চুক্তির শর্ত পূরণে বিদেশ থেকে তিনগুণ দামে গ্যাস কিনছে সরকার
মহামারি করোনাভাইরাস প্রার্দুভাবে সারাবিশ্বে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) চাহিদা কমে গেলেও চুক্তির বাধ্যবাধকতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দুটি কোম্পানি থেকে প্রায় আগের পরিমাণেই এই গ্যাস আমদানি করছে বাংলাদেশ।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, ঠিক একারণেই বর্তমানে এলএনজির আন্তর্জাতিক মূল্যের চেয়ে তিনগুণ বেশি দামে গ্যাস কিনতে হচ্ছে সরকারকে।
বিশ্ববাজারে বর্তমানে প্রতি ১ হাজার ঘনফুট এলএনজির দাম ৩ থেকে ৩ দশমিক ৪ মার্কিন ডলার। তবে বাংলাদেশকে প্রতি হাজার ঘনফুটে এলএনজির জন্য পরিশোধ করতে হচ্ছে ৯ থেকে ১০ ডলার। এই পুরো আমদানির পেছনে সরকার প্রতি মাসে ব্যয় করতে হচ্ছে ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তবে মধ্যপ্রাচের দেশ কাতার ও ওমানের সঙ্গে করা এই চুক্তির রূপরেখা অনুযায়ী আগামী মাস থেকেই আবার কম দামে গ্যাস কিনতে পারবে বাংলাদেশ। বিশ্ববাজারে এলএনজির তিন মাসের দামের গড় হিসেবে আমদানিকৃত এই গ্যাসের দাম পরিশোধ করে আসছে বাংলাদেশ।
দেশের বিদ্যুৎ ও শিল্পখাতে গ্যাসের সংকট ঘোচাতে ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে এলএনজি আমদানি করছে সরকার।
লকডাউনের কারণে দেশে গ্যাসের চাহিদা কমে যাওয়ায় আমদানি করা গ্যাসের সঙ্গে সমন্বয় করতে দেশের তিনটি গ্যাস কোম্পানির অধীনে থাকা ৭০টি কূপ এবং বিদেশী তেল গ্যাস কোম্পানীর (আওসি) কূপ থেকে গ্যাসের উৎপাদন প্রায় ২৫ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে সরকার।
গত ৭ মার্চ একদিনে সারাদেশের গ্রাহকদের কাছে ২হাজার ৮৮২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করেছে বিতরণ কোম্পানী। এরমধ্যে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট ছিল আমদানিকৃত।
করোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে একের পর এক প্রতিষ্ঠান বন্ধের মধ্যে এর এক মাসের মাথায় গত ৭ এপ্রিল সারাদেশে গ্যাসের সরবরাহ নামিয়ে আনা হয় ২ হাজার ৪৩১ মিলিয়ন ঘনফুটে। এই সরবরাহ কমানো হয় দেশীয় কূপ থেকে। তবে আমদানিকৃত গ্যাসের সরবরাহ আগের মতোই রাখা হয়।
এ বিষয়ে জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জেষ্ঠ্য সচিব আনিসুর রহমান বলেন, "চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, কাতারের রাসগ্যাস কোম্পানি থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাস আমদানি করতে আমরা বাধ্য। এই গ্যাস না আনলেও চুক্তি অনুযায়ী আমাদের টাকা পরিশোধ করতে হবে।"
"তবে লকডাউনের এই সময়ে আমরা দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছি। এরফলে আমাদের দেশীয় রিজার্ভ জমা থাকবে এবং আমদানিকৃত গ্যাসের যথাযথ ব্যবহারও করা যাবে।"
কাতারের রাসগ্যাস এবং ওমানের ওমান'স ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল থেকে বাংলাদেশ গ্যাস আমদানি করে পরবর্তী প্রক্রিয়ার জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে অবস্থিত এলএনজি স্টেশনে রাখে। এই স্টেশনটির বছরে ৩ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন টন গ্যাস প্রসেসিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে।
কাতারের রাসগ্যাসের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী, বছরে তাদের কাছ থেকে ২৫ লাখ টন গ্যাস আমদানি করতে বাধ্য থাকে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা। তবে ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী, আমদানির পরিমাণ বছরে ১৫ লাখ টন পর্যন্ত বাড়ানো বা ৯ লাখ টন পর্যন্ত কমানোর সুযোগ রয়েছে পেট্রোবাংলার।
গত মার্চ মাসে এই দুই দেশ থেকে ৩ দশমিক ২ লাখ টন এলএনজি আমদানি করে বাংলাদেশ।
দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস সরবরাহ করা কাতার পেট্রোলিয়াম এবং ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল থেকে গ্যাসের সরবরাহ কমানোর বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা। পাশাপাশি তিনগুণ বেশি দামের পরিবর্তে, বর্তমান বাজার ধরে এলএনজি কেনার বিষয়েও কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি জ্বালানি বিভাগে।
বরং দেশের অর্থনীতিতে আসন্ন সংকটের মধ্যেও আগামী কয়েকমাস একই পরিমাণ এবং ব্যয়বহুল দামেই এলএনজি আমদানি করা হবে বলে জানা গেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে জ্বালানী বিভাগের জেষ্ঠ্য সচিব মো. আনিসুর রহমান জানান, খোলা বাজার থেকে কেনার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে এলএনজির স্বল্প দামের এই সুবিধাটি পাবে না।
তিনি বলেন, "খোলা বাজার থেকে এলএনজি আমদানির বিষয়টি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।"
এছাড়াও পেট্রোবাংলা বলেছে, আগামী মাসে কাতার এবং ওমান থেকে আসা চালানে আগের কম দামে এলএনজি আমদানি করবেন তারা।
পেট্রোবাংলার পরিচালক এবং রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. কামরুজ্জামান বলেন, "তিন মাসের গড় দামের ভিত্তিতে এলএনজির দাম নির্ধারিত হওয়ার কারণেই এক্ষেত্রে আমাদের সুবিধাটি সীমিত হয়ে গেছে।"
রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা জানান, চলতি মাসের ৪ তারিখ মহেশখালী স্টেশনে সর্বশেষ কার্গোতে করে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এসেছে।
বর্তমানে সরবরাহ করা গ্যাসের অধিকাংশই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোতে যাচ্ছে। বাকী অংশ যাচ্ছে গৃহস্থালী রান্নার জন্য বাসা-বাড়িতে।
৫ এপ্রিল সারাদেশে মোট ২৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে যার মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরবরাহ করা হয়েছে ১২১০ মিলিয়ন ঘনফুট। মোট সরবরাহ থেকে সার কারখানার জন্য ১৭৩ মিলিয়ন ঘনফুট এবং গৃহস্থালী কাজসহ অন্যান্য খাতে ১১২৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়।