সঙ্কটে কুমিল্লার খাদি শিল্প
চাহিদা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও দক্ষ তাঁতির সঙ্কট দেখা দেওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে কুমিল্লার খাদি শিল্প। দুই দশক আগেও কুমিল্লায় তাঁতির সংখ্যা ছিল দুইশোর বেশি। কিন্তু বর্তমানে কমতে কমতে গিয়ে ঠেকেছে ২০'র কোঠায়। রঙের কারিগর ও সংশ্লিষ্ট শ্রমিকসহ এ কাপড় উৎপাদনের সাথে বর্তমানে জড়িত আছেন ৯০জনের মতো।
কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প বাঁচাতে মন্ত্রণালয়ের এখন পর্যন্ত কোনও উদ্যোগ না থাকাতে এমন সঙ্কট দেখা দিয়েছে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট কারিগর ও খাদি কাপড়ের ব্যবসায়ীরা।
কুমিল্লায় খাদির বর্তমান অবস্থা
একজন তাঁতি দৈনিক ৬০ গজের মতো কাপড় উৎপাদন করতে পারেন। সে হিসেবে তাঁতির সংখ্যা বিবেচনায় জেলায় দৈনিক গড়ে ১২০ গজ খাদি কাপড় উৎপাদন হয়। মোটা কাপড় প্রতি গজ বিক্রি হয় ৪০ টাকায়, আর চিকন কাপড় বিক্রি হয় ১২০টাকায়। উৎপাদন কম হলেও দাম নিয়ে সন্তুষ্ট তাঁতিরা। কাপড় কিনে নেন কুমিল্লা নগরীর খুচরা বিক্রেতারা। তারপর নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে সেলাই করে নেন তারা। আগে কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার বেলাশহর, দেবিদ্বারের বরকামতা, মুরাদনগরের রামচন্দ্রপুর ও কুমিল্লা সদরের কমলপুরে খাদি কাপড় উৎপাদন হতো। বর্তমানে বরকামতা ও বেলাশহরে খাদি কাপড় তৈরি হচ্ছে।
কমলপুরে সীমিত পরিসরে খাদি কাপড় উৎপাদন হলেও রামচন্দ্রপুরে খাদি পুরোই কাপড় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।
কুমিল্লা মহানগরীতে বর্তমানে চার শতাধিক খাদি কাপড়ের দোকান রয়েছে। লোকবল আছে ৩ হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যে চার থেকে পাঁচটি দোকান ব্যতীত বেশিরভাগ দোকানই মেশিনে তৈরি কাপড় কিনে খাদি বলে বিক্রি করেন। স্বাভাবিক সময়ে দোকানগুলোতে দৈনিক গড়ে ৩০ হাজার টাকার খাদি কাপড় বিক্রি হতো। লকডাইনের পর দোকানপাট খুললেও বিক্রি কম হয়েছে।
এখন কাপড় বিক্রির ভরা মৌসুম চলছে, অর্থাৎ শীত আসাতে বিক্রি বেড়ে গেছে। শীতের সময়ে প্রতি দোকানে গড়ে ৪০ হাজার টাকার কাপড় বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কুমিল্লার ব্যবসায়ীরা। শীতের প্রকোপ শেষ হলে বিক্রি অর্ধেকে নেমে আসবে বলেও তারা জানান।
খাদির উৎপাদনের সাথে বেশকিছু বিষয় জড়িত। তাঁতি, সুতা কাটুনি, ব্লক কাটার ও রঙের কারিগর—সবার মিলিত শ্রমে তৈরি হয় খাদি।
খাদি কেন জৌলুস হারাল
যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও ইউরোপের কিছু দেশসহ প্রায় ১০টি দেশে কুমিল্লার খাদি কাপড় রপ্তানি হতো। এছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্রমণে আসা পর্যটক ও কুমিল্লার প্রবাসীদের পছন্দ ছিল খাদির পোশাক। নব্বইয়ের দশকের পরই রপ্তানি কমতে থাকে। খাদির পরিবর্তে অধিক লাভজনক তৈরি পোশাকের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন বিনোয়গকারীরা। তৈরি পোশাক শিল্পের রমরমায় মনোযোগ খুঁইয়ে বিদেশী বাজার হারায় খাদি কাপড়। বিনিয়োগ কমে যায় খাদি উৎপাদনে। বংশ পরম্পরায় খাদি শিল্পের সঙ্গে জড়িত তাঁতিরা পৃষ্ঠপোষকতা হারিয়ে, বেশি আয়ের উদ্দেশ্যে ভিন্ন পেশার দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। একই সময়ে কাপড়ের বাজারে মোটা কাপড়ের তুলনায় চিকন কাপড়ের চাহিদা বেড়ে যাওয়াতে খাদি শিল্পের সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়।
