বগুড়ার বিষমুক্ত আলু-ফুলকপি যাচ্ছে বিদেশে, যাবে কচুও
বগুড়ায় উৎপাদিত আলু প্রায় এক যুগ ধরেই দেশের বাইরে যাচ্ছে। সাত বছর ধরে বাঁধাকপিও মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও তাওয়ানের বাজারে দেখা মিলছে। বগুড়ার মিষ্টি কুমড়াও রপ্তানি হচ্ছে নিয়মিত।
এই সুখবরের যাত্রায় কচুর মুখী রপ্তানির বিষয়টিও উঁকি দিচ্ছে। কৃষি দপ্তরের নথিতে প্রকৃত চিত্র না থাকলেও রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বগুড়া থেকে এবার ২০ হাজার মেট্রিক টন সবজি বিদেশে রপ্তানি করা হবে। যদিও গত বছর প্রায় ১১ হাজার মেট্রিক টন সবজি বিদেশের বাজারে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করা হয়।
আগের বছরগুলোর রপ্তানির কোনো তথ্য না থাকলেও এবার সবজি রপ্তানির নথি তৈরি করছে উপজেলা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়। তারা বলছে, এবার বগুড়া থেকে ৬৫৫ মেট্রিক টন বাঁধাকপি রপ্তানি করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে, মিষ্টি কুমড়া ৪০০ মেট্রিক টন এবং আলু যাবে অন্তত ১৪ হাজার মেট্রিক টন।
উপজেলার ৩৫ জন কৃষকের কাছ থেকে এসব সবজি ক্রয় করা হবে। বগুড়ার এসব সবজি অন্তত বিদেশের ছয়টি দেশে রপ্তানিকারকের মাধ্যমে পাঠানো হবে।
চলতি মৌসুমে শিবগঞ্জ উপজেলায় সাড়ে ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হচ্ছে। এতে প্রায় ৪ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হবে। অন্য সবজি ১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে। হেক্টরপ্রতি ফলন ধরা হয়েছে ৩০ মেট্রিক টন। এরমধ্যে শিবগঞ্জেই ৫১ হাজার মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন হবে।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এ জেলায় এখন শীতকালীন সবজির চাষাবাদ হচ্ছে। এর মধ্যে আলু, বাঁধাকপিসহ অন্যান্য সবজি বাজারে উঠেছে পুরোদমে। এবার জেলায় ১২ হাজার ৮১৩ হেক্টর জমিতে সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন। বগুড়ার ১২ উপজেলার মধ্যে শিবগঞ্জেই সবচেয়ে বেশি সবজি উৎপাদিত হয়। উৎপাদন বেশি হওয়ায় এ উপজেলাকে কেন্দ্র করেই সবজির বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে।
চলতি বছরে ১১ জানুয়ারি উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি কার্যালয় মিলে 'বাঁধাকপি বিদেশে রপ্তানি' কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। অবশ্য শিবগঞ্জের জাহাঙ্গীরাবাদ এলাকার সাগর হোসেন ঢাকার এক রপ্তানিকারকের মাধ্যমে ২০১৪ সাল থেকে বিদেশে বাঁধাকপি রপ্তানি করে আসছেন। আর বিদেশের বিভিন্ন দেশে ২০০৮ সাল থেকে একই প্রক্রিয়ায় আলু রপ্তারি করছেন মেসার্স সাগর ট্রেডার্সের সত্বাধিকারী সাগর হোসেন।
সাগর বলেন, 'সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় এবার প্রায় এক হাজার ৫০ মেট্রিক টন বাঁধাকপি পাঠানো হবে। এজন্য ঢাকার মাশওয়া অ্যাগ্রো লিমিটেড রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে। এখন প্রতিদিন ৬০ মেট্রিক টন বাঁধাকপি প্রক্রিয়াজাত করে ট্রাক লোড করে চট্রগ্রাম পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত আলু ও বাঁধাকপি মিলে দেড় কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৫০০ শ্রমিক কাজ করছেন। এর মধ্যে অন্তত ৩০০ জনই নারী।'
এবার বিদেশে বাঁধাকপির বেশি চাহিদার কথা উল্লেখ করে এই ব্যবসায়ী বলেন, 'এখন বাঁধাকপির মাঝামাঝি সময়। এই সময়ের মধ্যেই প্রায় দেড় কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। চাহিদা বেশি থাকায় আরও দেড় কোটি টাকার বাধাঁকপি বিদেশে পাঠানো যাবে।'
