বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে নীতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত
বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়া এক লাখ ডলার (৮৫.০৬ লাখ টাকা) পর্যন্ত সেবা মূল্য পরিশোধ করতে পারবে বিদেশি কোম্পানিগুলো।
বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কোম্পানিগুলোর বিদেশি কর্মীদের বৈদেশিক মুদ্রা নিজদেশে পাঠানোর প্রক্রিয়াও আরও সহজ হতে যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয়ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়া মূলধন ও লভ্যাংশ প্রত্যাবাসনের উচ্চসীমাও বাড়ানো হতে পারে।
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে অর্থ প্রত্যাবাসন ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা সহজ করতে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শিগগিরই এসব বিষয়ে আলাদা আলাদা সার্কুলার জারি করা হবে।
বাংলাদেশে ব্যবসা করছে এমন বিদেশি কোম্পানিগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক এক সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে বিদ্যমান জটিলতাগুলো দূর করতে বিদেশি উদ্যোক্তাদের মতামত জানতে এই সভার আয়োজন করা হয়।
সভায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় নিয়ে জটিলতা ও অস্থিতিশীল কর নীতিকে বাংলাদেশে ব্যবসার প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. ফজলে কবির, অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম উপস্থিত ছিলেন।
বিদ্যমান নীতিতে বিদেশি কোম্পানিগুলো তাদের পূর্ববর্তী বছরের ট্যাক্স রিটার্নে ঘোষিত টার্নওভারের ১ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়াই সেবা মূল্য হিসেবে পরিশোধ করতে পারে। এতে বড় কোম্পানিগুলোর সমস্যা না হলেও অল্প ও মাঝারি টার্নওভারের কোম্পানিগুলোর সমস্যা হচ্ছে বলে সভায় জানান ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেদার লেলে।
সভায় এই নীতি পরিবর্তন করে ঘোষিত টার্নওভারের ১ শতাংশ- এক লাখ ডলারের মধ্যে যেটি সর্বোচ্চ, সে পরিমাণ অর্থ সেবামূল্য বাবদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুর্বানুমোদন ছাড়া বিদেশে পাঠানোর সুযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়ে শীগগিরই সার্কুলার জারি করা হবে বলে সভায় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
বাংলাদেশে নিবন্ধিত রপ্তানি নির্ভর নয় এমন বিদেশি কোম্পানির বিদেশি কর্মীদের বৈদেশিক মুদ্রার একাউন্ট খোলার সুযোগ নেই। এ কারণে তারা স্থানীয় মুদ্রায় বেতন-ভাতা তুলে পরে তা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা কিনে নিজ দেশে পাঠান। এতে ঝুঁকি ও অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে অনেকেই হুন্ডিতে আগ্রহী হচ্ছেন বলে জানান স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা নাসের এজাজ বিজয়।
এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের বিদেশি কর্মীদের বৈদেশিক মুদ্রার অ্যাকাউন্ট রাখার অনুমতি দিতে পৃথক একটি সার্কুলার জারির সিদ্ধান্ত নেয়া হয। এ সম্পর্কিত সার্কুলার জারির প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
দেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, বিদেশি কোম্পানিগুলো এক কোটি -১০ কোটি টাকা পর্যন্ত সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়া বিদেশে প্রত্যাবাসন করতে পারে। নির্ধারিত উচ্চসীমা বড় বিনিয়োগকারীদের জন্য খুবই অপ্রতুল বলে জানান বিদেশি কোম্পানিগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা। বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে এ সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করেন তারা।
সভায় বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগের কোম্পানির ন্যায্য মান নির্ধারণে মান নির্ধারনী প্যানেল নির্ধারণ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, এটি করা যৌক্তিক হবে না। কারণ অল্প কিছু অডিট ফার্মকে প্যানেলভুক্ত করা হলে অনিয়মের আশঙ্কা বাড়বে।
ইউনাইটেড টোবাকো কোম্পানি লিমিটেডের (জাপান টোবাকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক নীল ক্যুপল্যান্ড বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসায় প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধা কম থাকলেও ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বাধা অনেক বেশি। এটিই বিদশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির সভায় বলেন, একসময় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রিত থাকলেও বর্তমানে এক্ষেত্র উদারনীতিতে পরিচালিত হয়। অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বাংলাদেশে এ ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
স্থিতিশীল করনীতি চান বিদেশি উদ্যোক্তারা
বাংলাদেশের করনীতি ঘন ঘন পরিবর্তন হওয়ায় বিনিয়োগ পরিকল্পনা ঝূঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে উল্লেখ করে নীল ক্যুপল্যান্ড বলেন, করনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা নেই। প্রতিবছর করহার পরিবর্তন হয়। কর আরোপের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকলে সে অনুযায়ী বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ পরিকল্পনা করতে পারতেন বলে জানান তিনি।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা তাকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন নীতি ও বিধি-বিধান আগের তুলনায় সহজ করেছে।
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নীতি অনুমানযোগ্য না হওয়ায় বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, নতুন বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। এনবিআরের করনীতি আরো বিনিয়োগবান্ধব হওয়া প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।
স্যামসাং বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুহুল আলম আল মাহবুব বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে কর অব্যাহতি সুবিধা বহালসহ স্থিতিশীল করনীতি প্রয়োজন।
হোন্ডা প্রাইভেট লিমিটেড বাংলাদেশ এর প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিমিহিকো কাতসুকি বলেন, এমনভাবে করনীতি প্রনয়ণ করা প্রয়োজন যাতে বিদেশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার সুষম ক্ষেত্র নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
কেদার লেলে বলেন, বিদেশি কোম্পানির লভ্যাংশ ও অর্থ প্রত্যাবাসনের সময় যাতে দ্বৈত করারোপণ পরিহার চুক্তি (ডিটিএএ) অনুযায়ী কর ধার্য করা হয় তা এনবিআরকে নিশ্চিত করতে হবে।
এনবিআরের চেয়ারম্যান সভায় বলেন, বিদেশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যৌক্তিক এবং আইন সমর্থিত সব ধরণের সহযোগিতা দিতে এনবিআর আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।