প্রথমবারের মতো বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় পৌঁছালো ১০ বিলিয়ন ডলারে
প্রথমবারের মতো ২০২১-২২ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। মেগাপ্রকল্পে বৈদেশিক ঋণের যথাযথ ব্যবহার, উন্নয়ন ঋণদাতাদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা এবং কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের তহবিল এর ফলে এটি সম্ভব হয়েছে।
এর আগে বৈদেশিক সহায়তা সর্বোচ্চ অর্থ ছাড় হয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে, ৭.৯৫ বিলিয়ন ডলার। এ হিসেবে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে অর্থছাড় বেড়েছে ২৬ শতাংশ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে এই তথ্য।
ছাড় হওয়া অর্থের মধ্যে প্রায় ২.৬ বিলিয়ন ডলার ছিল বাজেট সহায়তা এবং টিকা কেনার ঋণ। বাকি অর্থ ব্যয় হয়েছে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে।
কোভিড অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ১.০৯ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পেয়েছিল দেশ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কামাল মুজেরি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণে যেসব প্রকল্প এখন বাস্তবায়ন হচ্ছে এর মধ্যে অনেক প্রকল্পই বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া কোভিড পরবর্তী সময়ে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজের গতি বেড়েছে। এ কারণে বৈদেশিক ঋণে ছাড়ও বাড়ছে।"
এছাড়া সরকার বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নে বিদেশ থেকে বাজেট সহায়তা নিচ্ছে। এ কারণে বৈদেশিক সহায়তা ছাড় বেড়েছে। নমনীয় সুদে বাজেট সহায়তা ঋণ নেওয়ার কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার চাপ কিছুটা হলেও কম ছিল।
ইআরডির কর্মকর্তরারা জানান, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে রপ্তানি ছাড়া অন্যান্য কোনো সূচক বাংলাদেশেরে অনুকূলে নেই। বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া, ডলার মূল্য বৃদ্ধি, জ্বালনি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি- সব কিছু বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছে। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়নে নেমে এসেছে। এক্ষেত্রে বৈদেশিক অর্থ ছাড় বিশেষ করে বাজেট সহায়তা রিজার্ভকে অনেক সহায়তা দিয়েছে।
ইআরডি কর্মকর্তরারা আরো বলেন, কোভিড পরবর্তী সময়ে বৈদেশিক সহায়তার অর্থছাড় বাড়াতে সরকার বেশি কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ বৈদেশিক ঋণে বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পে বাস্তবায়ন গতি বাড়িয়ে অর্থছাড় করার কৌশল ছিল সরকারের। এই কারণে উন্নয়ন প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণের ছাড় যেকোনো অর্থবছরের চেয়ে বেশি।
ঋণ পরিশোধেও রেকর্ড
২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড অর্থছাড়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধেও রেকর্ড হয়েছে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, এই অর্থবছরে সরকার ঋণের সুদ আসল মিলিয়ে সর্বোচ্চ ২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে।
এর মধ্যে সরকার আসল পরিশোধ করেছে ১.৫ বিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ায় সেসবের জন্য নেওয়া ঋণের আসল পরিশোধের চাপ বাড়ছে।
এর আগের অর্থবছরে সরকার আসল ও সুদ মিলিয়ে পরিশোধ করেছে ১.৯ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে আসল ছিল ১.৪ বিলিয়ন ডলার।
সর্বোচ্চ অর্থছাড় করেছে এডিবি
২০২১-২২ অর্থবছরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ছাড় করেছে ২.৬ বিলিয়ন ডলার। জাপান ছাড় করেছে ২.২ বিলিয়ন ডলার।
ছাড় হওয়া অর্থের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে এসেছে ১.৭ বিলিয়ন। এছাড়া রাশিয়া ১.২ বিলিয়ন এবং চীন ছাড় করেছে ১ বিলিয়ন ডলার।
কমেছে প্রতিশ্রুতি
২০২১-২২ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড় বাড়লেও তাদের প্রতিশ্রুতি কমেছে ১৩ শতাংশ।
ইআরডি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ৮.২ বিলিয়ন ডলার। এর আগের অর্থবছরে যা ছিল ৯.৪ বিলিয়ন।
এরমধ্যে বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং জাপান প্রত্যেক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা দেড় বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া ১.১ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে চীনের কাছ থেকে।
পাইপলাইনে ৪৮.৫ বিলিয়ন ডলার
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে পাইপলাইনে বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ এখন ৪৮.৫ বিলিয়ন ডলার। এর আগে সেই অর্থবছরের শুরুতে পাইপলাইনে ছিল ৫০.৩৪ বিলিয়ন ডলার।
ড. মোস্তফা কামাল বলেন, "বৈদেশিক ঋণের অনেক মেগা প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাচ্ছে। আগামী কয়েক বছরে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে। ফলে এখন থেকে সরকারকে সতর্ক হতে হতে হবে।"
সরকারকে নমনীয় বৈদেশিক ঋণ বাড়ানোতে কৌশলী হতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "প্রকল্প বাস্তবায়নে হার দ্রুত করে পাইপলাইনে আটকে থাকা বৈদেশিক ঋণের ছাড়ও বাড়াতে হবে। তবে গুণগত প্রকল্প নেওয়া এবং বাস্তবায়ন কাজে মান নিশ্চিত করতে হবে।"
আগামীতে বৈদেশিক ঋণের চাম কমাতে রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।