দেশি শিল্প সুরক্ষায় আমদানিতে কর বাড়ানোর প্রস্তাব
আমদানি করা পণ্যের উপর বাড়তি কর বসিয়ে দেশীয় প্লাস্টিক শিল্পকে সুরক্ষার দাবি জানিয়েছেন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি প্লাস্টিক শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব তাদের।
আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় উদ্যোক্তারা নিজ নিজ খাতের বিষয়ে প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
গতকাল রবিবার (১৪ মার্চ) প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুত, গার্মেন্ট এক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, কাগজ, ব্যাটারি উৎপাদন ও রপ্তানিকারক, সুপার মার্কেট, ট্যুর অপারেটর, কাগজ, সিকিউরিটি সার্ভিস, কুরিয়ার সার্ভিসেস ও ট্যুর অপারেটর খাত থেকে বাজেট প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হয়।
উপস্থাপিত প্রস্তাবনার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়্যারম্যান আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনীম বলেন, "আমরা শুধু রাজস্ব আদায় করি না, জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ানো, স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা ও ব্যবসা সহায়ক পরিস্থিতি তৈরীতে কাজ করি।"
তিনি বলেন, "বাজেট প্রণয়নে শ্রমঘন ও দেশীয় শিল্পকে সবসময় গুরুত্ব দেয়া হয়। যেসব প্রস্তাবনা এসেছে, তা বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।"
দেশীয় শিল্পকে রক্ষার তাগিদ
প্লাস্টিক শিল্প দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে বিধায় এসব পণ্য আমদানিতে বাড়তি কর আরোপের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও আমদানিকারক এসোসিয়েশন (বিপিজিএমই)।
সংগঠনটির সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, "দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় সমজাতীয় পণ্য আমদানিতে বাড়তি কর আরোপ করতে হবে। আর প্লাস্টিক শিল্পের মৌলিক কাঁচামালে আমদানি শুল্ক হ্রাস করতে হবে।"
ঔষধ শিল্প, কৃষি ও খাদ্যের মোড়ক হিসাবে মধ্যবর্তী পণ্যের কাঁচামাল আমদানি শুল্ক হ্রাস, খেলনা আইটেমে ট্যারিফ মূল্য বৃদ্ধি, সবার জন্য একই আয়কর নীতি বাস্তবায়ন, কর্পোরেট কর ৩৫% থেকে কমিয়ে ১২ শতাংশ এবং উৎস কর ০.৫ শতাংশ ধার্য করার দাবি জানান তিনি।
আমদানিকৃত যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ, উপকরণ ইত্যাদির উপর হতে আমদানি শুল্ক, মূসক ও সম্পূরক শুল্ক অব্যহাতির সুবিধা সম্বলিত নির্দেশনায় প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিও তোলে সংগঠনটি।
এছাড়াও সুষম বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে প্রত্যন্ত ও অনুন্নত অঞ্চলে বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন উৎসাহিত করতে রেয়াতী হারে কর সুবিধা প্রদানের দাবি জানানো হয়।
কর্পোরেট ও উৎসে কর হ্রাস চায় বিজিএপিএমইএ
প্রতিযোগী দেশের সাথে টিকে থাকতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রপ্তানিকারকদের উৎস কর ০.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.২৫ শতাংশ করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স এসোসিয়েশন (বিজিএপিএমইএ)।
নিটওয়্যার ও ওভেন গার্মেন্টস উৎপাদন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে আয়কর ১২ শতাংশ ও গ্রীন বিল্ডিং সার্টিফিকেট থাকলে ১০ শতাংশ হওয়ার কথা রয়েছে।
অথচ এক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং সেক্টরে করহার ৩২.৫ শতাংশ বলে সংগঠনটি এনবিআরকে জানিয়েছে।
এই কর ১২ শতাংশে নামিয়ে আনার অনুরোধ ও স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত সকল পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে ভ্যাট মওকুফসহ মূসক-১৯ দাখিল করা হতে অব্যাহতি চেয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি আব্দুল কাদের খান।
