বছরে ৩,০০০ কোটি টাকার কালির ব্যবসা, অথচ পুরোটাই আমদানি নির্ভর
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কালির ব্যবহার অপরিহার্য। কালির প্রয়োগ সবচেয়ে বেশী হয় লেখা ও মুদ্রণের কাজে। ব্যবহার সবচেয়ে বেশী লক্ষ্য করা যায় ম্যানুয়াল ছাপাখানা, লেজার প্রিন্টার এবং কলমের মধ্যে।
দেশে প্রতিবছর প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার কালির ব্যবসা হলেও এখন পর্যন্ত এই কালির প্রায় শতভাগই আমদানি নির্ভর।
কালি সরবরাহকারী ও ব্যবহারকারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কোরিয়া, জাপান, জার্মান, রাশিয়া, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, চীন ও কাজাখস্তানসহ প্রায় ২৫টি দেশ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও নন-ব্র্যান্ডের কালি বাংলাদেশে আমদানি করা হয়।
কালি উৎপাদনে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের অভাবেই মূলত এই ব্যবসা এখনো পুরো আমদানি নির্ভর বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও কালি উৎপাদন করে যে দেশে ব্যবসা ও রপ্তানি করে বছরে প্রায় শতকোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা সম্ভব, এই বিষয়টি এখনো সরকার সংশ্লিষ্টদের কারো নজরে আসেনি বলে জানান এই ব্যবসার সাথে জড়িতরা।
সবচেয়ে বেশী কালির ব্যবহার
বাংলাদেশ কালি প্রস্তুতকারক মালিক সমিতি ও প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কালির ব্যবহার হয় ম্যানুয়াল প্রিন্টিং প্রেসে। সাধারণত বই, পত্রিকা, পোস্টার, প্যাকেজিং ডিসপ্লে, ব্যানার, বিভিন্ন রশিদবই সহ নানা ধরনের কাজে এই কালি ব্যবহৃত হয়।
প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান শহীদ সেরনিয়াবাত টিবিএসকে বলেন, সারাদেশে ছোট-বড় প্রায় ১৫ হাজার প্রিন্টিং প্রেস রয়েছে। এই প্রেসগুলোতে বছরে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকার বিভিন্ন রকম কালি ব্যবহার করা হয়। যার প্রায় শতভাগ বিদেশী কালি। তিনি বলেন, শুধু রাজধানীতেই প্রায় ২,০০০ প্রেস রয়েছে।
দেশের বড় প্রিন্টিং প্রেসগুলোর মধ্যে অন্যতম ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেড। কয়েক বছর ধরে তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বই মুদ্রণের কাজ করে আসছে। এছাড়াও নিজেদের তিনটি ও আরও কয়েকটি পত্রিকা নিয়মিত ছাপানো হয় এই প্রতিষ্ঠানটির প্রেসে।
প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, প্রতিবছর এখানে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বিভিন্ন রকম কালির ব্যবহার করতে হয়। যার পুরোটাই কোরিয়া, জার্মানি ও চীন থেকে আমদানি করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি নিজেই।
বাংলাদেশ কালি প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির সভাপতি এম এ মোমেন টিবিএসকে বলেন, দেশে প্রায় ৮০টি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা কালি রপ্তানি করে। আর একটি মাত্র দেশীয় প্রতিষ্ঠান কালি উৎপাদন করে।
সংগঠনটি জানায়, বাংলাদেশে ফুজি ইঙ্ক, আকিজ গ্রুপের নেবুলা ইঙ্ক লিমিটেড, এআর ট্রেডিং কোং, মাস্টারপ্যাক লিমিটেড, খান ডাইটেক, নিউ রেজুলি স্ক্রিন প্রিন্টিং, পাইরিমেটেক্স, পিলক্রো গ্লোবাল, কিউর প্রোডাক্ট, রোশফি সিম্বল বিজনেস কোং, স্বচ্ছ ট্রেড হাউস বাংলাদেশ, এসকে ট্রেড লিংক, রয়েল ইঙ্ক, নিসান ইঙ্ক-নিসান পেইন্ট এন্ড অটোল্যাকিউয়ার কোং এবং এভারটেক্স ইঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল কালি আমদানির শীর্ষে রয়েছে।
কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট দেয়ার কাজে ব্যবহৃত লেজার প্রিন্টারের কালি
