হারিয়ে যাচ্ছে গাজীপুরের তাঁতের তৈরি ঐতিহ্যবাহী তোয়ালে শিল্প
সুতার দাম বৃদ্ধি, শ্রমিক সংকট, ব্যাংক ঋণের অভাবসহ নানা সীমাবদ্ধতায় ধুঁকে ধুঁকে চলছে গাজীপুরের কালীগঞ্জের তাঁতের তৈরি ঐতিহ্যবাহী তোয়ালে শিল্প। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে এ শিল্প। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে পেশা বদল করছেন অনেকেই। অবশ্য জেলা প্রশাসন বলছে, তোয়ালে শিল্প রক্ষায় ব্যাংক ঋণ দেয়াসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন তারা। এ ব্যাপারে সরকার প্রণোদনাসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বালিগাঁও, মূলগাঁও, বড়নগর, ভাতগাতি, খঞ্জনাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে তাঁতের তৈরি তোয়ালের কদর দেশজোড়া। এখানে উৎপাদিত তোয়ালে চট্টগ্রাম, নরসিংদী, ঢাকাসহ সারা দেশে প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়। প্রায় দুই শতাধিক কারখানাতে গত ৬০-৭০ বছর ধরে তৈরী হচ্ছে তোয়ালে; এ খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১০-১২ হাজার নারী ও পুরুষের।
তোয়ালে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন রং, পাউডার, সুতার দাম বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে ব্যবসায় লাভ করা সম্ভব হচ্ছে না। তোয়াল তৈরীর উৎপাদন সামগ্রীর দাম কমানো এবং দীর্ঘমেয়াদী সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করলে ব্যবসায় লাভের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে এই শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
তোয়ালে কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা বলছেন, তাঁতের তৈরি তোয়ালে তৈরিতে যে পরিমাণ শ্রম ও সময় বিনিয়োগ করা হয় সে তুলনায় তাদের মজুরি অনেক কম। এ কারণে পৈত্রিক এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন অনেকেই। ভালো মজুরি থাকায় বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করছেন তারা।
জরিনা টেক্সটাইল নামের একটি তোয়ালে কারখানায় ২১ বছর ধরে কাজ করছেন শ্রমিক বোরহান। তিনি জানান, "সুতার সঙ্গে সঙ্গে রঙের দাম, পাউডারের দাম, কেমিক্যালের দাম খালি বাড়ে। বাড়তে বাড়তে এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে মালিকই টিকতে পারছে না। আমরা সপ্তাহে উৎপাদন চুক্তিতে যে কাজ করছি তার বেতন ঠিকমত পাই না। সপ্তাহে ৩ হাজার টাকার কাজ করতে পারি কিন্তু তাও সময়মত দেয়া হয় না। বহু বছর ধরে এখানে আছি তাই এ পেশা ছাড়তেও পারছি না। কোনমতে টিকে আছি"।
কারখানা মালিকরা বলছেন, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজার ও দেশীয় বাজারে বেড়েছে সুতার দাম। ফলে তোয়ালের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। অব্যাহতভাবে তুলা ও সুতার দাম বৃদ্ধি, শ্রমিক সংকট ও ব্যাংক ঋণের অভাবসহ নানা সীমাবদ্ধতায় ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটি এখন টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়েছে। এছাড়া তাঁতের তৈরি তোয়ালের তুলনায় মেশিনে উৎপাদিত তোয়ালের দাম কম থাকায় এসব তোয়ালের বাজার এখন মন্দা। মজুরি কম থাকায় অনেক শ্রমিকও পেশা বদল করে বিভিন্ন কাজ করছেন। ফলে দক্ষ শ্রমিক সংকটে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক কারখানা। এ অবস্থায় তোয়ালে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সুতার দাম কমানো, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধাসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি করছেন তারা।
এ ব্যাপারে জরিনা টেক্সটাইল কারখানার মালিক মোহাম্মদ শরীফ জানান, "আগে সুতার দাম কম ছিল। ১৮-২০ হাজার টাকায় এক বেল সুতা পাওয়া যেত। গত ৩-৪ মাস ধরে এক বেল সুতা কিনতে হচ্ছে ৩২ হাজার ২০০ টাকা দরে। ফলে চার মাস ধরে এক বেল সুতায় ১২ হাজার টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। এছাড়া পরিবহন খরচ, শ্রমিক বেতন, বিদ্যুৎ বিলসহ নানা খরচ তো রয়েছে। এ অবস্থায় এখানে ২৭ জন শ্রমিক কাজ করে, তাদের বেতন ভাতা দিতেই হিমশিম খাচ্ছি। ব্যবসা করে যে সঞ্চয় ছিল তা ভর্তুকি দিতে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। এখন বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কারখানা চালাতে হচ্ছে"।
অপর একটি কারখানার মালিক আশরাফুল ইসলাম জানান, "কালীগঞ্জের তোয়ালে মূলত বাবুবাজার, শেখের চর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জসহ বেশ কিছু জায়গায় পাইকারি দরে বিক্রি হয় যা পরে সারা দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। আমার এই কারখানা থেকে প্রতি সপ্তাহে দুই হাজার পিস বিভিন্ন সাইজের তোয়ালে বিক্রি করি। প্রতিটি তোয়ালে মানভেদে ১০০-১৫০ টাকা দরে পাইকারি বিক্রি হলে খুচরা পর্যায়ে তা ২০০-২৫০ টাকায় বিক্রি হয়। খুচরা পর্যায়ে ভাল দাম পাওয়া গেলেও আমরা কারখানা মালিকরা তেমন লাভ করতে পারছি না"।
ঐতিহ্যবাহী এ তাঁত শিল্পটি হারিয়ে যেতে বসেছে স্বীকার করে জেলা প্রশাসন থেকে নানা উদ্যোগ ও সরকারি সহায়তার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম জানান, "কালীগঞ্জের যে অঞ্চলগুলোতে পাওয়ার লুমের মাধ্যমে তোয়ালে তৈরি হচ্ছে তাদের সহযোগিতার বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং মাঝারী শিল্পের বিষয়ে সরকার ইতোমধ্যে প্রণোদনাসহ সহজ শর্তে ঋণ ঘোষণা করেছে। এ ব্যাপারে আমরা তাদের সাহায্য করব এবং নিকটস্থ যে ব্যাংকগুলো রয়েছে সেখান থেকে তারা সহজ শর্তে ঋণ গ্রহণ করতে পারেন। যে কোন অসুবিধা হলে আমরা দেখব"।
কালীগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী তোয়ালে শিল্পের দুর্দিনে এ খাতে সরকারি সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্প আবার রপ্তানিমুখী পণ্যে পরিণত হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।