নগদ নয়, ভাইরাসের ভয়ে ডিজিটাল লেনদেনেই আগ্রহ
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই ভারতে ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতি ব্যবহারের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়, বিদ্যুৎ বিল থেকে শুরু করে যাতায়াত ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হচ্ছে এই পদ্ধতি।
এর আগে, ২০১৬ সালে ভারতে ডিজিটাল লেনদেন পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করার সরকারি উদ্যোগ সফল হয়নি।
মহামারির সময়ে লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংক নোটের বদলে ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতির ব্যবহার জায়গা করে নিচ্ছে। বর্তমানে দেশটির ইউনিফাইড পেমেন্ট ইন্টারফেস প্লাটফর্মটির লেনদেনের পরিমাণ এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ বেড়েছে।
অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায় অচলাবস্থার সম্মুখীন হওয়ায় ব্যাংক থেকে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের হারও এপ্রিলে প্রায় ধ্বসে পড়ে।
অনলাইন বিক্রয় প্লাটফর্ম গেট সিম্পল টেকনোলজি প্রা. লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী নিত্যানন্দ শর্মা বলেন, 'যারা আগে কখনো অনলাইন মাধ্যমে বিল দেননি, তারাও এখন অনলাইনে বিল দিচ্ছেন। অনেকে আগে কখনো অনলাইনে কেনাকাটা করেননি, এখন তারাও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার ক্ষেত্রেও এ মাধ্যম ব্যবহার করছেন। যা হতে পাঁচ বছর সময় লাগত, গত তিন মাসেই তা হয়ে গেছে।'
দীর্ঘদিন ধরে ভারতে ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ২০১৬ সালে উচ্চমূল্যের অধিকাংশ ব্যাংক নোট বাতিল করে দেওয়া হয়।
শুরুর দিকে এই পদ্ধতিতে জনপ্রিয় হলেও ব্যাংক নোট ব্যবহারের হার আবারও দিনদিন বাড়তে থাকে। মহামারির সময়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সতর্কতার কারণে অনলাইনে লেনদেন করছে মানুষ।
রিয়েল এস্টেট শিল্পের মুম্বাইভিত্তিক উদ্যোক্তা শচীন রাজে (৩৬) সম্প্রতি ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেন শুরু করেছেন। তিনি বলেন, 'ক্যাশ আদান-প্রদানের ফলে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায় আমি বর্তমানে ফলমূল, সবজি থেকে সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য অনলাইন অ্যাপের মাধ্যমে কিনি।'
বিগ মানি
গত বছর ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক জিডিপির ১০% ডিজিটাল লেনদেন থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তা ১৫% উন্নীত করার লক্ষ্য হাতে নেয়। বর্তমানে ভারত সরকার ডিজিটাল লেনদেন দিনপ্রতি বিলিয়ন ছোঁয়ার পরিকল্পনা করছে।
অ্যামাজন, অ্যালফাবেট ইঙ্ক-এর মতো কোম্পানিগুলো ভারতীয় ডিজিটাল পেমেন্ট মার্কেটে বিনিয়োগ করছে। এর ফলে স্থানীয় কোম্পানিগুলো পিছিয়ে পড়ছে; ব্যবসা সচল রাখতে তারা বিভিন্ন মূল্যের ছাড় দিচ্ছে।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারী তিন-চতুর্থাংশ ভারতীয় লকডাউনের সময় থেকে ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতির ব্যবহার বাড়িয়েছেন, ৭৮% আশা করছেন আগামী ছয় মাসে ব্যবহারের হার আরও বাড়বে। কাপজেমানাই রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট এই তথ্য প্রকাশ করা হয়।
ফেসবুক অ্যান্ড বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের আরেকটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে, দেশজুড়ে লকডাউনের সময় মার্চ থেকে যে হারে অনলাইন লেনদেন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটি আগামী আরও ছয় মাস বজায় থাকবে।
ক্যাশের রাজত্ব
ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত মাথাপিছু ডিজিটাল লেনদেনের হার পাঁচ বার বৃদ্ধি পেয়ে ২২.৪ হয়েছে। তবে এই সংখ্যা চীনের তুলনায় অনেক কম, ২০১৭ সালে চীনের মাথাপিছু ডিজিটাল লেনদেন ছিল ৯৬.৭। এক্ষেত্রে ভারতের জনগণের ক্যাশ লেনদেন প্রথা কমতে আরও অনেক সময় লাগবে।
ক্যাপিটাল ইকোনমিকস সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিবিদ ড্যারেন এ. বলেন, 'ভাইরাসের প্রাদুর্ভাববিহীন সময়ের তুলনায় বর্তমানে নোটবিহীন লেনদেন দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেলেও, আরও অনেক সময় পর্যন্ত নোট লেনদেনই বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম হিসেবে থাকবে।'
মোট জনসংখ্যার মাত্র এক- তৃতীয়াংশের ইন্টারনেট সংযোগ থাকা ও নেটওয়ার্ক সমস্যা প্রধান প্রতিবন্ধকতা এক্ষেত্রে। ২০% জনগণের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকাও কার্ডে লেনদেনের বৃদ্ধিতে অন্যতম অন্তরায়।
মুম্বাইয়ের বারক্লেস ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ রাহুল বাজোরিয়া ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতিকে মূলত একটি শহুরে প্রথা মন্তব্য করে বলেন, 'এই পদ্ধতি টিকে থাকবে, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে গিয়ে এর বৃদ্ধির হার থেমে যাবে।'
লকডাউনের শুরু থেকে প্রায় সকল ধরনের ব্যবসা অচলাবস্থায় পরলেও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির বাজার টিকে থাকে। হিটাচি পেমেন্ট সার্ভিসের কর্মকর্তা নাভতেজ সিং জানান, 'ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে ছোট শহরগুলোও ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতির সঙ্গে দ্রুতগতিতে মানিয়ে নিচ্ছে। তবে আগের মতো বড় কোম্পানিগুলোর তুলনায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে এই পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ছে।'
- সূত্র: ব্লুমবার্গ