ভারতের নতুন কাস্টমস রুলসে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের রপ্তানি
পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে নতুন যে কাস্টমস রুলস প্রয়োগ শুরু করেছে ভারত, তাতে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত ও বাণিজ্য ঘাটতি বাড়বে হবে বলে আশঙ্কা করছে সরকার। ব্যবসায়ীরাও এ নিয়ে উদ্বিগ্ন।
'কাস্টমস (অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব রুলস অব অরিজিন আন্ডার ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্টস) রুলস, ২০২০' নামে ভারতের নতুন এই বিধি-বিধান কার্যকর হয় গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে।
এতে আমদানি ও রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে পণ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া, না-দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ভারতীয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি করা পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে এতদিন সার্টিফিকেট অব অরিজিন ইস্যু করত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। পণ্য ছাড় করার আগে কোনো ভেরিফিকেশনের দরকার হলে ভারতের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ইপিবির মাধ্যমে তা যাচাই করত।
নতুন রুলস অনুযায়ী, ভারতীয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পণ্য সম্পর্কিত সব তথ্য সংগ্রহ করবে দেশটির আমদানিকের কাছ থেকে। আমদানিকারকরা সেগুলো সংগ্রহ করবে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে।
ভারতের নতুন রুলসের কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ও ইপিবির কর্মকর্তারা।
সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগে কুটনৈতিক প্রক্রিয়ায় নতুন বিধি-বিধান প্রত্যাহারের চেষ্টা চালাবে বাংলাদেশ। এতে সার্ক ও আপটা সচিবালয়কে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
কুটনৈতিক চেষ্টা সফল না হলে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ারও চিন্তা আছে সরকারের। সেক্ষেত্রে ভারত থেকে ফিনিশড পণ্য আমদানিতে বাড়তি শর্তারোপ করা হতে পারে। এ নিয়ে ইতোমধ্যেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে মদ ও তামাকজাতীয় ২৫টি পণ্য বাদে সকল পণ্যে ভারতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। সার্ক প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেডিং অ্যাগ্রিমেন্ট (সাপটা), সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড এরিয়া (সাফটা) ও এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্টের (আপটা) এই সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ।
এসব চুক্তিতে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের সার্টিফিকেট অব অরিজিন ইস্যু ও তা যাচাই করার এখতিয়ার ইপিবির। বহুপাক্ষিক চুক্তির আওতায় দেওয়া সুবিধা জাতীয়ভাবে প্রণীত কোনো রুলস দ্বারা ব্যাহত করা যায় কি না, বাংলাদেশ তা বিশদভাবে পরীক্ষা করছে।
ভারতের নতুন কাস্টমস রুলস এসব চুক্তির শর্তবিরোধী বলে মনে করছে বাংলাদেশ।
বাণিজ্য সচিব মো. জাফর উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বাংলাদেশের করণীয় নির্ধারণ করতে শিগগিরই স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে সভা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বাংলাদেশের রপ্তানি যাতে ব্যাহত না হয়, কুটনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করব।'
নতুন কাস্টমস রুলসে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ
পণ্য খালাসের আগে ভারতের আমদানিকারকদের একটি ফরম পূরণ করে দেশটির কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছে দিতে হবে। তাতে নির্দিষ্ট পণ্যের কাঁচামাল কোন দেশ থেকে কী দামে আমদানি করা হয়েছে, স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করলে রপ্তানিকারক তা নিজে উৎপাদন করেছেন নাকি আমদানি করেছেন- তার উল্লেখ থাকতে হবে।
ফরমে পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া ও ব্যয়ের তথ্যও উল্লেখ করতে হবে। আগে এসব তথ্য রপ্তানিকারকরা ইপিবিকে দিত। ইপিবি থেকে তা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে যেত। নতুন রুলসে সেগুলো দিতে হবে ভারতীয় আমদানিকারকদের। তারা সেগুলো সংগ্রহ করবে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের ব্যবসায়িক গোপনীয়তা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে।
তথ্য-প্রমাণ দিতে আমদানিকারকরা কোনো কারণে ব্যর্থ হলে শুল্কছাড়ের সুবিধা পাবে না। আবার ভেরিফিকেশন চলাকালে ভারতের কাস্টমস কর্মকর্তারা ইচ্ছা করলে শুল্কমুক্ত সুবিধা ছাড়াই পণ্য ছাড় করতে পারবেন।
রুলস অব অরিজিন ভেরিফিকেশনের জন্য ভারতীয় আমদানিকারকদের নোটিশ দেওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য দেশটির কাস্টসম কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। না দিলে তারা প্রেফারেন্সিয়াল ট্যারিফ নাকচ করতে পারবেন।
ভারতের কাস্টমস কলক্ষেপণ করে ভেরিফিকেশনের কাগজ পাঠালে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রপ্তানিকারকরা জবাব দিতে পারবেন না। এতে রপ্তানি কমার ঝুঁকি আছে।
রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কোনো পণ্য একবার শুল্কমুক্ত সুবিধা না পেলে ওই প্রতিষ্ঠানের ওই পণ্যক আর কখনোই শুল্কমুক্ত সুবিধায় ছাড় করবে না ভারত।
রুলসে ভারতীয় কাস্টমস কমিশনারকে এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যাতে তিনি সার্টিফিকেট অব অরিজিন যাচাই না করেই প্রেফারেন্সিয়াল রেট অব ডিউটি নাকচ করতে পারবেন। এটা রপ্তানিকারকদের সব সময় এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে রাখবে।
রুলসে ভেরিফিকেশন অনিষ্পন্ন থাকা অবস্থায় প্রেফারেন্সিয়াল ট্যারিফ সুবিধা স্থগিত রাখার বিধান আছে। এতে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত হতে পারেন।
নতুন রুলসকে কীভাবে দেখছে সরকার?
