫০ থেকে ২৫০ পিএসআই'র মতো চাপ থাকে কিন্তু এ চাপ অনেক সময় ৮-১০ পিএসআই-এ নেমে আসে।
গ্যাসের সঙ্কটের কারণে অনেক সময় ঠিকমতো অর্ডার সরবরাহ করতে না পারায় অনেক পোশাক কারখানার মালিক নতুন করে অর্ডার নিতেও পারছেন না। ঠিকমতো উৎপাদন না হলেও ব্যাংকের ঋণের কিস্তি তাদের ঠিকই হচ্ছে।
কারখানা মালিকদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ গ্যাসের দিকে কোন নজর দিচ্ছে না। আবার যে পরিমাণ বৈধ কারখানা আছে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক অবৈধ কারখানা ও বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে। এতে পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় কোন কোন কারখানায় উৎপাদিত পণ্য তৈরি প্রক্রিয়া সময়মতো শেষ করা যাচ্ছে না। এতে কমছে পণ্যের মান ও গুণাগুণ। কোন কোন কারখানায় বেশি মূল্য দিয়ে ডিজেল দিয়ে জেনারেটর চালাতে হচ্ছে। আবার কোন কোন কারখানায় রেশনিং করে মেশিন চালাতে হচ্ছে। এসব কারণে উৎপাদন খরচও কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে।
এদিকে, গ্যাসের চাপ কম থাকায় মেশিনপত্র বন্ধ রেখে বেকার বসে থাকতে হচ্ছে এসব কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের। ফলে যারা উৎপাদন চুক্তিতে কাজ করেন তারা বেতন ভাতা পাচ্ছেন কম। এছাড়া চাকরি হারানোর শঙ্কাও রয়েছে তাদের।
মোশারফ কম্পোজিট কারখানার অপারেটর শান্তি আক্তার জানান, 'গ্যাসের চাপের সমস্যার কারণে প্রায়ই মেশিনপত্র বন্ধ থাকে। এজন্য আমাদের বসে থাকতে হয়। কাজ না করলে আমরা যারা প্রডাকশনে কাজ করি তাদের বেতন ও হাজিরা কম হয়। এতে আমাদেরও সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে'।
কারখানার স্যাম্পলের দায়িত্বে থাকা রাজিব আহমেদ সৈকত জানান, 'গ্যাসের চাপ কম থাকায় উৎপাদন কমে গেছে। অনেক সময় মেশিনপত্র বন্ধ রাখতে হয়। মেশিনের ভেতর যেসব কাপড় থাকে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়ায় খারাপ প্রভাব পড়ে'।
এ ব্যাপারে মোশারফ কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী জানান, 'সুতা-কাপড় উৎপাদনকারী অত্যাধুনিক কারখানাগুলোর অধিকাংশই ২৪ ঘণ্টা চালু রাখার লক্ষ্যে ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশন চালু থাকে। এ প্রক্রিয়ায় জ্বালানি হিসেবে মূলত ব্যবহার হয় গ্যাস। কিন্তু গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় কারখানার উৎপাদন যন্ত্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে সপ্তাহে শুক্র, শনিবার গ্যাসের চাপ খানিকটা ভালো পাওয়া গেলেও সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে গ্যাসের চাপ কমে যায় ১-২ পিএসআই। ফলে আমরা মারাত্বকভাবে ভোগান্তিতে পড়েছি। গ্যাসের চাপ না থাকায় আমাদের উৎপাদন গড়ে ৩০ ভাগ কমে গেছে। তবে এখানে গ্যাস ছাড়াও জ্বালানী ব্যবহারে অন্য উৎসও আছে। যেমন পল্লী বিদুৎ, ডিজেল জিনারেটর আছে। এগুলো দিয়ে কোনভাবে আমরা কাজ চালাচ্ছি। কিন্তু এতে আমাদের উৎপাদন খরচ শতকরা ৪০ ভাগ বেড়ে যাচ্ছে'।
এমএন ডাইং, প্রিন্টিং এন্ড ওয়াশিং কারখানার নির্বাহী পরিচালক জহিরুল ইসলাম লিটন জানান, 'আমাদের এখানে মূলত ডাইং এবং প্রিন্টিংয়ের কাজ চলে। আমাদের এখানে ৩০ টন হচ্ছে ফেব্রিক ডাইং, ফাইবার ডাইং হচ্ছে ৫ টন। সব মিলিয়ে ৬৫ টন উৎপাদনের একটি প্রকল্প এটি। কিন্তু গ্যাসের চাপ কম থাকায় আমাদের অনেক মেশিন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ডাইং প্রজেক্টে যদি নিয়মিতভাবে সব ধরনের সহায়তা না দিতে পারি সেক্ষেত্রে অনেক ক্ষতি হয়। যেমন কোন মেশিনের ভেসলে অনেক কাপড় থাকে, সেসময় মেশিন বন্ধ থাকলে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়। বাসা বাড়িতে কাপড়ে নীল দিয়ে সাথে সাথে না ওঠালে যে সমস্যাটি হয় মেশিন বন্ধ থাকলে কাপড়েও সেই সমস্যা হয়, কাপড়ে দাগ লেগে যায়। এই ক্ষতি কিন্তু আমরা কোনভাবে কাটিয়ে উঠতে পারি না। তাই গ্যাসের চাপ স্বাভাবিক রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করছি। তা নাহলে আমাদের কারখানা ভালোভাবে চালাতে পারব না, ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রবৃদ্ধি'।
গ্যাসের চাপের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে গাজীপুর তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী রাজিব কুমার সাহা করোনা পরিস্থিতির অজুহাতে এসব বিষয়ে কথা বলা যাবে না বলে জানিয়েছেন। এ সময় তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিতাস গ্যাসের জনসংযোগ কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ে কথা বলার পরামর্শ দেন।
এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মির্জা মাহবুব জানান, 'আমাদের মোট চাহিদা হলো ২২শ' এমএমসিএন। এলএমজি আসার পর ১৮-১৯ শত দেয়া হতো যাতে মোটামুটি পোষানো যেত। এখন এটি ১৬-১৭ শত এর মধ্যে নেমে গেছে। ফলে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হচ্ছে। আমাদের এলএমজি আসছে তবে মাঝে মধ্যে গ্যাপ হচ্ছে। এলএমজির টার্মিনাল নিয়েও কাজ হচ্ছে। সব মিলিয়ে একটি গ্যাপের সৃষ্টি হয়েছে। তবে এলএমজি সরবরাহ স্বাভাবিক হলে এই সমস্যা থাকবে না'।
গাজীপুরে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) অন্তর্ভুক্ত ছোট-বড় মিলিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে চার শতাধিক। তীব্র গ্যাস সঙ্কটের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এসব কারখানায়। আর সমস্যা সমাধানে দ্রুত উদ্যোগের দাবি করছেন কারখানা মালিক, শ্রমিক ও পোশাক মালিকদের সংগঠনের নেতারা।