সাগর আরও বলেন, 'শিবগঞ্জের বিহার, মহাস্থান ও ছোট হাটপাড়ায় বেশি কপি উৎপাদন হয়। এখানকার কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি বাঁধাকপি কিনে বিদেশের রপ্তানিকারকের কাছে দেওয়া হয়। বিদেশে পাঠানোর জন্য বাজার থেকে সবজি কিনে দেওয়া যায় না। কারণ বাজারের সবজিতে নানা ধরনের কেমিক্যাল দেওয়া হয়। কিন্তু আমি কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি, আমাকে দেওয়া সবজি বিষমুক্ত হতে হবে। একইসঙ্গে ওজন ও মাঠে নির্দিষ্ট সময় ধরে রাখতে হবে। পরিপূর্ণভাবে পুষ্ট সবজিই কেবল বিদেশে পাঠানোর উপযোগী হয়।'
সাগর ট্রেডার্সের সত্বাধিকারী সাগর হোসেনের পাঠানো আলু যাচ্ছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে। তিনি প্রতিদিন ১০০ টন আলু রপ্তানিকারকের মাধ্যমে বিদেশে পাঠাচ্ছেন।
আলুর চাহিদা বেশি থাকে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। এরপর তিনি ৩০ থেকে ৩৫ টন আলু প্রতিদিন রপ্তানিকারকের মাধ্যমে বিদেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মাশওয়া গ্রুপের সত্বাধিকারী আরিফ আজাত প্রিন্স বলেন, 'কয়েক বছর ধরে বগুড়া ও যশোর এলাকা থেকে বাঁধাকপি রপ্তানি করা হচ্ছে। তবে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বগুড়ার ২ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন বাঁধাকপি রপ্তানি করা হয়েছে। এবার বাঁধাকপির চাহিদা ভালো। তাইওয়ানে এবার বাঁধাকপির বেশি চাহিদা। আশা করা হচ্ছে, আরও ২ হাজার মেট্রিক টন বাঁধাকপি পাঠানো যাবে।'
'সার পরিমাণমতো ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে বগুড়ায়, যাকে বলে গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস। এসব সবজি আমরা কিনে চট্টগ্রাম বন্ধর দিয়ে বিদেশ পাঠাই,' যোগ করেন তিনি।
প্রিন্স আরও বলেন, 'এবার ১ হাজার মেট্রিক টন মিষ্টি কুমড়ার অর্ডার নেওয়া আছে। এগুলো বগুড়া থেকে কিনব। বগুড়ায় কচুর মুখী প্রচুর পরিমাণে উৎপান হয়। কৃষকেরা কম দাম পান। এবার আমরা কচুর মুখী রপ্তানি করব। এ কারণে বগুড়ার শিবগঞ্জের একটি জায়গাও নেওয়া হয়েছে। সেখানে কুলিং চেইন মেইনটেন করে সব সবজি রপ্তানি করব।'
'বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ১৪২০' জয়ী বগুড়ার আলু চাষী, ব্যবসায়ী এবং বাংলাদেশ আঞ্চলিক কৃষক প্রতিনিধির নেতা মো. আজমল হোসেনও ২০০৮ সাল থেকে বিদেশে আলু পাঠান ঢাকার কাজী মুন্নী রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি উপজেলা কৃষি কার্যালয়ে বসেই তিনি বলেন, 'কতজন ব্যবসায়ী সবজি বিদেশ পাঠান, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বগুড়া থেকে গত বছর ১১-১২ হাজার মেট্রিক টন সবজি দেশের বাইরে গেছে। এবার ২০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।'
এ বিষয়ে শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, 'অন্যান্য বছর কৃষকেরা আমাদের না জানিয়ে সবজি দেশের বাইরে নিয়েছেন। এ কারণে কোনো পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে এবার আমরা প্রত্যয়ন দিচ্ছি। আর নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য উপজেলার একটি ইউনিয়নে ৫০০ কৃষককে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।'
বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহিত করতে বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলমগীর হোসেনও। তিনি বলেন, 'উপজেলা উন্নয়ন ও পরিচালক ফান্ড থেকে ২ লাখ টাকা কৃষকদের প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে উৎসাহিত করার জন্য।'
তিনি আরও বলেন, 'অন্যান্য সবজির মতো এ বছর বগুড়া থেকে এক হাজার মেট্রিক টন বাঁধাকপি দেশের বাইরে যাচ্ছে। আমরা চাই এই পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ুক। দেশের কৃষি আরও সমৃদ্ধ হোক।'