গাজীপুরে ছয় মাসে ১০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই
গাজীপুরের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় গত ছয় মাসে ১০ হাজারের বেশি শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে। এর মধ্যে করোনা সঙ্কটকালীন সময়ে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে বলে জানিয়েছে শিল্পাঞ্চল পুলিশ। আর এক সঙ্গে এত বেশি শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনায় বড়সড় ধাক্কা লেগেছে স্থানীয় অর্থনীতিতে। ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, এক সঙ্গে এত বেশি শ্রমিক ছাটাইয়ের কারণে জেলার অর্থনীতিতে প্রতি মাসে অন্তত ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
অন্যদিকে বেকার হয়ে জীবনযুদ্ধে টিকতে না পেরে পেশা পাল্টাচ্ছেন অনেক শ্রমিক। কারখানায় নতুন করে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়ে কেউ সবজি বিক্রেতা, কেউ ফেরিওয়ালা বা ভ্রাম্যমাণ দোকানের পসরা সাজিয়ে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন টিকে থাকাই বড় চ্যালেঞ্চ। তাই বলে আমরা চাকুরিচ্যুতিকে সমর্থন করি না।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশ সুপার ছিদ্দিকুর রহমান জানান, জেলায় দুই হাজার ৭২টি বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। এ সব কারখানায় ১৫ লাখ আট হাজার ৪০৪ জন শ্রমিক কর্মরত আছেন।
''গত ছয় মাসে এ সব কারখানা থেকে ১০ হাজার ৭৩৬ জন শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে। বিভিন্ন সঙ্কটের কারণে চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত এই ছাঁটাইগুলো হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে করোনা মহামারির মধ্যে'', যোগ করেন তিনি।
তিনি জানান, গাজীপুরে বিজিএমইএর ৮৩০টি, বিকেএমইএর ১৩৮টি, বিটিএমইএর ১২২টি ও অন্যান্য সংগঠনের আরও ৯৮২টি কারখানা রয়েছে।
শিল্পাঞ্চল পুলিশের তথ্য মতে, ছাটাই হওয়া শ্রমিকদের মধ্যে জয়দেবপুর এলাকার এলিগেন্স গ্রুপের ক্যাসিওপিয়া ফ্যাশনের দুই হাজার এবং তানাজ ফ্যাশনের ১২০০ শ্রমিক উল্লেযোগ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলায় বিজিএমইএ, বিকেএমইএ অন্তর্ভূক্ত ছাড়াও অনেক ছোট-বড় কারখানা রয়েছে। এ সব কারখানার বেশির ভাগ সাব কন্টাক্টে কাজ করে। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে সাব কন্টাক্টে কাজ করা অনেক প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে গেছে। আর এ সব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকরাও বেকার হয়ে পড়েছেন।
এ ছাড়া অন্যান্য বড় প্রতিষ্ঠানে একযোগে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনায় এলাকায় স্থানীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাবের সৃষ্টি হয়েছে।
গাজীপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি অ্যাডভোকেট আনোয়ার সাদত সরকার বলেন, একজন শ্রমিকের আয়ের ওপর তার পরিবার ছাড়াও মুদি দোকানী, বাড়িওয়ালাসহ সমাজের বিভিন্ন সেক্টর জড়িত। শ্রমিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর নেতিবাচক প্রভাব স্থানীয় অর্থনীতিতে পড়ে।
''জেলায় যদি ১০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়ে থাকে আর প্রতি শ্রমিকের গড় বেতন ১০ হাজার টাকা করে ধরা হয় তবে জেলার অর্থনীতিতে প্রতি মাসে অন্তত ১০ কোটি টাকা করে ক্ষতি হয়েছে'', যোগ করেন তিনি।
একসঙ্গে ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ফলে বেকার হয়ে যাওয়া শ্রমিকরা কাটচ্ছেন মানবেতর জীবন। জীবনযুদ্ধে টিকতে অনেকে পেশা পাল্টে ফেলেছেন। দু'মুঠো ভাতের আশায় কেউ রাজমিস্ত্রির সহযোগী, কেউ সবজি বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা ও ছোট পর্যায়ের দোকানী হয়েছেন। সংসারের খরচ কমাতে অনেকেই পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। চাকরি না পেয়ে স্থায়ীভাবে অনেক শ্রমিক নিজের বাড়ি ফিরে গেছেন।
এক সঙ্গে অনেক শ্রমিক চলে যাওয়ায় স্থানীয় বাজার, হাটেও এর প্রভাব পড়েছে। মুদি ও মনোহরী দোকানগুলোতে কমেছে বেচা-কেনা। এ ছাড়া ঘরভাড়া দিয়ে যাদের জীবন চলত, সেই বাড়িওয়ালাও রয়েছেন লোকসানে। অনেক বাসা-বাড়িতে ভাড়াটিয়ার অভাবে রুম খালি পড়ে রয়েছে।