কুমিল্লায় খাদি বিপ্লব
১৯২১ সালে স্বদেশী আন্দোলনের সময় কুমিল্লার ঠাকুরপাড়া অভায়াশ্রমে আসেন মহাত্মা গান্ধী। এসময় দেশের সর্বত্র মোটা কাপড়, মোটা ভাত আন্দোলন গড়ে ওঠে। ডাক ওঠে বিদেশি পণ্য বর্জনের। তিনি নিজেও চরকার বুনন দেয়া মোটা কাপড় পরতেন। গান্ধীর আহ্বানে চান্দিনার শৈলেন গুহ পথপ্রদর্শক হিসেবে কুমিল্লায় খাদি কাপড় উৎপাদন শুরু করেন। তখন থেকে শুরু হয় কুমিল্লায় খাদি বিপ্লব। মোটা ও পরতে বেশ আরামদায়ক পোশাক হওয়ায় অল্প সময়ে সারাদেশে বিস্তার লাভ করে কুমিল্লার খাদি কাপড়। সেই থেকে ১০০ বছর ধরে কুমিল্লায় তৈরি হচ্ছে খাদির পোশাক।
তাঁতি ও খুচরা বিক্রেতা
চান্দিনার তাঁতি ক্ষিতিশ চন্দ্র দেবনাথ। ৪০ বছর ধরে বেলাশহরে খাদি কাপড় উৎপাদন করছেন। তিনি জানান, 'আমার বাবাও দাদা এ পেশায় জড়িত ছিলেন। কিন্তু আমার সন্তানকে এ পেশায় রাখতে পারিনি। সন্তানরা মনে করেছে, এ পেশায় তাদের চলবে না। আমার পর এ বংশের কেউ আর এ পেশায় থাকবে না।'
তিনি জানান,'জাতীয় নির্বাচনের আগে তাঁতি শিল্পীদের বাঁচাতে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলে শিল্প মন্ত্রণালয়। এসময় আমাদের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়ে যান তারা। এরপর গত দুই বছরে আর যোগাযোগ করেননি তারা।'
দেবিদ্বারের বরকামতার আরেক তাঁতি সীতাহরণ দেবনাথ জানান,'৫০ বছর ধরে খাদি কাপড় উৎপাদন করছি। ধীরে ধীরে চোখের সামনে তাঁতি ও রঙের কারিগরের সংখ্যা কমতে দেখেছি। কিন্তু তাদের ধরে রাখতে না সরকারের পক্ষ থেকে না অন্য কোনও জায়গা থেকে উদ্যোগ চোখে পড়েছে।'
খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতা কুমিল্লার খাদি কুটিরের ব্যবস্থাপক অরূপ সরকার বলেন,'দেশীয় অর্থনীতির অবস্থা আর করোনার কারণে বিক্রি এমনিতেই ভালো না। খাদি কাপড়ের উৎপাদনও কমে গেছে। ১৯৩১ সাল থেকে বংশ পরম্পরায় ব্যবসা করে আসছি। উৎপাদন কমে যাওয়ায় ভবিষ্যতে আসল খাদি যোগান দিতে বেশ অসুবিধাই হবে।'
খাদি ভূষণের স্বত্বাধিকারী চন্দন দেব রায় জানান,'চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্র ছিলাম। লাভজনক বলে এখনও পৈতৃক ব্যবসাটা ধরে রেখেছি। কিন্তু তাঁতিদের ঘরে সূর্যের আলো না পৌঁছানোয় এখন হুমকির মুখে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প। গ্রামের তাঁতিদের ধরে রাখতে পারলে সুদিন ফিরবে।'
কুমিল্লা দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আতিক উল্লাহ খোকন বলেন,' খাদি আমাদের ঐতিহ্যের ধারক, এর সঙ্কট কাটানোর জন্য কী করণীয়, তা দ্রুত নির্ধারণ করব।'
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর বলেন,'আমরা তাদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করেছি। প্রয়োজনে তাদের জন্য মার্কেটিংয়ের ব্যবস্থাও আমরা করবো। তারপরও কেউ যদি এ পেশা ধরে রাখতে না চায়, তাহলে আমরা তো জোর করতে পারবো না।'