মুদ্রণ কাজের পরেই সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হয় কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট দেয়ার কাজে ব্যবহৃত লেজার প্রিন্টার ও ইঙ্কজেট প্রিন্টারের কালি। দেশে প্রায় ৭০টি প্রতিষ্ঠান এই প্রিন্টারের কালি আমদানি করে। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা প্রতি বছর প্রায় ৮৫০ কোটি টাকার কালি আমদানি করে।
আকিজ গ্রুপের নেবুলা ইঙ্ক লিমিটেড, মাস্টারপ্যাক লিমিটেড, নিউ রেজুলি স্ক্রিন প্রিন্টিং, পিলক্রো গ্লোবাল, এসকে ট্রেড লিংক, রয়েল ইঙ্ক, নিসান ইঙ্ক-নিসান পেইন্ট, এভারটেক্স ইঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল ও সোভিয়েত মেশিনারিজ লিমিটেড এই রপ্তানিতে এগিয়ে। তবে কালার প্রিন্টের জন্য জাপানের ফুজি ইঙ্ক এর চাহিদা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
নিউ রেজুলি স্ক্রিন প্রিন্টিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আহসান বলেন, শুধু তার প্রতিষ্ঠানই প্রতিবছর ১০০ কোটি টাকার বেশী প্রিন্টারের কালি আমদানি করে থাকে। আগের চেয়ে দিন দিন এই কালির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে তিনি জানান।
আসিফ আহসান বলেন, কম্পিউটারের ব্যবহার যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই হারে তাদের ব্যবসাও বাড়ছে। কারণ, এখন বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অনেকেই ব্যক্তিগত কাজে কম্পিউটার থেকেই নিয়মিত প্রিন্ট দেয়। ফলে এই কালি আমদানির ব্যবসাও বাড়ছে।
এছাড়াও বিভিন্ন প্যাকেজিং ও ব্র্যান্ড প্রিন্টের জন্য উচ্চ মানের পোস্ট প্রিন্ট, ফ্লেক্সো-প্রিপ্রিন্ট এবং ফ্লেক্সো-পোস্টপ্রিন্ট প্রচলিত আছে। যার কালির চাহিদাও বাজারে বাড়ছে।
কলমে কালির ব্যবহার
ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দেশে প্রায় ৪০টি কলম তৈরীর প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখন শীর্ষে রয়েছে ম্যাটাডোর বলপেন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। ৯০ এর দশকে সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত জিকিউ গ্রুপের ইকোনো বলপেন ছাড়াও ক্যাপ্টেন পেন, মেরিট বলপেন, টপ-টেন বলপেন, জননী বলপেন, উইনপেন, গুড লাক পেন, রোজ পেন, আদর্শ বলপেন, চকো চকো বলপেন, আইকন বলপেন, উইনার বলপেন বাজারে উল্লেখযোগ্য।
ম্যাটাডোর বলপেন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শাহ আলম টিবিএসকে বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে ২৩ রকম বলপেন ও জেলপেন উৎপাদন করা হয়। দেশীয় বাজারে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার কলম সরবরাহ করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়াও আরও ১৫০ কোটি টাকার কলম প্রায় ১১ দেশে রপ্তানি করে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতিবছর প্রায় ৫০ কোটি টাকার বিভিন্ন রকম কালি আমদানি করে কলম প্রস্তুতের কাজে ব্যবহার করে ম্যাটাডোর বলপেন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
কলম ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ১০০ কোটি টাকার কালি আমদানি করা হয় কলমের জন্য।
একটি মাত্র দেশীয় কোম্পানী কালি উৎপাদন করে
টোকা ইঙ্ক বাংলাদেশ লিমিটেড ২০১৫ সাল থেকে প্রিন্টিং ও কলমের কালি উৎপাদনের কাজ হাতে নেয়। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মোমেন বলেন, প্রতিবছর প্রায় ১০ কোটি টাকার কালি উৎপাদন ও সরবরাহ করা হয় দেশীয় বাজারে।
বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে তা থেকেই প্রস্তুত করা হয় কালি। তবে কাঁচামাল আমদানি ব্যয়বহুল হওয়ায় প্রত্যাশিত ব্যবসা হচ্ছে না বলে জানান তিনি। তবে ভবিষ্যতে এই ব্যবসায় ভালো করা সম্ভব বলে উল্লেখ করেন এম এ মোমেন।
