শীতের লিলিয়ামের বাণিজ্যিক চাষাবাদের উজ্জ্বল সম্ভাবনা
ষড়ঋতুর এই দেশে ফুটেছে শীত প্রধান দেশের ফুল লিলিয়াম। ইতোমধ্যে গবেষণা মাঠে থোকায় থোকায় ফুটেছে লাল, হলুদ, সাদাসহ নানা বর্ণের লিলিয়াম। ৫ বছরের গবেষণার পর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক এরই মধ্যে এই ফুলের দুটি জাত অবমুক্ত করেছেন।
দেশ বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকায় এই ফুলের রয়েছে বাণিজ্যিক চাষাবাদের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। তাই আবহাওয়া উপযোগী করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফুল চাষীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই ফুল সম্প্রসারণ করার কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন এখানকার কৃষি কর্মকর্তারা।
আর বাণিজ্যিক চাষাবাদে লিলিয়াম ফুলে সাফল্যের মুখ দেখছেন কৃষকরাও। তারা জানিয়েছেন, এই ফুলে ভাল লাভ হওয়া এবং বাজারে চাহিদা থাকায় ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে চাষের ব্যবস্থা করবেন তারা।
শুধু এশিয়ায় নয়, সারা বিশ্বে সমাদৃত লিলিয়াম ফুল। এই ফুলের আবাসস্থল এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশ হলেও বেশি দেখা যায় চীন, জাপান, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড, ভারতসহ আরো কয়েকটি দেশে। বিভিন্ন ধরনের লিলিয়াম ফুল থাকলেও উল্লেখযোগ্য জাত হচ্ছে, এশিয়াটিক, ওরিয়েন্টাল, মারটাগন, সিউডোলিরিয়াম জাতের ফুল। লিলিয়ামের চাষের জন্য উপযোগী বেলে দো-আঁশ মাটি। লিলিয়াম লিলিয়েসি পরিবারের একটি বর্ষজীবী কন্দজ ফুল, যাকে বিবেচনা করা হয় মূল লিলি হিসেবে। অনেক চাষী বিভিন্ন ঋতুতে তাপমাত্রার তারতম্যভেদে নেট দিয়ে শেড তৈরি করে এই ফুল চাষ করেন, এতে ফলন ভালো হয়। ফুল সংগ্রহ উপযোগী হয় কন্দ বা বাল্ব বপনের ১০০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে।
উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের গবেষক নাজনীন আফরোজ জানান, দেশ বিদেশে এই ফুলের চাহিদার কথা মাথায় রেখে ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা বিভাগের একদল গবেষক লিলিয়াম ফুলের ওপর গবেষণা শুরু করেন। এরই মধ্যে দলটি এ পর্যন্ত এশিয়াটিক জাতের ৩০টি জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে গবেষণার মাধ্যমে দেশের আবহাওয়া উপযোগী দুটি জাত অবমুক্ত করেছেন। বাংলাদেশেও লিলিয়াম ফুল চাষাবাদের জন্য শেডের দরকার হয়। চাষাবাদের জন্য মাটির সঙ্গে সমান অনুপাতে গোবর সার এবং কোকো ডাস্ট মেশাতে হবে। কোকো ডাস্ট্রের মিশ্রণ হলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
অপর গবেষক কারিমাতুল আম্বিয়া জানান, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে লিলিয়াম ফুলটির উদ্ভাবিত জাত দুটিতে তেমন রোগ বালাই হয়না। এছাড়া পোকামাকড়ের আক্রমণও কম। শুধুমাত্র গবেষণাকালে এই ফুলের পাতার মধ্যে ব্লাইট এবং জাব পোকার উপস্থিতি দেখা গেছে যা সহজে দমন করা যায়। তবে কোল্ডস্টোরেজ কম থাকায় এই ফুলের বাল্ব সংরক্ষণে সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
লিলিয়াম ফুল চাষাবাদ নিয়ে কথা হয় রংপুর সদরের পাণ্ডার দিঘী গ্রামের ফুল চাষী আব্দুল কাদের সঙ্গে। তিনি জানান, ২০১৩ সাল থেকে তিনি ফুলের বাগান তৈরি করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল বিক্রি করছেন। তার চিড়িয়াখানা মোড়ে মাধবী ফুল বিতান নামে ফুলের দোকান রয়েছে। সাধারণত ১৬ ডিসেম্বর, ২১ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব ভালবাসা দিবসসহ নানা অনুষ্ঠানে ফুলের অনেক চাহিদা থাকে। গত করোনায় তার ১৫ লাখ টাকা ক্ষতি হলেও এবার এসব দিবসে ভাল বেচাকেনা হয়েছে ফুলের।
