ডিম-মুরগির বাজারে অস্থিরতার সুযোগে ১৫ দিনে বাড়তি মুনাফা ৫২০ কোটি টাকা
পোল্ট্রির বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে পরিকল্পিতভাবে ১৫ দিনের মধ্যে মুরগির বাচ্চা, ডিম ও ব্রয়লার উৎপাদনকারী বড় কোম্পানিগুলো বাজার থেকে অতিরিক্ত ৫২০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বলে অভিযোগ করেছে পোল্ট্রি খামারি ও ডিলারদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন।
শনিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে খামারি ও ডিলারদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন এই অভিযোগ তুলে। এ সময় লিখিত বক্তব্য প্রদান করেন সংগঠনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার।
সংগঠনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, 'দেশে পোল্ট্রি খাতটি এখন মাফিয়া চক্রের হাতে চলে গেছে। কাজী ফার্মস, প্যারাগন, সিপি, নারিশ, ৭১, আফিল, নিউ হোপ সহ ১০ থেকে ১২টি বড় কোম্পানি যোগসাজশ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।'
সংগঠনের নেতারা দাবি করেন, দেশে প্রতিদিন ডিমের চাহিদা সাড়ে চার কোটি পিস। এর মধ্যে বড় কোম্পানিগুলোই আড়াই কোটি পিস ডিম সরবরাহ করে, বাকিটা আসে প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে। অস্থিরতার এই সময়ে প্রতি ডিমে তিন টাকা করে বেশি নিয়ে প্রতিদিন সাত কোটিরও বেশি টাকা তারা অবৈধভাবে লাভ করেছে। এভাবে গত ১৫ দিনে বড় কোম্পানিগুলো ডিমের বাজার থেকে ১১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
কোম্পানিগুলো দেশের ব্রয়লার মুরগির সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। ব্রয়লার মুরগির সংকট তৈরি করে প্রতি কেজিতে ১০-১২ টাকা লাভ করেছে কোম্পানিগুলো। এর মাধ্যমে গত ১৫ দিনে তারা ১৭২ কোটি টাকার বেশি ভোক্তার পকেট থেকে নিয়েছে।
অন্যদিকে মুরগির বাচ্চার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি বড় কোম্পানিগুলোর হাতে। প্রতিটি বাচ্চার উৎপাদন খরচ ২৫-২৮ টাকার মধ্যে হলেও ৪০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে এক কোটি ৩০ লাখ বাচ্চা বিক্রি থেকে গড়ে ২৩৪ টাকা বাড়তি মুনাফা করেছে কোম্পানিগুলো।
তবে কোন কোন দিন মুরগির বাচ্চা উৎপাদন খরচের নিচেও যেমন ১৫-১৯ টাকাতে বিক্রি করার কথাও উল্লেখ করেন তারা।
এই অবস্থার কারণে অনেকটা চাপের মধ্যে পড়েছে প্রান্তিক খামারিরা। তবে খামারিরা এতদিন যে মুরগি ১২০ টাকা বা তারও কমে বিক্রি করেছে সেটা এই অস্থিরতার মধ্যে ১৪০-১৪৫ টাকায় বিক্রি করেছে বলেও জানান সংগঠনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার।
তবে বাচ্চা ও ফিড কিনতে গিয়ে খামারিদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি নাজুক হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তারা। কোম্পানির এক বস্তা ফিড (৫০ কেজি) কিনতে হলে খামারিকে গুনতে হয় ৩৩০০ টাকা। তবে কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ব্যবসা করলে (কন্ট্রাক্ট ফার্মিং) এটা ২৫০০ টাকায় পাওয়া যায়, যা স্বাধীনভাবে ব্যবসার অন্তরায় বলে জানান সংগঠনের নেতারা।
সংগঠনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার দাবি করেন, কোম্পানিগুলো কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাচ্চা ও ফিডের দাম বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে এখন অনেক কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারের নিবন্ধিত খামারির সংখ্যা ছিল এক লাখ, যেখান থেকে এখন ৪০ হাজার খামারিই এই ব্যবসায় নেই।
সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, মুরগি ও ডিমের দাম আসলে আড়তে নির্ধারণ হয় না। সারাদেশে আড়তগুলোয় বড় কোম্পানির লোক থাকে। কোম্পানিরা যে দাম নির্ধারণ করতে বলে আড়তগুলোতে সেই দামেই বেচাকেনা হয়।
তবে গত শুক্রবার বড় কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) এর পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়- অনাকাঙ্খিত মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে 'ডিমান্ড-সাপ্লাই গ্যাপ' ও সুযোগ সন্ধানী মধ্যস্বত্বভোগীরাই বাড়তি মুনাফা লাভ করেছে।
বিপিআইসিসি সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, বর্তমান সময়ে এক কেজি ওজনের ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে খামারির খরচ পড়ে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা এবং ডিমের খরচ নূন্যতম ৯.৫০ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে ফিড তৈরির কাঁচামালের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতন, পণ্য আমদানিতে মাত্রাতিরিক্ত জাহাজ ভাড়া, লোডশেডিং ইত্যাদি কারণে ডিম ও মুরগির মাংসের উৎপাদন খরচ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে উদ্বেগের বিষয়টি হচ্ছে খামারিরা লোকসান গুনলেও মধ্যস্বত্বভোগীরা (পাইকারী বিক্রেতারা) অন্যায্য মুনাফা করছে। ফলে খামারি ও ভোক্তা উভয়েই প্রত্যাশিত প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মসিউর বলেন, গত ৬ আগস্টের আগে খামারিরা ব্রয়লার মুরগি কেজি প্রতি গড়ে ১২৮-১৩১ টাকায় অর্থাৎ প্রতি কেজিতে ১২-১৪ টাকা লোকসানে বিক্রি করলেও মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভ করেছে কেজিতে ২৭-৩২ টাকা।
তিনি বলেন, বাজার ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীরা থাকবেই তবে লাভের পরিমাণটা যৌক্তিক হতে হবে। প্রান্তিক খামারিরা ন্যায্যমূল্য না পেলে উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। তাই প্রান্তিক খামারিদের সুরক্ষায় সরকারকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।