নতুন লকডাউনে চোখে অন্ধকার দেখছেন স্থানীয় ব্র্যান্ড ও রিটেইলাররা
বাংলা নববর্ষ ও রোজার ঈদেই সবচেয়ে বেশি প্রাণচাঞ্চল্য থাকে দেশের অর্থনীতিতে। তবে আরেকবার লকডাউনের সিদ্ধান্তের ফলে গতবছরের পর এবারো ব্যবসায় লোকসানের শঙ্কা তৈরি হওয়ায় চোখে অন্ধকার দেখছেন স্থানীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড ও রিটেইলাররা।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেছেন, শুধু পহেলা বৈশাখেই দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। রোজার ঈদে হয় এর কয়েকগুণ বেশি। স্থানীয় জামা-কাপড়, শাড়ি, লুঙ্গি, প্যান্ট, শার্টসহ স্থানীয় পোশাকের ৭০ শতাংশই বিক্রি হয় এ দুই উৎসবে। গত বছরের পর এবারের উৎসব থেকেও লাভের টাকা না উঠে আসলে পথে বসতে হবে কয়েক লাখ উদ্যোক্তাকে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সেক্রেটারি মনসুর আহমেদ বলেন, 'পহেলা বৈশাখ ও রোজার ঈদে স্থানীয় বাজারে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হয়। অধিকাংশ কারখানা বন্ধ থাকায় গত বছর উৎসব হয়নি। এবারো উৎসব না হলে ভবিষ্যত কি হবে আমরা বলতে পারছি না'।
কেরানীগঞ্জ জেলা পরিষদ মার্কেটে নিজের কারখানার জিন্সপ্যান্ট পাইকারি বিক্রি করেন গোলেনুর গার্মেন্টেসের মালিক মুক্তার দেওয়ান। গত বছর ঈদ ও পহেলা বৈশাখের জন্য ৩ কোটি টাকার পোশাক উৎপাদনের পর ৫০ লাখ টাকার পণ্যও বিক্রি করতে পারেননি।
এবার আবার নতুন করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মুক্তার দেওয়ান। তবে সাম্প্রতিক আরোপিত লকডাউনের ফলে ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি।
মোক্তার দেওয়ান দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, 'গত বছর ব্যাংক থেকে ঋণ ও মূলধন ভেঙ্গে শ্রমিকদের বেতন ও পরিবার চালিয়েছি। সারা বছর ধরে কিছু পোশাক উৎপাদন করলেও তা বিক্রি করতে পারিনি। এখন ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হলে দোকান, শো-রুম ভাড়া ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়'।
মোক্তার দেওয়ানের মতোই গতিহীন কারখানা ও বিক্রয় কেন্দ্রসহ এখানকার প্রায় ১০,০০০ ব্যবসায়ী।
লকডাউনের কারণে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান বন্ধ হলে সম্বল হারানোর শঙ্কায় নারায়ণগঞ্জের মারিয়া বাটিক হাউজের স্বত্বাধিকারী মানিক চান। ১০ লাখ টাকার লক্ষ্য থাকলেও এখন পর্যন্ত বিক্রি করেছেন ২ লাখ টাকার মতো। এখন ব্যাংক ঋণ, শ্রমিকদের বেতন, কারখানার ভাড়া ও নিজের পরিবার নিয়ে শঙ্কিত এ উদ্যোক্তা।
টিবিএসকে তিনি বলেন, 'পহেলা বৈশাখে যেসব ডিজাইনের পোশাক হয়, তা অন্য সময় চলে না।
পহেলা বৈশাখের পোশাকের রঙ ও ডিজাইন ব্যতিক্রম হয়। কোনো বিশেষ সাহায্য না পেলে নিজের ভবিষৎ কি হবে জানি না'।
মারিয়া বাটিক হাউজের মতোই অবস্থা ৮-১০ হাজার উদ্যোক্তার। এসব উদ্যোক্তার ছোট ছোট কারখানা ও দোকানে কাজ প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক।
নতুন লকডাউন ঘোষণার কারণে কেরাণীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের মতোই বিপাকে নরসিংদীর বাবুবাজার, নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়া, কিশোরগঞ্জের ভৈরব, ঢাকার ইসলামপুর, টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জের তাঁত পল্লীসহ স্থানীয় পোশাক উৎপাদন ও বিপণণের কেন্দ্রগুলো। মূলধন হারিয়ে টিকে থাকায় শঙ্কায় সীমিত পরিসরে হলেও পোশাকের দোকান খোলার দাবি করছেন তারা।
গত বছরের মতো এবারও পহেলা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতরের উৎসব না থাকলে ফ্যাশন হাউসগুলোর ৬-৭ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির মধ্যে পড়বে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ফ্যাশন ডিজাইনার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও অঞ্জনস শোরুমের মালিক শাহীন আহমেদ।
তিনি বলেন, 'পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এ বছর আমাদের লক্ষ্যমাত্রা তিন হাজার কোটি টাকা। সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। ঈদে আরো বড় প্রস্তুতির চিন্তা সবার। এই খাতে আমাদের ফ্যাক্টরি, শোরুম, মাল সাপ্লাইয়ার, তাঁত শ্রমিক, সেলাইকর্মীসহ ৫ লাখের বেশি লোক জড়িত। এদের ৮০ শতাংশই নারী'।
