চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে: উন্নয়ন ভোগান্তিতে অর্ধেক ব্যবসা কমে গেছে, সড়কে ভোগান্তি সীমাহীন
চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড এলাকার প্রধান সড়কের পাশে ৫ বছর ধরে ক্যাফে জমজম নামে একটি খাবার হোটেল পরিচালনা করতেন মো: মনজুর আলম। প্রতিদিন এই হোটেলে বিক্রি হতো প্রায় ৩০ হাজার টাকার খাবার।
২০১৯ সাল থেকে চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরু হলে কমতে থাকে বিক্রি। একপর্যায়ে বিক্রি নেমে আসে ১০ হাজার টাকার নিচে। ১২ লাখ টাকা লোকসানে পড়ে চলতি বছরের মে মাসে ঈদুল ফিতরের আগে ক্যাফে জমজম ছেড়ে দিয়ে এখন তার পার্শ্বে ছোট পান দোকানে ব্যবসা করেন মনজুর আলম।
ওই দোকানে দৈনিক ২ হাজার টাকা বিক্রিতে সামান্য যে আয় হয় তা দিয়ে ৪ সদস্যের পরিবার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। স্ত্রীর হার্ট অপারেশনের পর টাকার অভাবে চেকআপ করাতে পারছেন না এই ব্যবসায়ী।
চট্টগ্রামের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের চলমান উন্নয়ন কাজের কবলে পড়ে এই সড়কের পাশের ছোট-বড় সকল ব্যবসায়ীর অবস্থা মনজুর আলমের মতো। প্রতিটি দোকানে বিক্রি কমেছে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ। দোকান ভাড়া পরিশোধ করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়েছে সকল ব্যবসায়ীর। প্রতিমাসেই ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উন্নয়ন কাজ চলায় নগরীর দেওয়ানহাট, চৌমুহনী, আগ্রাবাদ, ফকিরহাট, সল্টগোলা ক্রসিং, ইপিজেড, বন্দরটিলা, স্টিলমিল, কাঠগড়, পতেঙ্গা, সী বিচ রোড এলাকার ব্যবসায়ীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বৃষ্টি হলে কাদাপানি, অন্য সময় ধুলোবালিতে নাকাল ওই এলাকা। বিক্রি কমে যাওয়ায় অলস সময় পার করছেন ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম টিবিএসকে বলেন, "এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উন্নয়ন কাজের জন্য এই সড়কের পাশ্ববর্তী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর যে দুরবস্থা তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে ব্যবসায়ীরা। তাই দ্রুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ করা উচিত"।
চট্টগ্রাম নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এই সড়ক দিয়ে চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম বন্দর, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, চট্টগ্রাম ইপিজেড, কর্ণফুলী ইপিজেড, ছয়টি বেসরকারী অফডক সহ রয়েছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এই সড়ক দিয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার যানবাহন চলাচল করে। চট্টগ্রাম এবং কর্ণফুলী ইপিজেডে প্রায় ৪ লাখ শ্রমিক কাজ করে।
শুধুমাত্র যানজটের কবলে প্রতিদিন গড়ে শ্রমঘন্টার এক ঘন্টা সময় নষ্ট হয় ইপিজেডের কারখানাগুলোতে। এতে শ্রমিকদের দুর্ভোগের পাশাপাশি কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়। আমদানি ও রপ্তানি পণ্য পরিবহনেও পোহাতে হয় ভোগান্তি।
ইপিজেড এলাকার হযরত ছাদেক শাহ (র:) ফার্নিচার মার্টের ম্যানেজার মোহাম্মদ মিলন বলেন, "গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে দোকানে এক টাকাও বিকি হয়নি। অথচ স্বাভাবিক সময়ে মাসের প্রথম সপ্তাহে বিক্রি হতো প্রায় ৪০ হাজার টাকা। পুরো মাসে প্রায় ১ লাখ টাকার ফার্নিচার বিক্রি হতো। একদিকে করোনার প্রভাব একই সাথে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উন্নয়ন কাজ। ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ"।
ইপিজেড এলাকার ফুটপাতের চা দোকানদার মো: রুবেল, সবজি বিক্রেতা বিজয় চাকমাও জানালেন তাদের অসহায়ত্বের কথা। তারা বলেন, গত দুই বছর ধরে ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ হওয়া ছাড়া এই দুরবস্থা থেকে মুক্তি মিলবেনা।