ভারতের নতুন কাস্টমস রুলসের কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে জানিয়ে ট্যারিফ কমিশন ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) লিখিতভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সতর্ক করেছে। সংস্থা দুটি বলেছে, সাপটা, আপটা ও সাফটা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়, এই রুলসের কারণে তা বাধাগ্রস্ত হবে।
ট্যারিফ কমিশনের সদস্য (ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন) ড. মোস্তফা আবিদ খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বহুপাক্ষিক এসব চুক্তির আওতায় ভারতের বাজারে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানিতে পণ্যের সার্টিফিকেট অব অরিজিন ইস্যু করা ও আমদানিকারক দেশের অনুরোধে তা যাচাই করার কাজ ইপিবি করে আসছে।
তিনি বলেন, 'ভারত নতুন যে রুলস করেছে, তাতে ইপিবির সার্টিফিকেট গ্রহণ না করে তাদের কাস্টমস কর্মকর্তাদের ভেরিফিকেশন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এতে ভারতের আমদানিকারকরা ঝামেলা এড়াতে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি নাও করতে পারেন।'
ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান মনে করেন, ভারতের নতুন কাস্টসম রুলস বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে এক ধরনের নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার। তার আশঙ্কা, এতে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি কমে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি আরও বাড়তে পারে।
তিনি বলেন, সাফটাসহ প্রতিটি বাণিজ্য চুক্তিতে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধার জন্য রুলস অব অরিজিনসহ অন্যান্য বিধি-বিধান স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। এগুলো না মানলে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তাও স্পষ্ট করা আছে। বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির আওতায় ইপিবি সার্টিফিকেট অব অরিজিন ইস্যু করে রুলস অব অরিজিন প্রতিপালনের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে।
এএইচএম আহসান জানান, এসব চুক্তির আওতায় বিধি-বিধান প্রতিপালনে ব্যত্যয় হলে চুক্তি মোতাবেক সব তথ্য প্রমাণ ইপিবি ভারতের কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে সরবরাহ করে। তার ভিত্তিতে ভারতীয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। চুক্তির বাইরে গিয়ে আলাদা রুলস তৈরি ও বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য বা যৌক্তিক নয়।
ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছর বাংলাদেশ হতে ভারতে পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ১.০৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার। পাট ও পাটপণ্য, লেদার ও লেদারগুডস, সবজি ও তৈরি পোশাক বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। গত অর্থবছর ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ৫.৭৭ বিলিয়ন ডলার। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৪.৬৮ বিলিয়ন ডলার।
'এ ধরনের ইন্সপেকশন রুল আমাদের পণ্য রপ্তানিতে প্রভাব ফেলবে' বলে জানান বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অনন্ত অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শরীফ জহির।
এইসব বিধি-নিষেধ ও নিয়ম-কানুনের কড়া মনিটরিংয়ের প্রভাব পাট রপ্তানিকারকদের ওপর না পড়লেও র-ম্যাটেরিয়াল আমদানির ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতে এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভারতের অন্যতম শীর্ষ পাট রপ্তানি প্রতিষ্ঠান জনতা জুট মিলসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাহমুদুল হক।
'পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং এর ব্যয় এই ব্যবসার একটি প্রধান গোপনীয় বিষয় এবং এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য জানতে চাওয়া অনুচিত,' বলেন তিনি।
ভারত আরও বেশি সংরক্ষণ নীতি হাতে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে, যা আজকের দিনের ব্যবসা-বাণিজ্যের একেবারেই উল্টো বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের (বিএফটিআই) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলী আহমেদ।
'বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সব দেশই আরও বেশি উদার হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সঙ্গে একটি কমপ্রেহেনসিভ এক্সপোর্ট প্রিফারেন্সিয়াল চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে বিএফটিআইয়ের সঙ্গে কথা বলাটা ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিস্ময়কর পদক্ষেপ।'
কোনো নির্দিষ্ট দেশের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে কোনো নিয়মের প্রবর্তন করা অন্য দেশগুলোর ওপর প্রভাব ফেলবে বলেও অভিমত তার।