অন্যদিকে দেশীয় ফ্যাশন হাউস সাদাকালোর চেয়ারম্যান মো. আজহারুল হক আজাদ বলেন, 'পহেলা বৈশাখে বেঁচাকেনা বন্ধ থাকলে আমাদের অন্তত ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হবে'।
অনলাইনে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ায় চিন্তা ব্র্যান্ডগুলোর
গত বছরের লোকসান কাটাতে এবার পহেলা বৈশাখ ও ঈদকে কেন্দ্র করে বছরজুড়েই প্রস্তুতি নিয়েছে স্থানীয় ফ্যাশনগুলো। দেশীদশ, ইয়েলো, সেইলর, জেন্টলপার্ক, ইনফিনিটিসহ দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোর বিক্রির ৫০ শতাংশের বেশি হয় এই দুই উৎসবে। লকডাউন ঘোষণা হওয়ায় বাস্তবতা মেনে নিয়ে অনলাইনে বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্র্যান্ডগুলো।
ইয়েলোর হেড অব রিটেইল হাদী চৌধুরী বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতির কারণে লকডাউনের বিকল্প নেই। আমাদের প্রস্তুতি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। মার্কেট বন্ধ রাখতে হলে অনলাইনে বিক্রি করতে হবে'।
বর্তমানে মোট বিক্রির ২০ শতাংশ অনলাইনে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা অনলাইনে বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। তবে ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখতে অন্তত পোশাক ব্র্যান্ডগুলো খোলা রাখার অনুমতি দেবে বলে আমরা আশা করছি'।
পহেলা বৈশাখ ও ঈদ মিলিয়ে প্রায় ৫০০০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করে দেশীয় ফ্যাশনের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড আড়ং। অনলাইনে বিক্রিতে জোর দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে মোট বিক্রির ২০-২৫ শতাংশ অনলাইনে হচ্ছে তাদের।
তবে অনলাইন এখনো পুরোপুরি জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বলেন, 'অনলাইনে পণ্য নির্বাচন ও সচেনতায় আমরা অনেক পিছিয়ে। তাই এখানে পুরোপুরি নির্ভর করা যাবে না'।
বেশি ক্ষতির মুখে এসএমই উদ্যোক্তারা
পহেলা বৈশাখকে ঘিরে প্রতিবছর অর্থনীতিতে যে প্রাণচাঞ্চল্য হয় তার বড় অংশই এসএমই খাতের। গত বছরের মতোই এবারো প্রস্তুতি নিয়ে সংকটে পড়েছেন লাখ লাখ ছোট পুঁজির উদ্যোক্তা।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, 'নববর্ষ উপলক্ষে পোশাক ছাড়াও আসবাবপত্র ফুল, খেলনাসহ বিপুল পরিমাণ কার্ড ছাপানোর কাজ করেন ছোট উদ্যোক্তারা । এ বছর কার্ড ছাপানো হয়নি। ফলে শ্রমিকরা অলস সময় পার করছেন। বেকার হয়ে পড়েছেন। বৈশাখের এই সময়ে প্রচুর ইলিশের বাণিজ্য হয়। সেটিও বন্ধ হয়ে গেল'।
তিনি আরো বলেন, 'ঢাকা মহানগরীতে আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ৩৭টি বাজার আছে। করোনাভাইরাসের কারণে নববর্ষের উদযাপন বাতিল হওয়ায় আমাদের আড়াই লাখ শ্রমিক জীবন-জীবিকার হুমকিতে পড়লেন'।
নববর্ষের মেলা হচ্ছে না এবারও
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর পহেলা বৈশাখকে ঘিরে বাংলা একাডেমিতে ১০ দিনের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সারাদেশের শিল্প নগরীতেও বসে একই ধরনের মেলা। এসব মেলায় কয়েক লাখ উদ্যোক্তা সারা বছরের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করেন।
গত বছরের মতো এবারও মেলা বাতিল হওয়ায় বড় ধরণের ক্ষতির মধ্যে পড়বেন বুটিক থেকে শুরু করে জামদানি শাড়ি, ফার্নিচার, জুতাসহ স্থানীয় ফ্যাশন সামগ্রী বিক্রি করা কয়েক লাখ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা।
যদিও শনিবারই এক বিজ্ঞপ্তিতে সারাদেশের উদ্যোক্তাদের স্বাস্থবিধি মেনে ৫০ শতাংশ জনবল নিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে বিসিক।
বিসিক চেয়ারম্যান মোস্তাক হাসান বলেন, 'পহেলা বৈশাখকে ঘিরে আমাদের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আশা নিয়ে থাকেন। গ্রামগঞ্জে যেসব তাঁত মেলা হওয়ার কথা, সেগুলোও হবে না। কিছু উদ্যোক্তা অনলাইনে ব্যবসায় গেলেও উৎসের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবে না'।