রাজধানীর ওয়ারি এলাকায় শত বছরের পুরানো প্রিন্টিং প্রেস 'বৈশাখী প্রিন্টিং প্রেস'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোবারক হোসেন বলেন, বিদেশী কালির মান অনেক ভালো। এছাড়াও প্রেসে কালির কুইক সেটিং, কুইক ড্রাইং, অধিক গ্লস, অধিক ছাপা ও ব্যবহারে সহজ বলেই এখন পর্যন্ত রপ্তানি করা কালিই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
দেশে উৎপাদন না হওয়ার কারণ
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) কেমিক্যাল রিসার্চ ডিভিশনের প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার মোঃ হেমায়েত হোসেন টিবিএসকে বলেন, কলম বা প্রিন্টার বা ছাপাখানার জন্য যে কালি উৎপাদন হয়, তার মূল উপাদান হলো কার্বন। যা বাংলাদেশে সংগ্রহ করা বেশ কঠিন ব্যপার।
এছাড়াও লাল রংয়ের কালির জন্য ইয়োসিন বা পটাশিয়াম ফেরিক সায়ানাইড প্রয়োজন এটিও বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। নীল রংয়ের কালির জন্য ব্যবহার করা হয় ট্রাইফিলাইলমিথেন ডাই, ক্রিস্টাল ভায়োলেট, কিউপ্রিক অ্যামোনিয়া সালফেট। এগুলোও বাংলাদেশে পাওয়া বেশ কঠিন।
তিনি বলেন, প্রিন্টারের কালির জন্য গাম অ্যারাবিক, সোদক ফেরাস সালফেট বা আয়রন (২), গ্যালিয়িক এসিড, ইথিলিন গ্লাইকল, প্রপিল গ্লাইকল এবং ফেনাল বা কার্বলিক এসিড বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যায় না। কালি উৎপাদনের এই কাঁচামালগুলো উন্নত দেশগুলোতে সহজেই পাওয়া যায়। এসব উপাদান কাঁচামাল হিসেবে আমদানি করে প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যয়বহুল।
এছাড়াও কালি উৎপাদনে বাংলাদেশে তেমন কোনো গবেষণাও নেই, গবেষণার কোনো উদ্যোগও নেই। ফলে পুরো ব্যবসা এখন আমদানি নির্ভর বলে জানান এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
জার্মানী থেকে বিভিন্ন 'র' কালি নিয়ে ব্লেন্ডিং করে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে জার্মান কোম্পানি সিজওয়ার্ক। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে রাজধানীতে তারা ব্লেন্ডিং সেন্টার চালু করেছে। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ১৯৯০ সাল থেকেই তারা বাংলাদেশে বিভিন্ন রকম কালি রপ্তানি করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, এখন বছরে প্রায় ৮০ হাজার পাউন্ড কালি সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
একটি উৎপাদনে যাওয়ার অপেক্ষায়
বাংলাদেশে কালির ব্যবসা করার জন্য মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে জাপানের বিখ্যাত সাকাটা ইঙ্কস কোম্পানি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি এজন্য পাঁচ একর জমি ইজারা নেওয়ার পর অবকাঠামো নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ করেছে। এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদনে যেতে পারেনি বলে মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনের একজন কর্মকর্তা জানান। জাপানি প্রতিষ্ঠানটি ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে জানা যায়।
সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ
শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন টিবিএসকে বলেন, 'দেশের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান কালি আমদানির কাজ করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠায় তেমন কোনো উদ্যোগ বা প্রস্তাব আমার দায়িত্ব পালনকালে মন্ত্রণালয়ে আসেনি।'
তিনি বলেন, 'তবে দুই একটা বিদেশী প্রতিষ্ঠান কালি প্রক্রিয়াজাতকরণের অনুমতি নিয়েছে। দেশীয় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কালি তৈরির উদ্যোগ নিলে মন্ত্রণালয় আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করবে।'