আব্দুল কাদের জানান, এবার ২১ ফেব্রুয়ারি ও বিশ্ব ভালবাসা দিবসে তিনি চার হাজার লিলিয়াম ফুল বিক্রি করেছেন। প্রতিটি ফুল ঢাকায় ১০০-১৬০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন তিনি। আর ঢাকার দোকানে সাধারণ ক্রেতারা কিনেছেন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দরে।
এবছর আব্দুল কাদেরের ফুল বিক্রির পরিমাণ ২৬ লাখ টাকা। এখনো তার বাগানে ৪-৫ লাখ টাকার ফুল বিক্রির উপযোগী রয়েছে। আর জমি তৈরি, সার, কৃষি শ্রমিক খরচ সহ লিলিয়াম ফুলের চার হাজার চারা রোপন করে চাষাবাদে তার খরচ হয়েছে ১০ লাখ টাকা। তারমতো আরও ২২ জন কৃষক এই অঞ্চলে লিলিয়াম ফুলের চাষাবাদে জড়িত বলে জানান তিনি।
লিলিয়াম ফুল অত্যন্ত লাভজনক বলে জানিয়েছেন একই জেলার গঙ্গাচড়া গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ। তিনি জানান, তার ১০০ শতক জমির ওপর ফুলের বাগান রয়েছে। শুরুতে বাগানে গোলাপ, গাদাসহ নানা ফুল চাষ করলেও এবার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেড় শতক জমিতে লিলিয়াম ফুল চাষ করেছেন। চাষাবাদের জন্য তিন মাস আগে লিলিয়াম ফুলের বাল্ব (কন্দ) তিনি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বিনামূল্যে পেয়েছেন। ৩০০ বাল্ব (কন্দ) রোপন করে ইতোমধ্যে ২০০ লিলিয়াম ফুল বিক্রি করেছেন।
তিনি জানান, নিজ হাতে শেড তৈরি করে দেড় শতক জমিতে লিলিয়াম বাগান করতে তার খরচ হয়েছে ৬ হাজার টাকা। আর এরই মধ্যে ফুল বিক্রি করেছেন ১৫ হাজার টাকা। অধিক লাভজনক ফসল হওয়ায় আরো বড় পরিসরে লিলিয়াম বাগান করার পরিকল্পনা রয়েছে তার।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (কন্দাল ফসল গবেষণা) ড.কবিতা আঞ্জুমান আরা জানান, বাংলাদেশের ফুলপ্রেমীদের কাছে লিলিয়াম খুবই পছন্দের ফুল। নববর্ষ, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসসহ বিশেষ দিনগুলোতে ৮০- ২৫০ টাকা দামে বিক্রি হয় লিলিয়াম। আর তাই মাঠ পর্যায়ে আরো বেশি পরিমাণে চাষাবাদের জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা এগিয়ে এসেছে।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (সেবা ও সরবরাহ) ড. এস. এম. শরিফুজ্জামান জানান, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ দুই শতাধিক ফুল ফসল নিয়ে গবেষণা করছে এবং সারা দেশে বিভিন্ন ফুলের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। ইতোমধ্যে যশোর, রংপুর, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় লিলিয়াম ফুলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরু হয়েছে জানিয়ে এই কৃষি কর্মকর্তা বলছেন, কৃষকদের জন্য কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ ২১টি জাতের ফুল অবমুক্ত করেছে। বাণিজ্যিক সম্ভাবনা থাকায় ফুল চাষে কৃষকরা আগের তুলনায় অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠছেন। ট্রেনিং, মাঠ দিবস, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে কৃষকদের ফুল চাষে প্রশিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে।
বসন্তের এই সময়ে গবেষণা মাঠের নেটের শেডের ভেতর ফুটেছে ৩০ প্রজাতির নানা বর্ণের মনকাড়া শতশত লিলিয়াম ফুল। এখনকার কৃষি কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফুল চাষে সম্পৃক্ত হয়েছেন অন্তত ৫ লাখ কৃষক। বিভিন্ন উপলক্ষে বছরে ৮শ' কোটি টাকার বেশি ফুল ফসল বিক্রি হচ্ছে।