তিনি বলেন, গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং খাতসহ প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারকের অনুকূলে রপ্তানি প্রনোদনা প্রদান করতে হবে।
বন্ড সুবিধায় কাগজ আমদানি বন্ধ চায় পেপার মিলস এসোসিয়েশন
দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ১০৬টি কাগজ উৎপাদনকারী শিল্প রয়েছে, যা চাহিদার চেয়ে আড়াইগুণ বেশি উৎপাদন করে। কাগজ শিল্পে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান; তিন শতাধিক উপ-খাত সম্পৃক্ত।
দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হলেও বন্ড সুবিধায় আনা কাগজ অবাধে খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে, যাতে দেশীয় শিল্পের অস্তিত্ব চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে।
এই অবস্থায় বন্ড সুবিধার মাধ্যমে কাগজ আমদানি বন্ধ ও আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশে পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন।
পাশাপাশি থার্মাল কোটিং স্লারির উপর করহার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা এবং পেপার কাপ, প্লেট, বোল দেশে উৎপাদিত হওয়ায় ট্যারিফ ভ্যালু প্রতি কেজিতে ১.৫ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৩.৫ ডলার করার প্রস্তাব রাখা হয়।
কুরিয়ারে ভ্যাট ৪.৫ শতাংশ করার দাবি
কুরিয়ার ও এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিসে ১৫ শতাংশ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এই ভ্যাট কমিয়ে ৪.৫ শতাংশ করার দাবি জানিয়েছে কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।
প্রতিষ্ঠানটির মতে, কুরিয়ার সার্ভিস, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, পরিবহন ঠিকাদার, তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর সেবা সবই সেবামূলক প্রতিষ্ঠান।
সারাদেশে চারশ কুরিয়ার সেবা প্রদান করলেও কুরিয়ার সার্ভিস সমিতির সদস্য ১৩০টি। এর মধ্যে ৫৯টি লাইসেন্সধারী, অবশিষ্টরা লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করছে। সমাজের কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করলেও কুরিয়ার সার্ভিসের সেবার বিনিময় মূল্য অনেক কম এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট অত্যধিক।
এছাড়াও সংগঠনটি, মাদকদ্রব্য সনাক্তকরণে কুরিয়ার সার্ভিস কর্তৃক আধুনিক স্ক্যানার ক্রয়ের ক্ষেত্রে সকল প্রকার ভ্যাট, ট্যাক্স ও শুল্ক মওকুফের দাবি জানিয়েছে।
ভিন্ন ভিন্ন ভ্যাট চায় রেস্তরাঁ মালিক সমিতি
ঢালাওভাবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ না করে পণ্য বিক্রির উপর ভিত্তি করে পৃথক পৃথক স্তরের ভ্যাটের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ রেস্তরাঁ মালিক সমিতি।
সংগঠনটির প্রস্তবনা হচ্ছে- ছোট-বড়, এসি-নন এসি সকল খাদ্য স্থাপনাকে ভ্যাট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করানো। দেশীয় খাবারের সকল রেস্তরাঁ, যাদের বার্ষিক বিক্রি তিন কোটি টাকা, তাদের জন্য ৩ শতাংশ মূসক, যাদের বার্ষিক বিক্রি ৬ কোটি টাকা, তাদের জন্য ৬ শতাংশ মূসক এবং যাদের বিক্রি ৬ কোটি টাকার উর্ধ্বে তাদের জন্য ১০ শতাংশ মূসক নির্ধারণ।
সংগঠনটির সভাপতি ওসমান গনি বলেন, "তিন কোটি টাকার বার্ষিক বিক্রি যেখানে সেসব প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে ইএফডি মেশিন সংযোজনের আদেশ বাতিল করতে হবে।"
সুপারস্টোরে সমহারে ভ্যাটের দাবি
সুপারস্টোরে সবার উপর ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রয়োগের দাবি জানিয়েছে সুপার মার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন।
সংগঠনটির যুক্তি জেনারেল স্টোরে প্যাকেজ ভ্যাট বাস্তবায়ন করা হলেও সুপারস্টোরে ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, "এই করনীতির কারণে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে সুপারস্টোর। এই অবস্থার নিরসনে একই হারে ভ্যাট আদায়ের প্রস্তাব করছি। এছাড়াও আমদানিকৃত যন্ত্রপাতির উপর কর কমানোর দাবি জানাচ্ছি।"