একটি কারখানা থেকে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক জিল্লুর হোসেন জানান, তিনি ১২ বছর ধরে ওই কারখানায় চাকরি করছেন। কোনো অভিযোগ না থাকার পরও গত ১ জুন বেতন না দিয়ে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ কারখানা থেকে তার মতো আরও অর্ধশত শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে।
''চাকুরি না থাকায় এখন করোনার এ সংকটকালে পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়েছি। নতুন করে কোথাও চাকুরিও পাচ্ছি না। কী করব ভেবে পাচ্ছি না'', যোগ করেন তিনি।
এক সময় কারখানা শ্রমিক হিসেবে কাজ করলেও এখন ভ্যানে সবজি বিক্রি করে জীবন চালান আবদুল হালিম।
''করোনাকালে বিনা কারণে আমাকে ছাঁটাই করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। নতুন করে চাকরির সন্ধান না পেয়ে স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের জীবন বাঁচাতে এখন ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করছি। যা আয় হয় তা নিয়ে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি'', বললেন আবদুল হালিম।
শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বিষয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ায় আন্তর্জাতিক ক্রেতারা ক্রয় আদেশ বাতিল করেছেন। শ্রমিকদের মধ্যেও এ নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। তখন বাধ্য হয়ে কারখানা লে-অফ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে মন্দাভাবের কারণে অনেক ছোট-বড় কারখানা লোকসানে পড়েছে। আর এ কারণে শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে।
স্থানীয় অর্থনীতির মন্দাভাব নিয়ে সিটি করপোরেশনের ১২ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্বাস উদ্দিন বলেন, করোনাকালে ওই ওয়ার্ডের অন্তত দেড় হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছেন। তাদের একটি বড় অংশ পরিবার পরিজন নিয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে গেছেন।
''এখন অনেক বাড়ির রুম খালি পড়ে রয়েছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ৬-৭টি রুম খালি হয়ে গেছে। এ সব বাড়ির প্রতিটি রুম গড়ে তিন হাজার টাকা করে ভাড়া ছিল। রুম খালি থাকায় লাখ লাখ টাকার আর্থিক লোকসানে পড়েছেন বাড়িওয়ালারা'', যোগ করেন তিনি।
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু সাংবাদিকদের বলেন, শ্রমিক ছাঁটাই অমানবিক। কিন্তু মহামারীর কারণে শ্রমিকরা তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য জোরদার আন্দোলন করতে পারছেন না। এই সুযোগে মালিকরা নানা অজুহাতে শ্রমিক ছাঁটাই করছেন, যা খুবই উদ্বেগজনক।
বিজিএমইএর সহ-সভাপতি ফয়সাল সামাদ সঙ্কটের জন্য করোনাভাইরাস মহামারিকে দায়ী করে বলেন, পোশাক শিল্পে এখন ক্রান্তিকাল চলছে। পণ্যের অর্ডার বাতিল ও কমে যাওয়ায় অনেক কারখানা মালিক আর্থিক চাপে পড়ে উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছেন।
''অনেকে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। জনবল বাড়ানো বা কমানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ কারখানা কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ব্যাপার। তবে কারখানায় শ্রমআইন অনুসরণ হয় কি-না এবং শ্রমিকদের বকেয়া ও অন্য সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বিজিএমইএ নিশ্চিত করে থাকে'', বললেন ফয়সাল সামাদ।
এ বিষয়ে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী জানান, এটা একটা নিষ্ঠুর বাস্তবতা। মহামারীর কারণে পোশাকশিল্পের বাজার সংকুচিত হচ্ছে। এক্ষেতে আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানার মালিকরা তাদের সক্ষমতা ধরে রাখতে পারছেন না।
তিনি আরও বলেন, সরকার যদিও আমাদের জন্য অনেকগুলো প্যাকেজ দিয়েছে। তার সুবিধা বা সুফল এখনও অনেকের কাছে পৌঁছায়নি। ফলে শ্রমিকদের ধরে রাখা যাচ্ছে না, আবার তাদের বসিয়ে বেতনও দেওয়া যাচ্ছে না।
''এখন আমাদের মূল কাজ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখা, সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এখন টিকে থাকাই বড় চ্যালেঞ্চ। তাই বলে চাকুরিচ্যুতিকে আমি সমর্থন করছি না। এ সংকট শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই এখন এটা হচ্ছে'', যোগ করেন তিনি।