চট্টগ্রাম আগ্রাবাদের ফুটপাতে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে কাপড়ের ব্যবসা করা জামাল উদ্দিন বলেন, "আমাদের ব্যবসা সড়কের পার্শ্বে। বালুর কারণে পোষাক নষ্ট হয়ে যায়। ক্রোতারাও দাঁড়াতে চায়না। পেটের দায়ে নিরুপায় হয়ে এমন ধুলোবালির মধ্যেও ক্রেতার আশায় বসে থাকতে হয়"।
চৌমুহনী এলাকার ওহী হুইল কলেকশনের প্রোপ্রাইটর মো: রফিকুল ইসলাম বলেন, "আমাদের সার্ভিস মূলত দোকানের সামনে সড়ককেন্দ্রিক। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের চলমান কাজের জন্য সড়কের বড় একটি অংশ ব্লক হয়ে যাওয়ায় দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড়াতে পারেনা। রাস্তার প্রশস্ততা আরো একটু বাড়ালে এমন ক্ষতির মুখোমুখি হতামনা। প্রতিমাসে লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। এমন অবস্থায় শেষ পর্যন্ত ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যায় কিনা দুশ্চিন্তায় আছি"।
এদিকে সামান্য বৃষ্টি হলেই সড়কে তৈরী হয় ছোট-বড় গর্ত। ওই সময়ে সড়কে যান চলাচল বিঘ্নিত হয়। সড়কে পায়ে হাঁটাও যায়না। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে নগরীর দেওয়াহাট থেকে ইপিজেড পতেঙ্গা পর্যন্ত সড়কে যাত্রী এবং পথচারীকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়তে হয়।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের (বিএইচআরসি) গভর্নর আমিনুল হক বাবু বলেন, "উন্নয়ন হলে নাগরিকদের কিছুটা দুর্ভোগ পোহাতে হয় এটা স্বাভাবিক। তাই বলে এভাবে দীর্ঘ সড়কজুড়ে শত শত গর্তের সৃষ্টি হবে এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। যে প্রকল্পে হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে উন্নয়নের পাশাপাশি শেখানে কংক্রিট, ইট, বালু দিয়ে সড়ক সংস্কার করাও জরুরী"।
এলিভেডেট এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক সিডিএ'র নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "উন্নয়ন প্রকল্পে সড়ক মেরামতের জন্য আলাদা কোন বরাদ্দ না থাকলেও সড়কে গর্ত তৈরী হলে ঠিকাদার সেটি সংস্কার করে দেয়। চুক্তিতে সেভাবেই উল্লেখ আছে। বৃষ্টিতে যে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে সেটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সংস্কার করে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের কাজ ৬০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ২০২৩ সালের জুন নাগাদ এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি"।
ইপিজেড এলাকার বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুল এন্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো: তাওছির বলেন, "চট্টগ্রাম বন্দর কলোনী থেকে ইপিজেড এলাকায় আগে ৩০ মিনিটের মধ্যে স্কুলে পৌঁছতে পারতাম। এখন এক ঘণ্টার চাইতেও বেশি লাগে। রাস্তায় যানজটের কারণে সঠিক সময়ে ক্লাসে যেতে অনেক সময় বাস থেকে নেমে হেঁটে যেতে হয়"।
বর্তমানে যানজট পেরিয়ে লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর এবং পতেঙ্গা সৈকতে যেতে সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। বিমানযাত্রীরা সময়মতো বিমানবন্দরে পৌঁছতে না পারায় ফ্লাইট মিস হওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ।
তবে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এসব দুর্ভোগ আর থাকবেনা। যে গন্তব্যে পৌঁছতে আড়াই ঘন্টা সময় লাগছে সেখানে পৌছাতে সময় লাগবে ১৫ থেকে ২০ মিনিট।
সিডিএ সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ১১ জুলাই একনেক সভায় ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকার এই প্রকল্প অনুমোদন পায়। সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই প্রকল্পের কাজ ৩ বছরের মধ্যে শেষ করার লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
এক্সপ্রেসওয়ের প্রশস্ততা ৫৪ ফুট। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে এসে এক্সপ্রেসওয়ের পিলার পাইলিং কাজের উদ্বোধন করেন। সিডিএ'র এই প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-র্যাঙ্কিন।